না, ভিডিওটি বাংলাদেশে হিন্দু সাধুর জটা কেটে ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের নয়
বুম দেখে ভিডিওর ওই ব্যক্তি একজন মুসলিম, কোনও হিন্দু সাধু নন। মানসিক অসুস্থতার কারণে তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন।
ঘরছাড়া এক ব্যক্তিকে বাংলাদেশে (Bangladesh) কিছু যুবকের চুল-দাড়ি কেটে পরিষ্কার-পরিছন্ন করে দেওয়ার ভিডিও সম্প্রতি ভারতে এক মিথ্যা, সাম্প্রদায়িক দাবিসমেত (communal claim) পোস্ট করে বলা হয়, এভাবেই একজন হিন্দু সাধুকে (Hindu monk) জোর করে ধর্মান্তরিত (religious conversion) করা হচ্ছে ইসলামে (Islam)।
বুম যাচাই করে দেখে, যে ব্যক্তিকে একজন হিন্দু সাধু বলে দাবি করা হচ্ছে, তিনি আদতে রেজাউল কবীর নামের একজন দীর্ঘ সময় ধরে নিখোঁজ থাকা মুসলিম।
বুম বাংলাদেশ কবীরের দাদার সাথে এবিষয়ে কথা বলে, যিনি নিশ্চিত করে জানান, ভিডিওটিতে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ থাকা তার ভাইকে দেখা যাচ্ছে। কবীরের দাদা বলেন, মানসিক অসুস্থতার জন্য বর্তমানে কবীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এক মিনিটের ভাইরাল ওই ভিডিওতে কালো টি-শার্ট এবং গ্লাভস পরা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবককে রাস্তায় ঘুরতে থাকা ঘরছাড়া এক ব্যক্তিকে জোর করে আটকে রেখে তার জটা এবং দাড়ি কেটে দিতে দেখা যায়। পরে লোকটির গায়ে তাদের একটি পাত্র থেকে জল ঢালতেও দেখা যায়।
ভিডিওটি শেয়ার করে হিন্দিতে ক্যাপশন হিসাবে লেখা হয়, "বাংলাদেশে মুসলমানরা একজন সাধুর জটা কেটে তাকে মুসলমান বানিয়ে দিয়েছে…”।
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম প্রথমে গুগলে ভাইরাল ভিডিওটির কিফ্রেমের সার্চ করে দেখতে পায়, ভাইরাল ভিডিওটির এক দীর্ঘতর সংস্করণ বাংলাদেশি একজন ব্যবহারকারীর ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ৭ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে আপলোড করা হয়েছিল।
পোস্টটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
ভিডিওটির দীর্ঘতর সংস্করণটিতে একজন স্বেচ্ছাসেবককে ওই গৃহহীন ব্যক্তিকে শনাক্ত করে তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করার জন্য আবেদন করতে দেখা যায়।
এর থেকে ইঙ্গিত নিয়ে, বুম বাংলাদেশ ভিডিও নির্মাতা মাহবুব সরকারকে খুঁজে বের করে যিনি ১ নভেম্বর তার ফেসবুক পেজে ভিডিওটি পোস্ট করেন।
ভিডিওটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
মাহবুব সরকারের ইউটিউব চ্যানেল মাহবুব ক্রিয়েশন ৪-এ ২০২৪ সালের ২৬ অক্টোবর ভিডিওটি আপলোড করা হয় যেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের ওই ব্যক্তিকে আশ্বাস দিতে দেখা যায় যে তারা তার কোনও ক্ষতি করবে না।
বুম বাংলাদেশ ভিডিও নির্মাতা মাহবুব সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ভাইরাল সাম্প্রদায়িক দাবিকে নস্যাৎ করে স্পষ্ট করে জানান, ভিডিওতে থাকা ওই ব্যক্তি ছিলেন মুসলিম।
মাহবুব বুম বাংলাদেশকে বলেন, "আমরা রাস্তায় করুণ অবস্থায় পড়ে থাকা নিঃস্ব, অসহায় ও মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। আমরা এমন লোকদের তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে পুনরায় মিলিত করার চেষ্টা করি। ধর্ম নির্বিশেষেই আমরা এই কাজ করে থাকি।"
ভাইরাল ভিডিও সম্পর্কে মাহবুব বলেন, “ভিডিওটি ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকায় তোলা। সেসময় ভিডিওতে দেখতে পাওয়া এই ব্যক্তির অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তাকে পরিস্কার করার পর, আমরা তার পরিবারকে খুঁজে পেতে ফেসবুকে ভিডিওটি আপলোড করি। কয়েকদিন পরে আমরা তার পরিবারকে খুঁজে পাই এবং জানতে পারি, লোকটি একটি মুসলিম পরিবারের। ভিডিওটি নিয়ে যে সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার ছড়ান হচ্ছে, তার আমি তীব্র নিন্দা জানাই।”
বুম বাংলাদেশ ভাইরাল ভিডিওতে দেখা লোকটির বড় ভাই রবিউল হাসানের সঙ্গেও যোগাযোগ করে। হাসান আমাদের নিশ্চিত করে জানায়, ভিডিওতে থাকা ব্যক্তি হলেন তার ছোট ভাই রেজাউল কবীর। রবিউল হাসান আমাদের রেজাউলের পরিচয়পত্র এবং তার পুরনো ছবিও পাঠায়।
"ভিডিওতে দেখতে পাওয়া ব্যক্তি হল আমার ছোট ভাই রেজাউল কবীর। মানসিক অসুস্থতার কারণে সে গত সাত বছর ধরে নিখোঁজ ছিল, আমরা তাকে খুঁজে পাইনি", বলে জানান তিনি। হাসান বলেন, “সম্প্রতি আমরা জানতে পারি সে ঢাকার কেরানীগঞ্জে রয়েছে, কিন্তু আমরা সেখানে গিয়ে তাকে খুঁজে পাইনি।”
তিনি আরও জানান, “কয়েকদিন পর আমরা ফেনী হাসপাতাল থেকে খবর পাই, আমার ছোট ভাই এক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে এবং সেখানে তার চিকিৎসা চলছে। আমরা ফেনী হাসপাতাল থেকে তাকে আমাদের খুলনা সদরের বাড়িতে নিয়ে এসে একটি হাসপাতালে ভর্তি করি। তার শারীরিক অবস্থা গুরুতর হওয়ায় কারণে পরে তাকে ঢাকার মিরপুর ডেন্টাল ক্লিনিকে স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে সে সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছে।"
(অতিরিক্ত রিপোর্টিং: তৌসিফ আকবর, বুম বাংলাদেশ)