ভুয়ো সাম্প্রদায়িক দাবিতে ছড়াল ২০১৯ সালে মুর্শিদাবাদে খুনের ঘটনা
বুম যাচাই করে দেখে খুনের এই ঘটনার পিছনে সাম্প্রদায়িক কোনও কারণ ছিল না।



২০১৯ সালে একই পরিবারের তিনজনকে খুনের ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি এক ভুয়ো সাম্প্রদায়িক দাবিতে (Communal Claim) বলা হয়েছে, হিন্দু (Hindu) বাঙালি হওয়ার কারণে ধর্মগত বিদ্বেষে ভিন্ন ধর্মের কিছু দুষ্কৃতী এই হত্যাকান্ডটি করে।
বুম যাচাই করে দেখে, খুনের সেই ঘটনার পিছনে কোনও সাম্প্রদায়িক কারণ ছিল না। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিতে অপরাধী ছিলেন একজন হিন্দু যাকে পরে গ্রেপ্তার এবং দোষী সাব্যস্তও করা হয়েছিল।
ভাইরাল সেই ফেসবুক পোস্টে মা, বাবা এবং সন্তানের এক ছবিসহ দাবি করা হয়, হিন্দু হওয়ার কারণে ২০১৯ সালে মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে কিছু 'বিশেষ সম্প্রদায়ের জেহাদি' প্রকাশ্য দিবালোকে বেলা ১১ টায় বাড়িতে ঢুকে নৃশংসভাবে একটা গোটা পরিবারকে গলা কেটে হত্যা করে।
ছবিটির ক্যাপশন হিসেবে লেখা হয়, "মনে আছে এনাদের...? সাল: ২০১৯, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ। RSS সমর্থক এবং একটি বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষক, বন্ধু প্রকাশ পাল (৩৫), স্ত্রী - বিউটি মন্ডল পাল (৩০), পুত্র - অঙ্গন বন্ধু পাল (৬)। কিছু দুষ্কৃতী (ভিন্নমতে বিশেষ সম্প্রদায়ের জেহাদি) প্রকাশ্য দিবালোকে বেলা ১১ টায় বাড়ি ঢুকে একটা গোটা পরিবারকে নৃ'শংসভাবে গ লা কে টে হ ত্যা করে যায়, তখন স্ত্রী - বিউটি পাল ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শেষ হয়ে যায় একটা গোটা পরিবার। আপনার জানা না থাকলে, অবিশ্বাস্য লাগলে, গুগলে গিয়ে সার্চ করুন, সম্পূর্ণ সংবাদ পেয়ে যাবেন। আর যারা এই ঘটনা জানতেন, তাদের জন্য - হিন্দু বাঙালিদের স্মৃতিশক্তি খুব দূর্বল, পুরানো কথা মনে রাখতে পারে না। তাই একটু মনে করিয়ে দেওয়ার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা..."।
পোস্টটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে।
সাম্প্রদায়িক মোড়কে ছড়াল পুরনো ঘটনা
২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জের স্কুল শিক্ষক বন্ধু প্রকাশ পাল (৩৫), তার আট মাসের গর্ভবতী স্ত্রী বিউটি পাল (৩০) এবং তাদের ছয় বছরের ছেলেকে তাদের বাড়িতেই নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মঙ্গলবার বিকেলে ওই দম্পতি এবং তাদের ছেলের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তিনজনের শরীরেই ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেলেও শিশুটিকে তোয়ালে দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার কথা এক পুলিশ কর্মকর্তাকে উল্লেখ করে জানায় হিন্দুস্তান টাইমস।
এর আগে তিনজন খুনের এই ঘটনা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা হিসেবে ভাইরাল হলে ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর বুম বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল।
সেসময় এই পরিবারের একই ছবি এবং তাদের হত্যার ঘটনাস্থলের কিছু ভয়াবহ ছবি শেয়ার করা পোস্টে দাবি করা হয়েছিল, পরিবারটিকে হত্যা করার কারণ তার বাবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে (RSS) যোগদান করেছিলেন।
বুম দক্ষিণবঙ্গের আরএসএস-এর প্রচার প্রধান বিপ্লব রায়ের সাথেও এব্যাপারে যোগাযোগ করে। বিপ্লব আমাদের বলেন, "পাল সম্প্রতি আরএসএসে যোগ দিয়েছিল। তবে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে সংঘে যোগদান করার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের সাথে প্রাণ হারানোর জন্য তিনি খুব কনিষ্ঠ ছিলেন। আমরা এই হত্যার পিছনে কোনও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য উড়িয়ে দিচ্ছি না।"
বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাখার প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষও কোনও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অস্বীকার করে বলেন "মাত্র কয়েকটি সভায় যোগদানকারী একজন কর্মীকে হত্যা করার সম্ভাবনা কম।"
সন্দেহভাজনকে খুঁজে পাওয়া যায়, দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়
ইন্ডিয়া টুডের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশ ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবরের মধ্যে সন্দেহভাজন উৎপল বেহরাকে গ্রেপ্তার করেছিল, যিনি পরে অপরাধ স্বীকার করেছিলেন এবং প্রতিবেদনটি পরিবারের একই ছবি প্রকাশ করেছিল।
দ্য হিন্দু, ডেকান হেরাল্ড এবং দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুসারে, বেহরা পালের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিল এবং পরে পালের পরিচালিত একটি সঞ্চয় প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। তবে, পাল বেহরাকে অর্থ প্রদানের রসিদ দিতে অস্বীকার করেন, যার ফলে উভয়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। প্রতিবেদনে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট মুকেশ কুমারের উদ্ধৃতি রয়েছে, যেখানে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে কিছু সময় ধরে ঝামেলা চলার পর অবশেষে বেহরা খুন করতে বাধ্য হয়।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ২০২৩ সালের ২৫ অগাস্টের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, খুনের জন্য বেহরা দোষী সাব্যস্ত হন এবং বহরমপুরের একটি ফাস্ট-ট্র্যাক আদালত তাকে মৃত্যদন্ডের সাজা দেয়।