বিভ্রান্তিকর দাবিতে ছড়াল ভারতের বিভিন্ন বছরের জিডিপির তুলনার গ্রাফিক
তুলনাটি ২০১৬ সালে ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপের সূচককে ২০২২ সালে ভারতের অর্থনৈতিক বর্তমান দামের তথ্যে জরিপ করা হয়েছে।
ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে দুটি সংবাদ শিরোনামের ছবি দিয়ে তুলনা করা হয়েছে। ওই ছবিতে দেখাতে চাওয়া হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী (Prime Minister) নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) তাঁর বক্তৃতায় ২০১৪ সালের সঙ্গে ২০২২ সালের ভারতীয় অর্থনীতির (Indian Economy) যে তুলনা করেছেন, যা বিভ্রান্তিকর।
এই ছবিতে দুটি স্ন্যাপশটের তুলনা করা হয়েছে। প্রথমটিতে মোদীকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২২ সালে ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি হয়ে উঠেছে, যেখানে ২০১৪ সালে তা দশম স্থানে ছিল। দ্বিতীয় স্ন্যাপশটটিকে প্রথমটির বক্তব্যকে নাকচ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। সে ছবিটিতে দ্য হিন্দু পত্রিকার একটি সংবাদ শিরোনাম তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০১১ সালে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতি ছিল।
পরিসংখ্যান বলছে যে, অর্থনীতির আয়তন পরিমাপের দুটি ভিন্ন মাপকাঠি ব্যবহার করে পাওয়া ফলের ভিত্তিতে ওই দুটি শিরোনাম লেখা হয়েছিল। দুটি পরিসংখ্যানের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।
মোদী আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের দেওয়া ২০২২ সালের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে চলতি মূল্যস্তরের (Nominal Prices) নিরিখে হিসাব করা মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) (Gross Domestic Product GDP), নিরিখে ভারত বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। দ্বিতীয় স্ন্যাপশটটি দ্য হিন্দু সংবাদপত্রের ২০১৬ সালের সংবাদ শিরোনাম থেকে নেওয়া হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কম্প্যারিজন প্রোগ্রামের (আইসিপি) দেওয়া তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান ব্যবহার করে ক্রয়ক্ষমতার সাম্যের (Purchasing Power Parity) নিরিখে বিভিন্ন দেশের জিডিপির পরিমাপের মধ্যে তুলনা করা হয়ে থাকে।
বুম ছবিটি হেল্পলাইন নাম্বারে (৭৭০০৯০৬৫৮৮) পায় এবং নীচে ছবিটি দেখা যাবে।
আরও পড়ুন: ইন্ডিয়ান আইডলের মঞ্চে আজানের দৃশ্য দাবিতে ছড়াল সম্পাদিত ভিডিও
তথ্য যাচাই
বুম নিশ্চিত ভাবে জানতে পারে যে, দুটি ছবিতে যে তথ্য দেখা যাচ্ছে সেগুলি আসলে আলাদা বছরের, ভিন্ন তথ্যের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে এবং তাতে জিডিপি হিসাবের দুটি পৃথক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
ক্রমসংখ্যার এই ফারাকের পিছনে কারণ হল দুই ক্ষেত্রে অর্থনীতির আয়তন পরিমাপের জন্য দুটি আলাদা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। ভাইরাল ছবিটিতে যে দুটি সংবাদ শিরোনাম দেখা যাচ্ছে, সেগুলির মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।
প্রথম পদ্ধতি: চলতি মূল্যস্তরের নিরিখে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন
নরেন্দ্র মোদী যখন বলেন যে, ভারত ২০১৪ সালের বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতি ছিল এবং ২০২২ সালে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়েছে, তখন তিনি চলতি মূল্যস্তরের নিরিখে জিডিপির হিসাবের কথা বলছেন। এই সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক নামক প্রকাশনার অক্টোবর ২০২২-এর সংশোধিত হিসাবে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে ভারত বিশ্বে এই অবস্থানেই রয়েছে।
একটি নির্দিষ্ট সময়কালে কোনও দেশের ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে যে পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদিত হয়, অর্থমূল্যে তাকেই জিডিপি বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বলা হয়ে থাকে। চলতি মূল্যস্তরের নিরিখে জিডিপি হল বর্তমান বাজার দরে অর্থনীতিতে উৎপন্ন পণ্য ও পরিষেবার মূল্য।
এই হিসাবটি কোনও দেশের নিজস্ব মুদ্রাতেও হতে পারে, আবার আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের মতো কোনও বৈশ্বিক সংগঠন কোনও একটি নির্দিষ্ট বিনিময় মূল্যে এই অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাপটিকে একটি নির্দিষ্ট মুদ্রায় (সচরাচর ডলারে) প্রকাশ করতে পারে।
এই পদ্ধতিতে হিসাব করে দেখা যাচ্ছে যে, ২০২২ সালে ভারতীয় অর্থনীতি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম, তার আয়তন ৩.৪৬ লক্ষ কোটি ডলার। ভারতের আগে রয়েছে আমেরিকা (২৫ লক্ষ কোটি ডলার), চিন (২০.২৫ লক্ষ কোটি ডলার), জাপান (৪.৩ লক্ষ কোটি ডলার) এবং জার্মানি (৪.০৩ লক্ষ কোটি ডলার)।
এ বছরেরই আগের কিছু আনুমান অনুসারে এবং বর্তমান তথ্য অনুসারে, ভারত ইংল্যান্ডকে টপকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা হয়েছে। ইংল্যান্ড এখন ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে, তার জিডিপি ৩.২ লক্ষ কোটি ডলার।
এই একই পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৪ সালে ভারতীয় অর্থনীতির জিডিপির মাপ ছিল ২.০৩৯ লক্ষ কোটি ডলার এবং তা বিশ্বের দশম স্থানে ছিল। ভারতের আগে ছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, চিন, জাপান, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ব্রাজিল, ইটালি ও রাশিয়া।
এই পরিসংখ্যান ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন এখানে। যেখানে ১৯৮০ সাল থেকে চলতি মূল্যস্তরে জিডিপির হিসাব রয়েছে।
দ্বিতীয় পদ্ধতি: ক্রয়ক্ষমতার সাম্যের (পিপিপি) (Purchasing Power Parity) নিরিখে জিডিপি
দ্য হিন্দুর শিরোনামে যে তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে তা ২০১৬ সালের এবং এই প্রতিবেদনে রাষ্ট্রসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কমপ্যারিজন প্রোগ্রামের তথ্য অনুসারে, যা বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছে রয়েছে, ক্রয়ক্ষমতার সাম্যের ভিত্তিতে ভারতীয় অর্থনীতির আয়তন ও তার বৈশ্বিক ক্রমসংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে।
যেহেতু বিভিন্ন দেশ তাদের বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের হিসাব তাদের নিজস্ব মুদ্রায় দেয় ফলে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের জিডিপির তুলনা করা সমস্যার হয়। এই সমস্যা দূর করতে পিপিপি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
কাজেই, আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের মতে "কোন দেশে গড় মানুষ ভাল থাকবেন" অথবা "বিশ্বের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে কোন দেশের অবদান সবচেয়ে বেশি", এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য পিপিপি পদ্ধতি ব্যবহার করে হিসাব কার্যকর।
আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের মতে পিপিপি-র সংজ্ঞা হল:
দুই দেশে একই পরিমাণ পণ্য ও পরিষেবা কেনার জন্য এক দেশের মুদ্রাকে যে হারে অন্য দেশের মুদ্রায় রূপান্তরিত করতে হবে, তাকেই বলে পিপিপি।
দ্য ইকনমিস্ট পত্রিকা পিপিপি-র অর্থ ব্যাখ্যা করতে একটি সরল ও জনপ্রিয় উদাহরণ ব্যবহার করেছিল, যার নাম হল "বিগ ম্যাক ইনডেক্স"। যেহেতু ফাস্ট ফুড চেন ম্যাকডোনান্ডস-এর বিগ ম্যাক বার্গার গোটা দুনিয়াতেই বিক্রি হয় এবং তা সর্বত্রই প্রায় এক রকম, সেই কারণেই এই বার্গারকে পণ্য হিসাবে ধরে পিপিপি হিসাব করেছে পত্রিকাটি।
তারা ব্যাখ্যা করেছে যে, আমেরিকায় একটি বিগ ম্যাক বার্গারের দাম ৫ ডলার, চিনে ২০ ইউয়ান। সুতরাং, শুধু বিগ ম্যাকের কথা ধরলে, চিন ও আমেরিকার মধ্যে পিপিপি এক্সচেঞ্জ রেট বিনিময় মূল্য হল এক ডলারে চার ইউয়ান। পত্রিকাটি বিগ ম্যাক ইনডেক্সকে ব্যবহার করে আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে দেখেছে যে, কোনও দেশের মূল্য অন্য কোনও দেশের মূল্যের সাপেক্ষে অতিমূল্যায়িত বা অন্যের বিপরীতে অবমূল্যায়িত কি না। এই পদ্ধতিটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য অর্থনীতির কোনও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয় বরং মজার মধ্যে দিয়ে পিপিপি সম্বন্ধে একটি প্রাথমিক ধারণা গড়ে তোলা।
তবে, রাষ্ট্রসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কমপ্যারিজন প্রোগ্রাম বিগ ম্যাক ইনডেসক্স ব্যবহার করেনি বরং বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার একটি গুচ্ছকে ব্যবহার করে পিপিপি বিনিময় মূল্য হিসাব করেছে। এই পিপিপি বিনিময় মূল্যের মাধ্যমে হিসাব করলে (সচরাচর ডলারের অঙ্কে এই হিসাবটি করা হয়) এক দেশের অর্থনীতির আয়তনের সঙ্গে অন্য দেশের তুলনা করা সম্ভব হয়।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে, ইন্টারন্যাশনাল কমপ্যারিজন প্রোগ্রাম-এর পরিসংখ্যান থেকে বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব অনুসারে ভারতীয় অর্থনীতি বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম। ২০১১ সাল থেকেই ভারত এই অবস্থানে রয়েছে, যখন প্রথম এই দাবিটি করা হয়েছিল। পিপিপি হিসাব অনুসারে এখন চিন (২৭.৩১ লক্ষ কোটি ডলার) বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০১৬ সালে তা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে (২২.৯৯ লক্ষ কোটি ডলার) ছাড়িয়ে যায়।
আমেরিকা, চিন, ভারত ও জাপান, ২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত এই চারটি দেশের জিডিপির পরিসংখ্যান তুলনা করে দেখে বুম। তাতে দেখা যায় যে, ভারত টানা তৃতীয় স্থানে রয়েছে (২০২১ সালে অর্থনীতির আয়তন ১০.৩ লক্ষ কোটি ডলার), এবং চতুর্থ স্থানে রয়েছে জাপান (২০২১ সালে ৫.৪ লক্ষ কোটি ডলার)। ২০১৬ সালে চিন ও আমেরিকার জায়গা পাল্টে যায়।
যদিও এখানে একটি সতর্কবার্তার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতির আয়তনের ক্রম নির্ধারণ, জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি বা মুদ্রার মূল্য নির্ধারণের মতো কাজের জন্য পিপিপি পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা বলেনি বিশ্ব ব্যাঙ্ক। এটি বিভিন্ন দেশের মধ্যে তুলনার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওয়ার কথা।
তথ্য পাওয়া যাবে এখানে।
আরও পড়ুন: মুম্বইয়ের ভিড় ট্রেনকে রাহুল গাঁধী বললেন উত্তরপ্রদেশের