নরেন্দ্র মোদী জামানায় মোবাইল ডেটার খরচ কমেছে? একটি তথ্য-যাচাই
নরেন্দ্র মোদী ঐতিহাসিকভাবে ঠিক বললেও এই দাম কমার নেপথ্যে রয়েছে জিও দামের লড়াই ও ব্যাপক ফোর-জি প্রযুক্তির ব্যবহার।
সম্প্রতি গুজরাতে (Gujarat) এক নির্বাচনী জনসভায় (Elections 2022) বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) দাবি করেন, তাঁর সরকার মোবাইল ডেটা (cheap date) ব্যবহারের খরচ বিপুলভাবে কমিয়ে দিয়েছে। রাজ্য বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনের পূর্বাহ্নে গুজরাতের ভালসাদ জেলার জনসভায় তিনি এই দাবি করেছেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি রাজ্যে তাঁর অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধেও সরব হন। গুজরাতিতে বলা তাঁর বক্তৃতার অংশ নীচে দেওয়া হল।
গুজরাতি ভাষায় দেওয়া বক্তৃতার অনুবাদ হল,
"কংগ্রেস যখন কেন্দ্রীয় সরকার চালাতো, তখন ১ গিগাবাইট মোবাইল ডেটার খরচ পড়ত ৩০০ টাকা, আর এখন আমার সরকারের আমলে সেটা ১০ টাকায় নেমে গেছে। এতে কি আপনাদের সাশ্রয় হয়নি?
"যদি আগের কংগ্রেস সরকারই থাকত, তাহলে আপনাদের মোবাইলের বিল দিতে হতো ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা, আর এখন আপনাদের মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বিল পড়ে।"
মোদীর উদ্ধৃত পরিসংখ্যান তথ্য হিসাবে সঠিক, কিন্তু তিনি ২০১৬ সালে মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স জিও-র সূচনা এবং তারপরে শুরু হওয়া দামের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেননি। অথচ সেই কারণেই জিবি-প্রতি মোবাইল ডেটার দাম হু-হু করে পড়তে থাকে।
২০১৪ সালে একজন গ্রাহককে জিবি-প্রতি ডেটার জন্য ২৪২ টাকা ৯৭ পয়সা খরচ করতে হতো, যাকে মোদী ৩০০ টাকা বলে বর্ণনা করেছেন। ২০১৫ সালে এই খরচ ২২৬ টাকা ৩০ পয়সায় নেমে আসে। ২০১৬ সালে রিলায়েন্স জিও-র অনুপ্রবেশের পর তা নেমে আসে ৭৫ টাকা ৫৭ পয়সা, ২০১৭ সালে ১৯ টাকা ৩৫ পয়সা এবং ২০১৮ সালে ১১ টাকা ৭০ পয়সা।
আরও পড়ুন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি সহ কাতার বিশ্বকাপের স্মারক ব্যাগের ছবি সম্পাদিত
আরও সম্প্রতি গ্রাহকের মাসিক গড় ডেটা খরচ ধরলে ২০২১-এর মার্চ মাসে তা কমে দাঁড়ায় ১০ টাকা ৭৭ পয়সায়, জুন মাসে ৯ টাকা ৮০ পয়সায়, সেপ্টেম্বরে ৯ টাকা ৫৩ পয়সায়, ডিসেম্বরে ৯ টাকা ৯১ পয়সায় এবং ২০২২-এর মার্চে ১০ টাকা ৪৭ পয়সায়। তালিকাটি এখানে দেখতে পারেন। এই পরিসংখ্যান মোদীর দাবিকেই সমর্থন করে, যিনি জিবি-প্রতি ১০ টাকা খরচের কথা বলেছেন।
তবে মোদীর এই দাবি সংখ্যাতত্ত্বের দিক দিয়ে সঠিক হলেও মোবাইল ডেটায় এই মূল্যহ্রাস সম্ভব বয়েছিল ২০১৬ সালে রিলায়েন্স জিও-র সূচনা এবং ফোর-জি পরিষেবার প্রবর্তনের ফলে, যার স্পেকট্রাম মোবাইল সংস্থাগুলি আরও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে। রিলায়েন্স জিও আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৬ সালে সূচিত হলেও টেলিকম কোম্পানি হিসাবে তার পথ চলা শুরু হয় ২০১০ সাল থেকেই।
রিলায়েন্স জিও-র শুরু করা দর-হ্রাসের লড়াইয়ের ফলে আজ ভারতে মোবাইল ডেটা ব্যবহারের খরচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। একটি সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, ২০২২ সালে ইজরায়েলে জিবি-প্রতি মোবাইল ডেটা ব্যবহারের খরচ সবচেয়ে কম (দেখুন এখানে), যদিও তার আগে পর্যন্ত এই স্থানটি ছিল ভারতের (দেখুন এখানে)। তাঁর বক্তৃতার এক জায়গায় তো মোদী এমনও দাবি করে বসেছেন যে, বিশ্বের মধ্যে ভারতেই মোবাইল ডেটা ব্যবহারের খরচ সবচেয়ে কম।
দামের লড়াই
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে রিলায়েন্স জিও যখন তার পরিষেবা চালু করে, তখন একই সঙ্গে তারা ফোর-জি পরিষেবা এবং ভয়েস পরিষেবাও চালু করে, যা আগে কেউ করেনি। তার মধ্যে ছিল শুল্ক-মুক্ত কল, সারা ভারতের ক্ষেত্রে বিনামূল্যে-রোমিং এবং শুধু জিবি-প্রতি গড়ে ৫০ টাকার চার্জ। এ ছাড়াও আরও নানা রকম সুবিধাযুক্ত দৈনিক প্যাকেজ তারা গ্রাহকদের জন্য দেয়।
সে সময় বাজারে ভোডাফোন, আইডিয়া, ভারতী এয়ারটেল, এয়ারসেল এবং টেলেনর ছাড়াও সরকারের বিএসএনএল, এমটিএনএল এবং অনিল আম্বানির রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স হাজির রয়েছে।
দামের লড়াই মানে হচ্ছে, সব সংস্থাই দাম কমিয়ে বেশি-বেশি করে গ্রাহক পাওয়ার চেষ্টা চালায়l জিও এই লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ-এর বিপুল সম্পদের জোরে। কিন্তু অন্য অনেক সংস্থার সে জোর না থাকায় তারা বাজার থেকে হারিয়ে যায়।
এর পরিণাম হয় দ্বিমুখী। এক, আঞ্চলিক প্রভাব সম্বলিত অপেক্ষাকৃত ছোট সংস্থাগুলো একজোট হয়। ভোডাফোন এবং আইডিয়া যেমন ২০১৮ সালে একজোট হয়ে ৪০ কোটি উপভোক্তার এক বিশাল গ্রাহক-ভিত্তি গড়ে তোলে, যাদের অনেককেই তারা পরবর্তীতে হারাবে। ভারতী এয়ারটেল এই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে যেতে পারে তার আর্থিক স্বাস্থ্য ভাল থাকায় এবং টেলিনর-এর ভারতীয় গ্রাহক-ভিত্তি কিনে নেওয়ার ফলে। এয়ারসেল এবং রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স (অনিল আম্বানির) দেউলিয়া হয়ে যায়।
সস্তায় ফোর-জি
মোবাইল ডেটার দর হ্রাসের আর একটা কারণ হল ফোর-জি পরিষেবার নিজস্ব স্পেকট্রামের দক্ষ ব্যবহার, যা পরিষেবার গতিকে অনেক বাড়িয়ে দেয়।
একটি রিপোর্টে প্রকাশ, রাষ্ট্রসংঘের শাখা আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়নের মতে বেতার টেলিফোন পরিষেবার প্রতিটি প্রজন্মই (টু-জি, থ্রি-জি, ফোর-জি)আগের তুলনায় দ্রুততর এবং সাশ্রয়ী পরিষেবা দিতে সমর্থ।
তাই জিও বাজারে নামার আগে থ্রি-জি পরিষেবা পেতে গ্রাহকরা যে খরচ করত, ফোর-জি-তে সেই খরচ অনেকটাই কমে যায়। ১ জিবি ডেটার জন্য আট বছর আগে যেখানে ৩০০ টাকা খরচ করতে হত, এখন সেখানে মাত্র ১০ টাকা খরচ হয়।
উপরে উদ্ধৃত রিপোর্টেই দেখা গেছে, বিদেশের বাজারে, বিশেষত মার্কিন মুলুকে কিন্তু ফোর-জি প্রযুক্তির প্রবর্তনের ব্যয়হ্রাসের সুবিধা কোম্পানিগুলো উপভোক্তাদের কাছে স্থানান্তরিত করেনি, মুনাফা টেলিফোন সংস্থাগুলোরই পকেটে গেছে। ভারতে জিও তা করেনি।
রিপোর্টটিতে এটাও তুলে ধরা হয়েছে যে, কোনও কোনও টেলিফোন কোম্পানি থ্রি-জি-র তুলনায় খরচ কম হলেও ফোর-জি-র পরিষেবার জন্য উপভোক্তাদের কাছ থেকে তুলনায় বেশি টাকা নিয়েছে (যেমন রিপাবলিক ওয়্যারলেস কোম্পানির থ্রি-জির ২৫ ডলারের প্ল্যানের দাম ফোর-জি-তে বাড়িয়ে ৪০ ডলার করা হয়েছে)। তা ছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টেলিকম কোম্পানিগুলি পরস্পরের গ্রাহক-ভিত্তিতে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে নিজের গ্রাহক-ভিত্তি সম্প্রসারিত করার অপপ্রয়াস করেনি। উপভোক্তারাও বাজারে বহু টেলিকম সংস্থার অস্তিত্ব ও প্রতিযোগিতাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ভুয়ো খবর: অম্বেদকারের ছবি সহ ১০০ ডলারের নোট ছাপল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র