বাংলাদেশ: বন্যা ত্রাণের বিনিময় খোলা হয়নি হিন্দু শিশুর মালা
বুম দেখে ভাইরাল ভিডিওতে যে শিশুটির থেকে মালা খুলে নেওয়া হয় সে ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং এক মৌলবি তার তাবিজটি খুলে নেয় ।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো সাম্প্রদায়িক (communal) দাবিসহ ভাইরাল একটি ভিডিওতে দেখা যায় এক মৌলবি একটি শিশুর গলা থেকে একটি মালা দাঁত দিয়ে কেটে ছিঁড়ে ফেলছেন এবং তারপর শিশুটির হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিচ্ছেন।
ভাইরাল এই ভিডিওটি শেয়ার করে সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একাংশ দাবি করেছেন বন্যা বিধ্বস্ত বাংলাদেশের নোয়াখালীতে একজন মুসলিম ত্রাণদাতা ত্রাণের বিনিময় হিন্দু শিশুর থেকে তার ধর্মীয় মালা খুলে নিয়েছেন।
বুম যাচাই করে দেখে দাবিটি ভুয়ো। বুম বাংলাদেশ ভাইরাল ভিডিওতে দৃশ্যমান বাচ্চাটির সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে জানায় তার নাম সোহেল এবং সে ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
এবছরের ২১ অগাস্ট ভারী বৃষ্টির ফলে উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। বাংলাদেশে নোয়াখালী, ফেনী সহ এগারোটি জেলা বন্যার কবলে। এছাড়াও, ভারী বর্ষণের কারণে ভারতের ত্রিপুরাতেও ২১ এবং ২২ অগাস্ট বন্যা হয়। বন্যায় দুই দেশেই বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভাইরাল ভিডিও ক্লিপে এক জলমগ্ন এলাকায় এক মৌলবিকে শিশুটির গলা থেকে একটি মালা দাঁত দিয়ে কেটে খুলে নিতে দেখা যায়। এরপর, বাচ্চাটির হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেওয়া হয়। শিশুটি যখন বলে তার বাবা-মা মালার কথা জিজ্ঞেস করবে তখন তিনি বলেন সেটি পরা ইসলাম ধর্মবিরুদ্ধ। ভিডিও ক্লিপটিতে "নোয়াখালী ত্রাণসামগ্রী বিতরণ সাথে ছেলেকে শিরক মুক্ত করা হল" লেখাটি দেখা যায়।
এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভিডিওটি শেয়ার করে ক্যাপশন হিসাবে লিখেছেন, "বাংলাদেশর একজন ত্রান দাতা এক হিন্দু শিশুকে ত্রান দিয়েছেন এবং বিনিময়ে তার মালা কেটে ফেলে দিলেন। শিশুটি যখন মালা ফেরত চাইলো,তিনি তাকে ত্রান নিয়ে চলে যেতে বললেন। এবং মালা নিয়ে চিন্তা না করতে বললেন। নোয়াখালি ত্রান সামগ্রী বিতরনের সাথে ছেলেকে শিরক মুক্ত করা হলো।এ রকম করার দরকার ছিল কি?"
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
একই দাবিসহ ভিডিওটি হোয়াটস্যাপ ও এক্সেও ভাইরাল হয়েছে।
তথ্য যাচাই
বুম বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় যে ভিডিওর নাবালক সোহেল নামক এক মুসলিম শিশু এবং হিন্দু নয়। বাংলাদেশের একটি স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়াশুনা করা ছেলেটি একটি তাবিজ পরেছিল, হিন্দুদের পরিহিত তুলসী মালা নয় যা ভাইরাল পোস্টগুলিতে দাবি করা হয়।
ভিডিওর কিফ্রেমের রিভার্স ইমেজ সার্চ আমাদের তাওহীদ একাডেমি এন্ড ইসলামিক সেন্টার নামক একটি ফেসবুক পেজে নিয়ে যায়। আমরা দেখি ২৭ অগাস্ট পেজটির তরফ ভাইরাল ক্লিপের অনুরূপ দৃশ্যসহ একটি ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়, "আলহামদুলিল্লাহ, নোয়াখালীর বন্যার্তদের মাঝে ২০০+ পরিবারকে ত্রান সামগ্রী বিতরন তাওহীদ একাডেমি এন্ড ইসলামিক সেন্টার এর পক্ষ থেকে।"
২ সেপ্টেম্বর, ওই ফেসবুক পেজে আরও একটি ভিডিও পোস্ট করে নাবালকের হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার দাবিকে নস্যাৎ করা হয়। ভিডিওর উপরে লেখা দেখা যায়, "সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ছেলেটির মুখে শুনুন ছেলেটি হিন্দু নাকি মুসলিম। গুজবকে সবাই প্রতিহত করুন।"
ভিডিওতে ছেলেটি নিজেকে সোহেল বলে পরিচয় দিয়ে বলে সে একটি মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। সোহেল আরও জানায় তার বাবার নাম আবদুল হক এবং মায়ের নাম রোজিনা।সে তার ধর্মকে ইসলাম হিসাবেও চিহ্নিত করে ও কলিমা পাঠ করে শোনায়।
বুম বাংলাদেশ এরপর তাওহিদ একাডেমি ও ইসলামিক সেন্টারের অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি বুম বাংলাদেশকে নিশ্চিত করে জানান তারা বন্যা বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে অনুমতি নিয়ে তাবিজও কাটে। তিনি বুম বাংলাদেশকে আরও জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে হিন্দু ধর্মের কারও মালা কাটা হয়নি।
ভিডিওতে জামিয়া দারুত তৌহিদের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুল মালেক মিয়াজিকে তাবিজটি কাটতে দেখা যায়। তিনি বুম বাংলাদেশকে বলেন, ছেলেটি বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার চর আলগি গ্রামের বাসিন্দা। বুম বাংলাদেশকে তিনি বলেন, "ইসলামে যেহেতু তাবিজ ব্যবহার নিষিদ্ধ, তাই আমরা বন্যা ত্রাণ বিতরণ অভিযানের সময় সেগুলি কেটে ফেলার জন্য একটি অভিযান পরিচালনা করেছি।"
গত মাসে বাংলাদেশের এগারোটি জেলায় বন্যায় ৫৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন।স্থানীয় সংবাদমাধ্যম মারফত জানা যায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিবৃতি অনুযায়ী, বন্যায় ৫৪.৫৭ লক্ষেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ৭০ লক্ষ পরিবার এখনও আটকে আছে।
(অতিরিক্ত রিপোর্টিং: তৌসিফ আকবর)