স্বপ্নদ্বীপ মৃত্যুকাণ্ডে ধৃত বলে বাংলা সংবাদমাধ্যম দেখাল অন্য পড়ুয়াদের
বুম যাচাই করে দেখে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্নদ্বীপের রহস্য মৃত্যুকাণ্ডে একই নামের অন্য পড়ুয়াদের পুলিশ তদন্তের জন্য আটক করে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (Jadavpur University) বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া স্বপ্নদ্বীপ কুন্ডুর হস্টেলের বারান্দা থেকে পড়ে রহস্যমৃত্যুর ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ায় রাজ্যজুড়ে, তীব্র থেকে তীব্রতর হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হওয়া র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। গোটা ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ গ্রেফতার করে যাদবপুরের একাধিক পড়ুয়া এবং প্রাক্তনীকে।
এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমে ধৃত হিসেবে উঠে আসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পড়ুয়া অঙ্কন সরকার ও মহম্মদ আরিফের নাম। স্বপ্নদ্বীপের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ গ্রেফতার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের দুই পড়ুয়া মহম্মদ আরিফ ও অঙ্কন সরকারকে।
সেই খবরকে কেন্দ্র করে নিউজ ১৮ বাংলা, ২৪ ঘন্টা, আজতক বাংলা, আজকালের মতো বেশ কয়েকটি প্রথম সারির বাংলা সংবাদমাধ্যম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পড়ুয়ার ছবি স্বপ্নদ্বীপ মৃত্যুকাণ্ডে ধৃত বলে সম্প্রচার করে। ছবি দুটি সম্প্রচার করে তারা দাবি করে স্বপ্নদ্বীপের মৃত্যুর সাথে জড়িত থাকার ঘটনায় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছে।
বুম দেখে বাংলা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত ওই দুই ছাত্রকে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া স্বপ্নদ্বীপ কুন্ডুর মৃত্যুর ঘটনায় আটক করেনি। নামের মিল থাকায় ওই ছাত্রদের ছবি যাচাই না করেই সম্প্রচার করে তারা।
আজতক বাংলা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র অঙ্কন সরকারের ছবি ব্যবহার করে লেখে, "যাদবপুরের ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় বুধবার, ১৬ অগস্ট নতুন করে আরও ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরমধ্যে একজনের নাম অঙ্কন সরকার। অঙ্কন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের থার্ড ইয়ারের ছাত্র। অঙ্কন সরকারের বাড়ি নারায়ণপুর থানার কাদিহাটি এলাকার। বুধবার গ্রেপ্তারির খবর চাউর হতেই অঙ্কনের বাড়িতে ভিড় জমান আত্মীয় পরিজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশীরা। অঙ্কনের মা জানান, তাঁর ছেলে নির্দোষ। ফাঁসানো হচ্ছে। তাঁর ছেলে ট্যাক্সি করে যাদবপুরের ওই ছাত্রকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। ছেলের সঙ্গে রোজই কথা হয়।"
তাদের সেই প্রতিবেদনের আর্কাইভ দেখতে ক্লিক করুন এখানে।
একই দাবি করে চতুর্থ বর্ষের পড়ুয়া অঙ্কনের ছবি সম্প্রচার করে নিউজ ১৮ বাংলা। তাদের সেই প্রতিবেদন দেখতে ক্লিক করুন এখানে।
অন্যদিকে জি ২৪ ঘন্টা ও আজকাল যাদবপুরের এনার্জি সাইন্স ডিপার্টমেন্টের প্রথম বিভাগের ছাত্র মহম্মদ আরিফের ছবি সম্প্রচার করে তাকে মৃত্যুকাণ্ডে ধৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের জম্মুর বাসিন্দা ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আরিফ বলে দাবি করে।
আজকালের প্রকাশিত প্রতিবেদনের আর্কাইভ এখানে দেখা যাবে।
নাম বিভ্রাট
বুম বাংলা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত যাদবপুরের ওই দুই পড়ুয়ার সাথে গোটা বিষয়টি নিয়ে কথা বলে। নামের মিল থাকায় এভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে বলে ওই দুই ছাত্রই ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করে।
চতুর্থ বর্ষের ছাত্র অঙ্কন বুমকে বলে, "আমি অঙ্কন সরকার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র; এখন ভাবুন হঠাৎ করে নিউজ ১৮ বাংলা, জি ২৪ ঘন্টা, রিপাবলিক বাংলা এবং কলকাতা টিভিতে আমার মুখ দেখা যাচ্ছে আর তারা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের ঘটনার সাথে জড়িত এক গ্রেপ্তার নিয়ে আলোচনা করছে। তারা আমার ছবি এমনভাবে সম্প্রচার করে যেন আমিই জড়িত। বিশ্বাস করতে পারেন?"
অঙ্কন জানায়, "এখানে আমার নামের আরেকজন অঙ্কন সরকার রয়েছে। কিন্তু মিল সেখানেই শেষ। সে একজন ভিন্ন শিক্ষাবর্ষের ছাত্র এবং হস্টেলে থাকে, যা আমি একদমই নই।"
এছাড়াও অঙ্কন রিপাবলিক বাংলায় ও জি২৪ ঘন্টায় প্রচারিত বিষয়টি নিয়ে আমাদের কিছু ছবি পাঠায়। সে বলে, "খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি এই ঘটনাকে অগ্রাহ্য করতে পারিনি। আমি আমার অধ্যাপক, সহপাঠীদের এমনকি সেই সংবাদমাধ্যমগুলোর সাথে কথা বলি। আমি সকলকে জানাতে চেয়েছিলাম র্যাগিংয়ের সেই ঘটনার সাথে আমার একেবারেই কোনও সম্পর্ক নেই। শিক্ষাগত বিষয়ে যে হয়রানি এবং ক্ষতির সম্মুখীন আমি হয়েছি তা আর আলাদা করে উল্লেখ করছি না।"
অঙ্কনের ফেসবুকের সেই পোস্ট নিচে দেখতে পাওয়া যাবে।
এছাড়াও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চতুর্থ বর্ষের সেই ছাত্র বিষয়টি নিয়ে সে পুলিশের দ্বারস্থ হয় বলে আমাদের জানায়। অঙ্কন বলে, "আমি পরে পুলিশের কাছে যাই। মামলা নথিভুক্ত না করলেও পুলিশের তরফে আমাকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয় এবং তারা গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করে আমার প্রাপ্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে।"
বুম যাদবপুরের এনার্জি সাইন্স ডিপার্টমেন্টের প্রথম বিভাগের ছাত্র মহম্মদ আরিফের সাথেও পুরো ঘটনায় তার প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করে। আরিফ নিউজ ১৮ বাংলার এই সম্প্রচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে লেখে, চ্যানেলের তরফে সরাসরি সম্প্রচার করে ক্ষমা না চাওয়া হলে সে নিউজ ১৮ বাংলার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে বাধ্য হবে।
এছাড়াও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ওই ছাত্র আমাদের জানায় সে জি২৪ ঘন্টাকেও এবিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন করলে চ্যানেলের তরফে তার কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়।
আরিফ বলে, "স্বপনদীপকে আমি চিনতাম না। ওর মৃত্যুর পর সংবাদমাধ্যমে দেখে ঘটনাটির বিষয়ে জানতে পারি। আমার বাড়ি মালদায়। আমি এনার্জি সাইন্স ডিপার্টমেন্টের প্রথম বিভাগের ছাত্র। পুলিশও আমাকে এবিষয়ে কোনও যোগাযোগ করেনি। পুরো ঘটনা নাম বিভ্রাটের কারণে হয়।"
বুম এই প্রতিবেদন লেখার সময় জি২৪ ঘন্টা ও রিপাবলিক বাংলার তরফে সম্প্রচারিত উক্ত রিপোর্টগুলি মুছে ফেলা হয়েছে বলে লক্ষ্য করে।