না, এই অ্যাপটি রক্তের অক্সিজেন মাত্রা মাপতে পারে না ফোন ক্যামেরায়
বুমের সঙ্গে কথা বলা স্বাস্থ্য ও সাইবার সুরক্ষা বিশেষজ্ঞরা ফোনের ফ্ল্যাশলাইট ও পিছনের ক্যামেরা দিয়ে অক্সিজেনের মাত্রা মাপা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে যে, মোবাইল অ্যাপ 'পেডোমিটার ২০১৮'র সাহায্যে 'ইন্ডেক্স ফিঙ্গার' বা তর্জনী ফোনের পিছনের ক্যামেরায় ছুঁইয়ে রাখলেই রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা জানা যায়।
বার্তাটিতে অ্যাপটির লিঙ্কও শেয়ার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে 'গুগুল প্লে স্টোর' থেকে সেটিকে কীভাবে ডাউনলোড করতে হবে, তার পদ্ধতিও জানানো হয়েছে। 'পাল্স অক্সিমিটার' হল একটি ছোট, হাল্কা যন্ত্র যা দিয়ে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা মাপা যায়। এটি সাধরণত যে সব রোগী ফুসফুসের অসুখ আর নিঃশ্বাসের কষ্টে ভোগেন, তাঁদের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়।
এই যন্ত্রটি এখন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কারণ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে তাঁদের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাপা জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু পেডোমিটার হল এমন একটি অ্যাপ যা একজন ব্যক্তির হাঁটার গতি নির্ণয় করে এবং তিনি কত পা হাঁটলেন, তা হিসেব করে দিতে পারে।
ভাইরাল এই ফরওয়ার্ড-করা বার্তাটিতে বলা হয়েছে, "যাঁরা এখনও অক্সিমিটার জোগাড় করতে পারেননি, বা অন্যরাও, এই অ্যাপটি ইনস্টল করুন। এবং কোভিডের সময় রোজ নিজের শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা মেপে নিন। যদি তা ৯০-এর নীচে নেমে গিয়ে থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।"
অ্যাপটি কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সে সম্পর্কে বার্তাটিতে বলা হয়েছে, "পিছনের ক্যামেরায় ইন্ডেক্স ফিঙ্গার বা তর্জনী রাখুন। পুরো ক্যামেরাটা যেন ঢাকা পড়ে। 'মেজার' শব্দটি স্পর্শ করুন। মাপার কাজটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে হাত দিয়ে রাখুন। এরপর মাপটা স্ক্রিনে ফুটে উঠবে।"
আর্কাইভের জন্য ক্লিক করুন এখানে।
ওই পোস্টটি সম্পর্কে জানতে চেয়ে সেটিকে বুমের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে (৭৭০০৯০৬১১১) পাঠানো হয়।
তথ্য যাচাই
বুম স্বাস্থ্য ও সাইবার সুরক্ষা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা বলেন, বর্তমান প্রযুক্তিতে, কেবল মোবাইল ফোন ব্যবহার করে কোনও ব্যক্তির রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাপা সম্ভব নয়, যেমনটি দাবি করা হয়েছে ভাইরাল বার্তাটিতে।
আমরা অ্যাপটি পরীক্ষা করে দেখি। তাতে দেখা যায় যে, সেটি পাল্সের স্পন্দন ধরতে পারে না এবং মানুষের হাত ও অন্য কোনও বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম। আর সেটি যে রিডিং দেয়, তা সম্পূর্ণ ভুল।
পাল্স অক্সিমিটারের ক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তিকে আঙ্গুল ঢোকাতে হয় ওই যন্ত্রটির মধ্যে। তারপর যন্ত্রটি সেই আঙ্গুলের মধ্যে দিয়ে দু'টি আলোর তরঙ্গ পাঠায়, যার সাহায্যে তাঁর পাল্সের গতি ও রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাপা হয়। মাপার প্রক্রিয়াটি শেষ হয়ে গেলে, ফলাফল স্ক্রিনে ফুটে ওঠে।
ভুল পরিমাপ
পেডোমিটার ২০১৮ অ্যাপটি দাবি করে যে, সেটি পাল্স অক্সিমিটার ছাড়াই কাজ করে এবং শুধু ক্যামেরা ও ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে রক্তচাপ, অক্সিজেনের মাত্রা ও হৃদযন্ত্রের স্পন্দন মাপতে পারে।
রক্তে অক্সিজেনের স্বাভাবিক মাত্রা হল ৯৫% থেকে ১০০%। অ্যাপিটিতে যে পদ্ধতির কথা বলা আছে, সেটি অনুসরণ করে প্রথমে ক্যামেরার ওপর তর্জনী রাখা হয়। তারপর স্ক্রিনে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিলে ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে ওঠে, এবং আমরা রিডিং পাই ৯৫। সেটি স্বাভাবিক মাত্রা।
আমরা দেখি যে, ক্যামেরায় আঙ্গুল ছোঁয়ান হোক বা না হোক, অ্যাপটি রিডিং দিয়েই থাকে। এমনকি ক্যামারাটিকে একটা টেবিলের ওপর রেখে রিডিং নিলেও অ্যাপটি স্বাভাবিক মাত্রা ৯৪ দেখায়।
এর থেকে প্রমাণ হয় যে, অ্যাপটি সঠিক রিডিং দেয় না। তাছাড়া, প্লে স্টোরে অ্যাপটি সম্পর্কে যে সব রিভিউ বেরিয়েছে, তাতেও একই কথা বলা হয়েছে।
অক্সিমিটার ইনফ্রারেড প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা সাধারণ ফোনে অনুপস্থিত: ডঃ জীনাম শাহ
পেডোমিটার ২০১৮ তার অপটিক্যাল মাপক ক্ষমতা সম্পর্কে দাবি করে যে, ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটির আলোর সাহায্যেই অ্যাপটি রক্তের শিরায় পাল্সের স্পন্দন ধরতে পারে।
সৈফি, ওয়াকহার্ট অ্যান্ড ভাটিয়া হসপিটালের চেস্ট ও ফুসফুস বিশেষজ্ঞ ডঃ জীনাম শাহ'র সঙ্গে যোগাযোগ করে বুম। উনি বলেন অ্যাপটি ভুয়ো। উনি জানান যে, অক্সিমিটারের মত যন্ত্রে ইনফ্রারেড প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যা সাধারণ ফোনে থাকে না।
"ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে একটা ফোন কোনও ভাবেই অক্সিজেনের মাত্রা বা হৃৎস্পন্দন মাপতে পারে না," শাহ বুমকে বলেন।
এই অ্যাপটি একটি ভাঁওতা: সাইবার বিশেষজ্ঞ
উদ্যোগপতি, সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, এবং 'হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার' বা বৈধ হ্যাকার রাহুল সসির সঙ্গে বুম যোগাযোগ করে। উনি বলেন ওই অ্যাপটি ভুয়ো। মোবাইল ফোন দিয়ে মানুষের পাল্স মাপা কঠিন এবং তা সঠিক ফলাফল দেবে না।
"তত্ত্বগত দিক থেকে বিচার করলে, বলা যায় যে ক্যামেরার সাহায্যে হৃদস্পন্দন মাপা যায় এবং অনেক ধরনের ব্যবসায়িক অ্যাপ্লিকেশন পাওয়া যায়। 'ফোটোপ্লেথিসমোগ্র্যাম' ভিত্তিক যন্ত্রে আলো ব্যবহার করা হয় ত্বক আলোকিত করতে। এবং ক্যামেরার সাহায্যে সেই আলোর তারতম্য যাচাই করে, রক্ত প্রবাহের প্যাটার্ন বোঝা যায়," বলেন সসি।
উনি আরও বলেন, "তাই, তত্ত্বগত দিক থেকে এ কথা বলা যায় যে, ক্যামেরা ও আলো ব্যবহার করে মানুষের পাল্স রেট ও শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা নির্ণয় করা যেতে পারে। তবে এই প্রযুক্তিকে একটি মোবাইল ফোনের মধ্যে আনা অত্যন্ত কঠিন। এবং তা থেকে কোনও বিশ্বাসযোগ্য ফলাফল পাওয়া যাবে না। আমি এর কোডটি বিশ্লেষণ করে দেখিনি। কিন্তু আমার মনে হয়, এই অ্যাপটি ভুয়ো্।"
রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপার জন্য কোনও মোবাইলের প্রযুক্তি উপযুক্ত, তেমন প্রমাণ নেই: সিইবিএম বিশ্লেষণ
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সেন্টার ফর এভিডেন্স বেস্ড মেডিসিন'-এর করা স্মার্টফোনের ওপর এক বিশ্লেষণ থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন গেছে যে, অক্সিমিটার হিসেবে সেগুলিকে ব্যবহার করা যায় না।
ওই বিশ্লষণে বলা হয়, "রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ নির্ণয় করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার করার মতো নির্ভুল ফলাফল দিতে পারে এমন কোনও স্মার্টফোনের কথা জানা যায়নি। ওই সব প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সন্দেহজনক। রোগীদের শারীরিক অবস্থা যাচাই করার ক্ষেত্রে, ওই ধরনের প্রযুক্তির সাহায্যে মাপা অক্সিজেনের মাত্রার রিপোর্টের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়।"
NEW rapid review by me (small clinical/ editing role) and Lionel Tarassenko, Professor of Electrical Engineering (major bioengineer role):
— Trisha Greenhalgh 😷 #BlackLivesMatter (@trishgreenhalgh) April 2, 2020
Q: Can smartphone apps be used to measure oxygen saturation?
A: No.https://t.co/iIQqi66tUM
ওই অ্যাপটি প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে বুম যোগাযোগ করেছে। তাঁদের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলে এই প্রতিবেদনটি আপডেট করা হবে।
আরও পড়ুন: বিশ্লেষণ: কেন ভাল্ভ যুক্ত এন-৯৫ মাস্ক কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কার্যকরী নয়