মিথ্যে: জাপানি নোবেল বিজয়ী তাসুকু হঞ্জো বলেছেন সার্স-কভ-২ মানুষের তৈরি
জাপানের নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী তাসুকু হঞ্জো করোনাভাইরাস নিয়ে এরকম কোনও মন্তব্য করেননি। উপরন্তু সব বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্যই ইঙ্গিত করছে ভাইরাসটি মানুষের তৈরি নয়।
একটি ভাইরাল বার্তায় ভুয়ো দাবি করা হয়েছে যে, জাপানি নোবেলজয়ী চিকিৎসক তাসুকু হঞ্জো বলেছেন যে, কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী এসএআরএস-কোভ-২বা নোভেল করোনাভাইরাস মানুষের তৈরি। অথচ, করোনাভাইরাসের উৎস সম্পর্কে উনি কোনও মন্তব্যই করেন নি।
বার্তাটিতে আরও দাবি করা হয়েছে যে, হঞ্জো উহানের গবেষণাগারে চার বছর কাজ করেছিলেন। নোবেল সংস্থার ওয়েবসাইট ও কিয়োটো ইউনিভারসিটির ওয়েবসাইটে হঞ্জো সম্পর্কে তথ্য খুঁটিয়ে দেখে বুম। সেখানে কোথাও উল্লেখ নেই যে, হঞ্জো উহানের ল্যাবরেটারির সঙ্গে কোনও কাজ করেছেন।
তাছাড়া 'নেচার' ও 'ল্যানসেট'-এর মত আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাতে এসএআরএস-কোভ-২ ভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ করে তার সিকোয়েন্স বা অনুক্রম দেখে এই সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, ভাইরাসটির উৎস প্রাকৃতিক, সেটি মানুষের সৃষ্টি নয়।
হঞ্জোকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর দাবিটি সব সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন ভাষায় শেয়ার হচ্ছে। বুম ইংরেজি আর হিন্দিতে প্রচারিত মেসেজটি পেয়েছে। তাতে দাবি করা হয়েছে যে, নোবেল বিজেতা চিকিৎসা বিজ্ঞানী তাসুকু হঞ্জো নাকি বলেছেন যে, নোভেল করোনাভাইরাসটি প্রাকৃতিক ভাইরাস নয়, এই ভাইরাসটি মানবনির্মিত। ভাইরাল পোস্টে আরও দাবি করা হয়েছে যে, ভাইরাসটি প্রাকৃতিক হলে সেটি নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে ছড়াত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে, পরিবর্তনশীল তাপমাত্রা ও আবহাওয়া এই ভাইরাসকে আবদ্ধ রাখতে পারেনি।
বার্তাটির সত্যতা যাচাই করার জন্য সেটি বুমের হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইনে আসে।
ছবি এবং ক্যাপশন সহ দাবিটি টুইটারেও ভাইরাল হয়েছে।
जापान के नोबल पुरस्कार जीतने वाले ओर 4 साल तक चीन में काम करने वाले प्रोफेसर #टासुकू_होंजो का दावा, कोरोना प्राकृतिक नही कृत्रिम वायरस है जो चीन ने बनाया है। pic.twitter.com/ukrx2gH6Tw
— MANOJ KUMAR MEENA (@MANOJMEENARAJ) April 24, 2020
তথ্য যাচাই
২০১৮ সালের নোবেল বিজয়ী তাসুকু হঞ্জোর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারগুলি বুম দেখে। তার মধ্যে 'নিক্কেই নিউজ'-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার বুমের নজরে আসে, যেখানে তিনি ভাইরাসটির সংক্রমণ রুখতে উনি জাপানের সরকারকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার কথা বলেন।
নোবেলজয়ী এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ইতালি, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলি কোভিড-১৯ এর যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনেক দেরি করেছে। কারণ, তারা ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধ করার চেয়ে অর্থনীতিকে চালু রাখার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে । ওই সাক্ষাৎকারে উনি জাপানকে তাইওয়ানের মতো করে মাক্সকে রেশন ব্যাবস্থার অন্তর্গত করা আর অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার করার পরামর্শ দেন। উনি বলেন, ওই দুই ব্যবস্থা জাপানে সংক্রমণ রোধ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। বিজ্ঞানী হঞ্জোর সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি পড়া যাবে এখানে।
তাসুকু হঞ্জো কী কোনও সময় উহান ল্যাবরেটারির সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করেছিলেন কিনা, তা জানার জন্য বুম নোবেল সংস্থার ওয়েবসাইট ও কিয়োটো ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে তাঁর প্রোফাইল খুঁজে দেখে। কিন্তু তাতে হঞ্জো উহান ল্যাবরেটারির সঙ্গে কাজ করেছিলেন, সে রকম কোনও তথ্য নেই।
আরও জানতে চেয়ে বুম বিজ্ঞানী হঞ্জোকে এবং কিয়োটো ইউনিভার্সিটিকে মেইল করে। কিয়োটো ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে এই দাবি খারিজ করা হয় এবং তাসুকু হঞ্জোর অফিসিয়াল মন্তব্য শেয়ার করা হয়। হঞ্জো প্রতিক্রিয়াতে বলেছেন, তিনি খুবই ব্যাথিত হয়েছেন কেননা তাঁর এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এই ভুয়ো খবরে জড়ানো হয়েছে।
২০১৮ সালে জাপানি চিকিৎসাবিদ তাসুকু হঞ্জোকে ক্যানসার চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণার অনাক্রম্যতা বিষয়ে কাজের অবদানের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। বিজ্ঞানী হঞ্জো কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, এই দাবিকে সমর্থন করার মতো কোনও তথ্য বুম খুঁজে পায়নি।
যদিও ফরাসি নোবেল বিজয়ী ভাইরোলজিস্ট লুক মন্তাগ্নিয়র অবশ্য একটি মন্তব্য করে দাবি করেছেন যে, নোভেল করোনাভাইরাস ল্যাবরেটারিতে তৈরি করা হয়েছে।
নোভেল করোনাভাইরাসের উৎস কি?
'ল্যানসেট' ও 'নেচার'-এর মতো আরও কিছু জার্নালে এসএআরএস-কোভ-২ ভাইরাসের জিনের সিকোয়েন্স বা অনুক্রম সংক্রান্ত গবেষনার আলোচনা ছাপা হয়েছে। সেগুলিতে দেখান হয়েছে যে, ভাইরাসটি বন্যপ্রাণী থেকে এসেছে। কোনও গবেষণাতেই বলা হয়নি যে, সেটি গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন পরজীবী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও রোগসৃষ্টিকারী জীবানুর এরকম বন্যপ্রানী থেকে মানবদেহে ধারক বদলের ঘটনা জীববিজ্ঞানের নুতন কোনো ঘটনা নয়, কোনো জীবানুর এভাবে ধারক বদলের ঘটনাকে জোনোটিক ট্রান্সফার বলা হয় এবং রোগগুলিকে জোনোটিক রোগ বলা হয়।
নেচার-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, এসএআরএস-কভ-২ ভাইরাস আর বাদুড় থেকে পাওয়া করোনাভাইরাসের মধ্যে ৯৬% জিনগত সাদৃশ্য আছে। এবং তার সিকোয়েন্সের চরিত্র ৭৯.৬% মিলে যায় এসএআরএস-কোভ-২ এর সঙ্গে। আর ল্যানসেট-এ প্রকাশিত লেখায় বিশ্বের অনেক বিজ্ঞানী সার্স-কভ-২-এর উৎস যে একটি প্রাণী, সেটি যে মানুষের তৈরি নয়, সেই তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন।
নোভেল করোনাভাইরাসের উৎসের প্রকৃতি বোঝার জন্য বুম ডঃ সন্ধ্যা কৌশিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে। 'ইন্ডিয়ান সায়েন্টিস্টস রেসপন্স টু কোভিড-১৯' নামে বিজ্ঞানীদের গ্রুপের একজন আহ্বায়ক ডঃ কৌশিকা। এই দলে ৪০০ জন ভারতীয় বিজ্ঞানী আছেন যাঁরা কোভিড-১৯-এর মোকাবিলা করার কাজ করছেন।
ডঃ কৌশিকা বলেন, সার্স-কভ-২ একটি 'বিটা-করোনাভাইরাস' এবং সমগোত্রীয় ভাইরাসগুলির থেকে আলাদা নয়। এই ভাইরাসের 'স্পাইক' প্রোটিনের খুব ছোট সিকোয়েন্স দেখে অনেকে দাবি করেছেন যে সেটি 'এইচআইভি' থেকে এসেছে। কিন্তু কৌশিকা বলেন, ওই সিকোয়েন্স অত্যন্ত ছোট এবং অনেক জৈবিক পদার্থের মধ্যেই তা দেখা যায়। তিনি আরও বলেন যে, বাদুড় অনেক ধরনের ভাইরাস নিজেদের শরীরে বহন করতে পারে। এসএআরএস-কোভ-২'র সিকোয়েন্স দেখিয়ে দিচ্ছে যে বাদুড় আর প্যাঙ্গোলিনের করোনাভাইরাস সিকোয়েন্সের মধ্যে অনেক মিল আছে। তার থেকে বোঝা যায় যে, নভেল করোনাভাইরাস প্রাণী থেকেই মানুষের মধ্যে এসেছে।
শুরুতে দাবি করা হয়েছিল,নোভেল করোনাভাইরাসটি একটি জৈবঅস্ত্র যা ইতিমধ্যেই পেটেন্ট করা হয়ে গেছে। বুম সেই দাবি খণ্ডন করে।