ভুয়ো খবরের শিকার সার্ফ এক্সেল; বিজ্ঞাপনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে উৎসাহ দেওয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া
এইচইউএল'র এক মুখপাত্র'র সঙ্গে কথা বলে বুম, এবং যা যা দাবি করা হচ্ছিল সেগুলি খন্ডন করে
জনপ্রিয় ডিটারজেন্ট সাবান সার্ফ এক্সেল আর তার প্রস্তুতকারক হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড (এইচইউএল) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তুলে ধরে এক বিজ্ঞাপন সম্প্রচার করার জন্য সোশাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছে। শুধু তাই নয়, সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা ওই ব্র্যান্ডটির বিরুদ্ধে এক রাশ বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বিজ্ঞাপনটি ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৯ - এ প্রচার করা হয়। তার পরেই অনেকে সেটিকে হিন্দু বিরোধী আখ্যা দেন। কেউ কেউ আবার সেটি 'লাভ জিহাদ'-এ ইন্ধন যোগাচ্ছে বলে অভিযোগ আনতেও ছাড়েন না।
হট্টোগোলের মধ্যে ভুয়ো খবর
কিছুক্ষনের মধ্যেই, ওই প্রডাক্টটি এবং এইচইউএল'র সম্পর্কে উদ্ভট সব তথ্য ছড়াতে শুরু করে, সঙ্গে হ্যাসট্যাগ #বয়কটসার্ফএক্সেল, #বয়কটএইচইউএল।
বুম এইচইউএল'র সাসটেনেবল বিজনেস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টের প্রধান অরবিন্দ নায়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। দেখা যায়, যা দাবি করা হচ্ছে তার বেশিটাই ডাহা মিথ্যে।
১. সার্ফ এক্সেলের উপাদান—মানুষ আর শুয়োরের দেহাংশ।
এক টুইটার ব্যবহারকারী দাবি করে যে, সার্ফ এক্সেল প্রস্তুত করার জন্য মানুষ ও শুয়োরের দেহাংশ ব্যবহার করা হয়।
সার্ফ এক্সেল প্রস্তুত করতে কী কী জিনিস ব্যবহার করা হয়, কম্পানির ওয়েবসাইট সার্চ করে বুম তা জানতে পারে। তাদের দেওয়া লিস্টে ছিল সারফাক্ট্যান্ট যৌগ, প্রাকৃতিক এনজাইম, এবং অন্যান্য সিন্থেটিক উপাদান। তার মধ্যে মানুষ বা শুয়োরের দেহাংশের কোনও উল্লেখ ছিল না।
নায়ার ওই দাবিটি নস্যাৎ করে দিয়ে বলেন, "সার্ফ এক্সেল কোনও প্রাণীর দেহ থেকে নেওয়া উপাদান ব্যবহার করে না। আমাদের দ্রব্যগুলি নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়। যাচাই করা হয় সেগুলি বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে তৈরি হচ্ছে কিনা। এবং আমাদের কারখানা ও সাপ্লায়ারদের থেকে থেকেই অডিট করে বাইরের স্বীকৃত সংস্থা এবং কম্পানির ভেতরে মান বিচারের ম্যানেজাররা।
২. সার্ফ এক্সেল'র মালিক আতিকুল্লাহ মালিক নামের এক ব্যক্তি
একটি ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয় যে, আতিকুল্লাহ মালিক নামক এক ব্যক্তি সার্ফ এক্সেল'র মালিক।
নায়ার দাবিটি উড়িয়ে দেন। বলেন, সার্ফ এক্সেলের মালিক হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড, কোনও ব্যক্তিবিশেষ নন।
বুম হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড'র ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যায় সার্ফ এক্সেলকে, তাদেরই একটা পণ্য হিসেবে লিস্ট করা আছে।
বুম সেই ওয়েবপেজও দেখে, যেখানে এইচইউএল'র ডিরেক্টর, সিনিয়র করপোরেট অফিসার, এবং ইউনিলিভার করপোরেট এক্সিকিউটিভদের নাম দেওয়া আছে। সেখানে আতিকুল্লাহ মালিক নামের কোনও ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়নি।
৩. বিজ্ঞাপনটি চালানোর পর থেকে সার্ফ এক্সেল'র ১০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে
একজন টুইটার ব্যবহারকারী দাবি করেন যে, বিজ্ঞাপনটি চালু হওয়ার পর জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ায় সার্ফ এক্সেলের ১০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
কিন্তু বুম দেখে যে, 'টাইমস অফ ইন্ডিয়া'র আসল টুইটার হ্যান্ডল থেকে সে রকম কোনও টুইট করা হয়নি। তাছাড়া তাদের ওয়েবসাইটে এই সংক্রান্ত কোনও রিপোর্টও ছিল না।
মুখপাত্র বুমকে বলেন, "এটা সম্পূর্ণ ভুল। এবং আমরা কখনওই জল্পনার ভিত্তিতে আমাদের ব্র্যান্ডগুলির মাসিক সংখ্যা সম্পর্কে মন্তব্য করি না।" এ কথা বলার মধ্যে দিয়ে, উনি বুঝিয়ে দেন যে টুইটটা মিথ্যে।
৪. সার্ফ এক্সেল হাতে ফোড়া সৃষ্টি করে
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী দাবি করেন যে, এক মহিলা তাঁর হাতের মেহেন্দি সার্ফ ডিটারজেন্ট দিয়ে ধোয়ার ফলে তাঁর হাতে ফোড়া বেরিয়ে যায়।
রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে, বুম সেই ছবিটির সন্ধান পায়। ছবিটি 'হেনা বাই আজ্জি' নামক এক ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। বেআইনি কালো হেনা ব্যবহার করলে হাতের কী অবস্থা হতে পারে সেটা বোঝাতেই ওই ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল ওই ওয়েবসাইটে।
ওয়েবসাইটটি অনুযায়ী, ওই হাতের ছবিটি এক সাত বছরের মেয়ের। নাম ম্যাডিসন গালিভার। মিশরে কালো হেনা ব্যবহার করার ফলে, তার হাতে ওই ধরনের ফোড়া বেরয়।
বিজ্ঞাপনটি তৈরি করার পেছনে দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর আহ্বান
বুম একটি পোস্টের সন্ধান পায় যেখানে ওই বিজ্ঞাপনটি তৈরি করার পেছনে দুটি নাম উল্লেখ করা হয়—কারলস প্যারেরা, লোয়াস লিন্টাসের রিজিওনাল ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর, এবং প্রিয়া নায়ার, হিন্দুস্তান লিভার লিমিটেডের 'হোম কেয়ারের' এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর।
পোস্টটিতে ওই দুই ব্যক্তিকে নিশানা করে প্রচার চালানোর আহ্বান জানান হয়, যাতে তাঁদের চাকরি থেকে বরখাস্থ করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
মুখপাত্র বুমকে নিশ্চিত করে জানান যে প্রিয়া নায়ার হিন্দুস্তান লিভারের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, 'হোম কেয়ার', এবং লোয়াস লিন্টন হলো একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সি, যারা সার্ফ এক্সেলের কাজ করে।
তিনি আরও বলেন যে, একটা বিজ্ঞাপন কোনও ব্যক্তি বিশেষের কাজ নয়, বরং অনেকগুলি টিমের বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়েই সেটি তৈরি হয়।
"সাধারণত, একটি বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট বা বিষয় বিজ্ঞাপন এজেন্সি ও কম্পানি যৌথভাবে ঠিক করে। সঙ্গে থাকেন অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা। একটি বিজ্ঞাপনকে কোনও বিশেষ ব্যক্তির কাজ বলে ধরে নেওয়াটা একেবারেই ভুল," তিনি বুমকে বলেন।
সার্ফএক্সেল, মাইক্রোসফ্টএক্সেলএকই…
বিজ্ঞাপনটি নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় হই চই চলাকালে যাঁরা নিজেদের আঘাতপ্রাপ্ত বলে মনে করেন, তাঁরা ব্র্যান্ডটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য নতুন নতুন পন্থা খুঁজতে থাকেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে গুগুল প্লেতে গিয়ে 'এক্সেল' অ্যাপটির রেটিং কমানোর সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু তাঁরা মাইক্রোসফ্ট এক্সেল আর সার্ফ এক্সেল গুলিয়ে ফেলেন। ফলে তাঁরা স্প্রেডশিট ম্যানেজ করার জনপ্রিয় অ্যাপটিকে ১-স্টার দিয়ে বসেন।