কংগ্রেসের ইস্তাহারে সম্পত্তি পুনর্বণ্টনের কথা? মোদীর দাবি বিভ্রান্তিকর
বিশেষজ্ঞদের মতে কংগ্রেসের ইস্তাহারে আইন পুনর্বিচার ও তথ্য অনুসন্ধান করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, সম্পত্তি পুনর্বণ্টনের নয়।
২১ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে রাজস্থানের বাঁশওয়ারায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস "শহুরে নকশালদের" দখলে চলে গেছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি দাবি করেন কংগ্রেসের ইস্তাহারে বলা হয়েছে ক্ষমতায় আসলে তারা সম্পদের সমানভাবে পুনর্বণ্টন করার উদ্দেশ্য নিয়ে মহিলাদের, বিশেষত উপজাতি মহিলাদের কাছে থাকা সোনাসহ দেশের সমস্ত সম্পদের মূল্যায়ন করবে।
তিনি বলেন, "আমাদের আদিবাসী বোনেদের রুপোর অলঙ্কার এবং সরকারি কর্মচারীদের সম্পত্তিসহ আমাদের মা-বোনেদের কাছে থাকা সোনার পরিমাণ মূল্যায়ন ও গণনা করা হবে। তারা বলেছে সম্পদগুলি সমানভাবে পুনর্বণ্টন করা হবে। এটা কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য? আপনাদের কষ্টার্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার অধিকার কি সরকারের রয়েছে?”
মোদী আরও বলেন সম্পত্তি সংগ্রহ করা হবে এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে ইঙ্গিত করে বলেন "যাদের বেশি সন্তান রয়েছে" তাদের মধ্যে সম্পত্তি বিতরণ করা হবে।
রাজস্থানে মোদীর এই নির্বাচনী ভাষণের পর কংগ্রেসের ইস্তাহারের লক্ষ্য "সম্পদ পুনর্বণ্টন" দাবি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর পোস্ট শেয়ার করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির আধিকারিক এক্স হ্যান্ডেল থেকে এবিষয়ে এক গ্রাফিক পোস্ট করে লেখা হয়, “কংগ্রেস আপনাদের সম্পত্তিতে ৫৫ শতাংশ ট্যাক্স নেওয়ার কথা বলছে এবং আপনার সম্পত্তি চলে যাবে কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্কের কাছে। -প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী”।
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্যও এমন দাবি করে তার আধিকারিক এক্স হ্যান্ডেল থেকে পোস্ট করেছেন।
আর্কাইভ দেখুন এখানে।
তথ্য যাচাই
কংগ্রেসের ইস্তাহারে কি মোদীর দাবি অনুযায়ী “সম্পত্তি পুনর্বণ্টন"-এর কথা বলা হয়েছে?
কংগ্রেসের ইস্তাহারের কোথাও "ওয়েলথ রিডিস্ট্রিবিউশন" শব্দটির উল্লেখ নেই। সেখানে ভারতীয়দের সম্পদ মূল্যায়ন বা উপজাতি মহিলাদের সোনা ও রুপোর গয়না বা সরকারি কর্মচারীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিষয়েও কোনও আলোচনা করা হয়নি। এছাড়াও, এই সম্পদগুলি সংখ্যালঘুদের, বিশেষতঃ মুসলমানদের মধ্যে পুনরায় বিতরণ করার কথাও সেখানে উল্লেখ নেই। উপরন্তু, ইস্তাহারের কোনও অংশে 'মুসলিম' শব্দটির ব্যবহারও করা হয়নি।
কী বলা হয়েছে কংগ্রেসের ইস্তাহারে?
সংখ্যালঘু এবং তাদের ক্ষমতায়নের বিষয়ে কংগ্রেসের ইস্তাহারে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উল্লেখ করা হয়েছে।
১. "আমরা নীতিতে উপযুক্ত পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্পদ ও আয়ের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের মোকাবিলা করব।"
ইস্তাহারে সম্পদ পুনর্বণ্টন সম্পর্কে কোনও অন্তর্নিহিত ইঙ্গিত রয়েছে কিনা তা বোঝার জন্য বুম রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষক এবং আইডিএফসি ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং ফেলো শঙ্কর আইয়ারের সাথে কথা বলে।
আইয়ার বুমকে বলেন ইস্তাহারে সম্পদ পুনর্বণ্টনের সরাসরি কোনও উল্লেখ নেই এবং এর অন্তর্নিহিত অর্থ অনুমানের বিষয়। তিনি আরও বলেন, "মানুষ কী হচ্ছের থেকে কি হতে পারে নিয়ে বেশি মন্তব্য করছে।"
তিনি বলেন ইস্তাহারে নির্দিষ্ট কোনও পুনর্বণ্টন পরিকল্পনার রূপরেখার পরিবর্তে নীতি মূল্যায়ন ও অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আইয়ার বলেন, "উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান সরকারের সামাজিক কর্মসূচি, যেমন বিনামূল্যে রেশন প্রকল্প, আয়ুষ্মান ভারত যোজনা ইত্যাদি দরিদ্রদের সহায়তার কাজ করে এবং চাইলে এটিকেও পুনরায় সম্পত্তি বিতরণ হিসাবে ধরা যেতে পারে।"
এছাড়াও, ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব দ্বারা ২০২৪ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে দেশের মোট আয়ের প্রায় ২২.৬% শীর্ষ ১% নাগরিকদের দখলে। একইভাবে এই একই গোষ্ঠীর কাছে দেশের প্রায় ৪০.১% সম্পদ রয়েছে। এই তথ্য দেশের মধ্যে যথেষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখায়। পুনর্বণ্টন নীতিগুলি কেবল বেশি বৈষম্যের দেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমাতে করতে সাহায্য করে।
২. “কংগ্রেস জাতি ও উপ-বর্ণ এবং তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা গণনা করার জন্য দেশব্যাপী সামাজিক-অর্থনৈতিক ও জাতিগত জনগণনা করবে। তথ্যের ভিত্তিতে, আমরা ইতিবাচক পদক্ষেপ নেব।”
ভারতের সর্বশেষ জনগণনা ২০১১ সালে হয়েছিল। ২০২১ সালের নির্ধারিত জনগণনাটি কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পিছিয়ে দেওয়া হয়। গত বছরও জনগণনা করা হয়নি, যা নিয়মিত জনগণনা চক্রের মধ্যে একটি ব্যবধান তৈরি করেছে।
৩. “কংগ্রেস সরকারি জমি এবং উদ্বৃত্ত জমি দরিদ্রদের মধ্যে ল্যান্ড সিলিং আইনের আওতায় বন্টন পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠা করবে।”
কংগ্রেসের ইস্তাহারে থাকা উপরোক্ত বিবৃতিতে সংখ্যালঘুদের পুনর্বণ্টন করার জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা জমি বাজেয়াপ্ত করার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
৪. "ভারতের পূর্ণ বিকাশকে বাস্তবায়িত করার জন্য সংখ্যালঘুদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। আমরা নিশ্চিত করব যে ব্যাঙ্কগুলি কোনও বৈষম্য ছাড়াই সংখ্যালঘুদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ দেয়।”
এমনকি এই বিবৃতিতেও ইস্তাহারে শুধুমাত্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলির জন্য আর্থিক সম্পদে সমান অধিকারের কথা বলা আছে।
মোদীর দাবি নিয়ে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
সর্বভারতীয় প্রফেশনাল কংগ্রেসের চেয়ারপার্সন এবং ইস্তাহার তৈরিতে যুক্ত প্রবীণ চক্রবর্তী সম্পদ পুনর্বণ্টন নিয়ে আলোচনা করার সময় ব্যাখ্যা করেন, বাজেট এবং সম্পদের বিস্তৃত কাঠামোর মধ্যে সম্পদ গণনা করা দরকার।
"ইস্তাহারের ৪৮ পাতার কোথাও বলা নেই যে আমরা কারও সম্পদ নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দেব। আমরা কারোর বাড়িতে ঢুকতে চাই না", জানান চক্রবর্তী।
দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি পূর্ব-প্রকাশিত প্রতিবেদনে হায়দ্রাবাদের টুকুগুড়ায় গাঁধীর নির্বাচনী বক্তৃতার কথা রিপোর্ট করা হয়। ওই প্রতিবেদনে গাঁধী সেই বক্তৃতায় কংগ্রেস পার্টি "ভারতের সম্পদ বিতরণের ঐতিহাসিক দায়িত্ব গ্রহণ করবে" বলে উল্লেখ করা হয়। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দ্য ইকোনমিক টাইমস এবং মানি কন্ট্রোলের মতো সংবাদমাধ্যমগুলি ভুল রিপোর্ট করে লেখে, "কংগ্রেসের রাহুল গাঁধী ভারতীয়দের সম্পদ পুনরায় বিতরণ করার জন্য একটি সার্ভের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন"। (আর্কাইভ এখানে)
কিন্তু গাঁধীর আসল বিবৃতির ৩১:২৮ মিনিটে শোনা যায়, “যখনই আমরা ক্ষমতায় নির্বাচিত হব, আমরা পুরো দেশে জাতি গণনা করব। পিছিয়ে পড়া জাতি, দলিত, আদিবাসী, সাধারণ দরিদ্র শ্রেণির মানুষ এবং সংখ্যালঘুরা জানতে পারবে যে এই দেশে তাদের ভাগ কত। এরপর আমরা একটি আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সমীক্ষা করব। ভারতের সম্পদ কার এবং কোন শ্রেণীর হাতে রয়েছে তা আমরা খুঁজে বের করব। এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের পর আমরা আমদের বৈপ্লবিক কাজ শুরু করব। আমরা আপনাদের আপনার অধিকার দেব, সেটা মিডিয়া, আমলাতন্ত্র বা দেশের যেকোনো প্রতিষ্ঠানই হোক না কেন, আমরা আপনাদের জন্য জায়গা করব এবং আপনাদের ভাগ দেব।"
চক্রবর্তী বলেন, "এটা বলা হাস্যকর যে আজকের ভারতে, যা আমরা একটি সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র বলে বিশ্বাস করি, সেখানে রাষ্ট্র বা সরকার এসে কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে অন্য কাউকে দিতে পারে...রাহুল গাঁধী যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা হল একটি দার্শনিক ধারণা। তিনি প্রশ্ন করছিলেন: আমাদের কি এমন একটি সমাজের আকাঙ্ক্ষা করা উচিত নয় যেখানে পরিচয়ের ভিত্তিতে পুরস্কার এবং সুবিধাগুলি প্রতিফলিত হয়?”
মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে মোদীর দাবি কতটা সত্যি?
বুম ১৯৯৮-২০২১ পর্যন্ত জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সার্ভের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। সেখানে দেখা যায় যে মুসলমানদের পাশাপাশি ভারতের অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রজনন হার বছরের পর বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। প্রজনন হার একজন মহিলার প্রজনন বছরগুলিতে জন্ম নেওয়া শিশুদের গড় সংখ্যা পরিমাপ করে। ২০১৯-২১ সালের তথ্য অনুসারে মুসলমানদের মধ্যে প্রজননের হার ২.৩৬ রেকর্ড করা হয়েছিল, যা প্রতিস্থাপন স্তরের কাছাকাছি।
প্রতি মহিলার প্রতিস্থাপন স্তরের প্রজননের হার প্রায় ২.১ শিশু, যা একটি জনসংখ্যা এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের মধ্যে নিজেকে প্রতিস্থাপন করে। যখন প্রজনন হার প্রতিস্থাপন স্তর বা তার কাছাকাছি থাকে, তখন তা বোঝায় যে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির পরিবর্তে স্থিতিশীল হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে, অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে উচ্চ প্রজনন হার থাকা সত্ত্বেও, সাম্প্রতিক প্রবণতা তাদের প্রজনন হার হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়, যা তাদের প্রতিস্থাপন স্তরের কাছাকাছি নিয়ে যায়।