অতিমারির সময় নরেন্দ্র মোদীর প্রচার বলে হাঁসের সঙ্গে পুরনো ছবি ভাইরাল
বুম দেখে ২০১১ সালের এই ছবিগুলি পুরনো। এরকম কয়েকটি ছবি নরেন্দ্র মোদীর নিজস্ব ওয়েবসাইটেও দেখতে পাওয়া যায়।
নরেন্দ্র মোদী বাড়ির বাইরে দুটি রাজহাঁস নিয়ে বসে রয়েছেন, ২০১১ সালের পুরনো এমন একটি ছবি দিয়ে কোভিড-১৯ অতিমারীর সময়েও প্রধানমন্ত্রীর অবিচলিত মনোভাবের ভাবমূর্তি প্রচারের চেষ্টা চলছে। মোদী নিজে তাঁর লোককল্যাণ মার্গের সরকারি বাসভবনে ময়ূরদের সঙ্গে বিচরণ ও তাদের খাওয়ানোর ভিডিও শেয়ার করার পরই রাজহাঁসদের সঙ্গে তাঁর এই বাসী ছবিটা ভাইরাল হয়। সেই ছবিগুলোতে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে যে, মোদী একই সঙ্গে বারাক ওবামার ওপর একটি বই এবং সংবাদপত্র পড়ছেন, ল্যাপটপে কিছু লিখছেন এবং তাঁর বাগানে রাজহাঁস পরিবৃত হয়ে রয়েছেন।
বুম দেখেছে, এই ছবিগুলো ২০১২ সাল কিংবা তারও আগের কোনও ফোটোশুট থেকে নেওয়া, যখন মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা বলছেন. দেশে যখন কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে, তখন এই ধরনের ছবি প্রকাশ করার মাধ্যমে তাঁর অবিচলিত ভাবমূর্তি নির্মাণেরই চেষ্টা চলছে। ক্যাপশনে লেখা হচ্ছে: "একই সঙ্গে দুটি বই এবং খবরের কাগজ পড়া, ল্যাপটপে কাজ করা এবং ছবির জন্য নিখুঁত পোজ দেওয়া এবং তাও এই অতিমারীর সংক্রমণের মধ্যে!সত্যিই চমকপ্রদ!"
গায়িকা কারালিসা মন্টেইরো একটি টুইটে এই ফোটোশুটকে কোভিড-১৯-এর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, এটি সাম্প্রতিক।
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
The talent to read two books, a newspaper and the laptop simultaneously while posing for the perfect photograph.
— Caralisa Monteiro (@runcaralisarun) August 25, 2020
And that poise during a Pandemic.
Impressed. pic.twitter.com/4IRbONYUsw
একই ধরনের টুইট আর্কাইভ করা আছে এখানে এবং এখানে।
ফেসবুক ব্যবহারকারীরাও একই রকমের ক্যাপশন দিয়ে ছবিটি প্রচার করেছেন। টুইটটি আর্কইভ করা আছে এখানে।
এই ধরনের পোস্ট আর্কাইভ করা আছে এখানে এবং এখানে।
ওই একই ফোটোশুট-এ তোলা অন্য একটি ছবি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের সরকারি টুইটার হ্যান্ডেল থেকেও ছাড়া হয়েছে, যে ছবিতে মোদীকে এক পাল হাঁসের ফোটো তুলতে দেখা যাচ্ছে। তাতে ক্যাপশন দেওয়া হয়েছেঃ "একবার ব্যাপারটা ভাবুন! সারা বিশ্বে একটা সার্বিক ভয়াবহ অতিমারী এবং অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, আর তার মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক সংক্রমিত দেশের কর্ণধার নিজের দেশবাসীকে দেখার বদলে নিজের ভাবমূর্তি তৈরির ভিডিও বানাচ্ছেন! কেমন অবাস্তব মনে হয় না!"
এই টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
Picture this: There's a global pandemic & economic recession but the leader of the 3rd most affected country is making PR videos instead of helping his people.
— Congress (@INCIndia) August 26, 2020
Sounds unreal doesn't it? #BJPAbandonsStates pic.twitter.com/Kw5BZDUbcL
আরও পড়ুন:
তথ্য যাচাই
বুম দেখেছে, এই ছবিগুলি অন্তত ২০১২ সালে তোলা, যার মধ্যে আবার কয়েকটি নরেন্দ্র মোদীর সরকারি ওয়েবসাইটেই ২০১১ সালের বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
একটি গাছতলায় বসে মোদী বই পড়ছেন, এমন ছবি দিয়ে তল্লাশি করতে গিয়ে ওই ফোটোশুট-এর স্থানটিতে পৌঁছনো গেলl আমাজন থেকে প্রচারিত একটি বইয়ের অংশবিশেষে, ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়—নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের "নরেন্দ্র মোদীঃ ব্যক্তি ও তাঁর সময়", যার প্রচ্ছদ এই ছবিটি দিয়েইl
৪৭ পৃষ্ঠাব্যাপী ওই অংশবিশেষের নাম—দীক্ষা, যেটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় এই ছবি সহ, যেখানে মোদী এক পাল হাঁস পরিবৃত হয়ে রয়েছেন, তাঁর একপাশে কতগুলি বই, অন্য দিকে একটি ল্যাপটপl এই ছবির প্রেক্ষাপটটিও ভাইরাল হওয়া ছবির অনুরূপ, যেখানে মোদীর পরনের জামাও একই এবং যে উপন্যাসগুলি তাঁর পাশে ছড়ানো, সেগুলোও একই।
বুম বইটির লেখক নীলাঞ্জনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ভাইরাল হওয়া ছবি তাঁর বই থেকেই নেওয়া হয়েছে এবং তিনি এই ছবিগুলি সংগ্রহ করেছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে, যখন মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। "ওঁরা ছবিগুলি ২০১২ সালে ই-মেল করে আমাকে পাঠিয়ে দেন এবং বলেন, আমি ইচ্ছে করলে ছবির ক্রেডিট হিসাবে নরেন্দ্রমোদী.ইন ওয়েবসাইটটি উদ্ধৃত করতে পারি। ছবিগুলো কবে তোলা, তা অবশ্য আমার জানা নেই।" ই-মেলটা যে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকেই এসেছিল, উনি সেটা আমাদের সঙ্গেও শেয়ার করেন, যার তারিখ দেওয়া ছিল ২০১২ সালের ২১ অগস্ট। আমরা গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থেই সেটি এই প্রতিবেদনের অন্তর্ভুক্ত করলাম না।
নীলাঞ্জনবাবুর বইতেও কিন্তু ছবিটির ক্যাপশনে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে— "গাঁধীনগরে এক শান্ত সকালে মোদী।" নীচে দেখুন সেই ছবিটি, বইতে যেভাবে সেটি ছাপা হয়েছে এবং লেখক আমাদের সেটি যেভাবে পাঠিয়েছেন।
২০১২ সালেই প্রকাশিত একটি ব্লগে আমরা ওই ফোটোশুটেরই অন্য ছবিও দেখেছি, যেখানে সেই একই ভাবে গাছের সামনে ল্যাপটপ ও বইপত্র নিয়ে বসে থাকা রাজহাঁস-পরিবৃত মোদী রয়েছেন, শুধু তাঁর জামার রঙটা আলাদা। ব্লগটি মিডিয়াম-এ প্রকাশিত হয় এবং এটি সানডে গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় আধিকারিক মাধব নলপত-এর লেখার প্রতিলিপি। নলপতের লেখা নিবন্ধটির তারিখ ৮ জানুয়ারি, ২০১২, এবং তাতে যে চারটি ছবি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে তিনটিই ভাইরাল হওয়া ছবির অনুরূপ। আর নিবন্ধটি হলো নলপতের নেওয়া মোদীর সাক্ষাৎকার।
ভাইরাল হওয়া দ্বিতীয় ছবিটিতে বাগানে বসা মোদীর হাতে একটি ক্যামেরা এবং মনে হচ্ছে তিনি যেন তা দিয়ে রাজহাঁসগুলির ছবি তুলতে চাইছেন। এই ছবিটা কংগ্রেস দলের সরকারি টুইটার হ্যান্ডেলেও ব্যবহার করা হয়েছে।
আমরা দেখেছি, এই ছবিটি অন্তত ২০১১ সালের এবং নরেন্দ্র মোদীর সরকারি ওয়েবসাইটেও রয়েছে। আমরা 'নরেন্দ্র মোদী+হাঁস' এই শব্দগুলি দিয়ে খোঁজ করে দেখেছি ওই একই গুচ্ছের ছবি তাতে অন্তর্ভুক্ত, যার একটি শিরোনামও দেওয়া হয়েছে— 'আমার বন্ধুদের সঙ্গে।'
ছবিগুলির তারিখ ১০ মে, ২০১১, যাতে মোদী দুটি ভিন্ন পোষাক পরে রয়েছেন এবং একটি ছবি তার মধ্যে কংগ্রেসের সরকারি টুইটারে হ্যান্ডেলে ব্যবহৃত।
মিডিয়াম ব্লগে নলপতের নেওয়া মোদীর যে সাক্ষাৎকারটি আপলোড করা হয়েছে, সেখানেও হাঁসেদের ছবি তোলার ভঙ্গীমায় এই ছবিগুলি রয়েছে যা কংগ্রেস টুইট করেছে, এবং যার ক্যাপশন: "ফোটোগ্রাফার হলেন নরেন্দ্র মোদী।" নীচে দেখুন এর স্ক্রিনশট।
ভাইরাল হওয়া দুটি ছবিরই তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এ দুটিই সম্ভবত একই সময়ে একই জায়গায় তোলা ছবি। ছবিগুলি প্রথম অনলাইনে আপলোড হয় ২০১১ সালে এবং সম্ভবত তারও আগে এগুলি তোলা হয়।
আরও পড়ুন: