হিন্দু মুসলিম প্রসঙ্গে Kalidas Nag-কে লেখা Rabindranath Tagore-এর চিঠি
বুম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালান্তর গ্রন্থে প্রকাশিত মূল চিঠির অংশ তুলে ধরেছে এই প্রতিবেদনে যা রাজনৈতিক তরজার বিষয় হয়েছে।
সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) ব্যক্তিগত চিঠির (letter) কয়েকটি বাক্য সোশাল মিডিয়া, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক আলোচনার পরিসরে ক্রমাগত বিভ্রান্তিকর অর্থসহ ব্যবহার হয়ে চলেছে।
আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই বাক্যাংশগুলি হল, ''পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র— সে হচ্ছে খৃষ্টান আর মুসলমান-ধর্ম। তারা নিজেদের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এইজন্যে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলাবার অন্য কোনো উপায় নেই।''
রবীন্দ্রনাথ সমগ্র চিঠির লেখায় ধর্মীয় আচারের বেড়াজাল টোপকে বিভিন্ন ধর্মের সংমিশ্রণের কথা বলেছেন, ধর্ম পরিবর্তন প্রসঙ্গে একথা কথা বলেননি, যা সোশাল মিডিয়ায় বা ভুলভাবে গণমাধ্যমে উদ্ধৃত করা হচ্ছে।
একটি বাংলা সংবাদমাধ্যমে রাজনৈতিক তরজায় বিজেপি নেতা দেবজিৎ সরকার (Debjit Sarkar) এই দুটি বাক্য ব্যবহার করলে বিতর্ক দানা বাঁধে। তিনি উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন এটি কালান্তর (Kalantar) গ্রন্থে মুদ্রিত হওয়া কালিদাস নাগকে (Kalidas Nag) লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠির অংশবিশেষ।
ওই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার (Pabitra Sarkar) অপ্রাসঙ্গিক ভাবে ওই লেখা ব্যবহার হচ্ছে বলে আপত্তি তোলেন। পবিত্র সরকার বলেন ওই "চিঠির প্রমাণে আপনি গোরা, গীতাঞ্জলিকে নস্যাৎ করছেন।"
ভিডিওটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
নিচের ভিডিওতে ১ ঘন্টা ৪৭ সেকেন্ড সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বাক্য ব্যবহারের প্রসঙ্গটি দেখা যাবে।
ইংরেজি গণমাধ্যমে ব্যবহার
টাইমস নাউ (Times Now) গণমাধ্যম-এর একটি রাজনৈতিক বিতর্কে দক্ষিণপন্থী বিজ্ঞানী ও লেখক আনন্দ রঙ্গনাথন (Anand Ranganathan) ওই একই বাক্যাংশ ইংরেজি অনুবাদে ব্যবহার করে বলেন, "তৃণমূল কংগ্রেস ও অন্যান্য ব্যক্তিদের সমস্যা হল তারা গুরুদেবের প্রতি ভালবাসা দেখালেও তাঁরা অম্বেদকারের মত গুরুদেবের লেখা নির্বাচিত ভাবে ব্যবহার করে।" টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
সোশাল মিডিয়ায় ছয়লাপ
এই একই বাক্য সোশাল মিডিয়ায় বিশেষত হিন্দি ও ইংরেজিতে অনুদিত হয়ে সোশাল মিডিয়ায় ব্যবহার হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এই বাক্যাংশ ব্যবহার করে দাবি করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ মুসলিম ও খ্রিষ্টান ধর্ম সম্পর্কে এই অভিমত ব্যাক্ত করেছেন ও এই দুই ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
বুমের কাছে বিষয়টি নিয়ে তথ্য-যাচাইয়ের অনুরোধ আসে। টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
বিভ্রান্তিকর অর্থ সহ বাংলা ফেসবুক পেজেও এই একই বাক্যের ব্যবহার হয়েছে। এরকম কয়েকটি ফেসবুক পোস্ট আর্কাইভ করা আছে এখানে, এখানে ও এখানে।
কালিদাস নাগ কে?
বিভ্রান্তিকর অর্থ সহ ব্যবহার হওয়া এই বাক্যাংশ আসলে কালিদাস নাগকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠির অংশ বিশেষ। কালিদাস নাগ (Kalidas Nag) ছিলেন লেখক, ঐতিহাসিক। পরে মাত্র কয়েক বছরের জন্য রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
বিশিষ্ট ফরাসি নাট্যব্যক্তিত্ব, প্রাবন্ধিক, উপন্যাসিক ও আধ্যাত্বিক ব্যক্তিত্ব নোবেলজয়ী রোমা রোঁলা (Roman Rolland)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কালিদাস নাগের। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত একাধিক চিঠির আদানপ্রদান হয় কালিদাস নাগ ও রোমা রোঁলা-এর মধ্যে। রোমা রোঁলা ঠাকুর রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক জীবন দর্শনে প্রভাবিত হয়ে লিখেছিলেন "দ্য লাইফ অফ রামকৃষ্ণ।" ফরাসি ভাষায় লেখা হলেও পরে ইংরেজি, বাংলা সহ নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই বই।
বিশিষ্ট ফরাসি অনুবাদক চিন্ময় গুহর "দ্য টাওয়ার অ্যন্ড দ্য সি: রোমারোঁলা এবং কালিদাস নাগ করেস্পন্ডেন্স" বইয়ে সেই পত্রালাপের নিখুঁত পরিচয় মেলে।
ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক তথা 'প্রবাসী' পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জামাতা ছিলেন কালিদাস নাগ।
কী লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ?
কালিদাস নাগকে লেখা এই চিঠি রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালান্তর গ্রন্থে। বুম এই চিঠিটির সমগ্র অংশটি পেয়েছে ইন্টারনেট আর্কাইভে সংরক্ষিত থাকা ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর ২৪ তম খন্ডে। ৩৭৪ থেকে ৩৭৭ পাতায় প্রকাশিত লেখার শিরোনাম হিন্দুমুসলমান।
''...ঠিক এমনসময় সমুদ্রপার হতে তোমার প্রশ্ন এল, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান-সমস্যার সমাধান কী। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মানবসংসারে আমার কাজ আছে— শুধু মেঘমল্লারে মেঘের ডাকের জবাব দিয়ে চলবে না, মানব-ইতিহাসের যে-সমস্ত মেঘমন্দ্র প্রশ্নাবলী আছে তারও উত্তর ভাবতে হবে। তাই অম্বুবাচীর আসর পরিত্যাগ করে বেরিয়ে আসতে হবে।
পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র— সে হচ্ছে খৃষ্টান আর মুসলমান-ধর্ম। তারা নিজেদের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এইজন্যে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলাবার অন্য কোনো উপায় নেই।"
এর পর রবীন্দ্রনাথ খ্রিষ্টান ধর্ম প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত দেন।
"খৃষ্টানধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে একটি সুবিধার কথা এই যে, তারা অধুনিক যুগের বাহন; তাদের মন মধ্যযুগের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়। ধর্মমত একান্তভাবে তাদের সমস্ত জীবনকে পরিবেষ্টিত করে নাই। এইজন্য অপরধর্মাবলম্বীদেরকে তারা ধর্মের বেড়ার দ্বারা সম্পূর্ণ বাধা দেয় না। য়ুরোপীয় আর খৃষ্টান এই দুটো শব্দ একার্থক নয়। 'য়ুরোপীয় বৌদ্ধ' বা 'য়ুরোপীয় মুসলমান' শব্দের মধ্যে স্বতোবিরুদ্ধতা নেই। কিন্তু ধর্মের নামে যে জাতির নামকরণ ধর্মমতেই তাদের মুখ্য পরিচয়। 'মুসলমান বৌদ্ধ' বা 'মুসলমান খৃষ্টান' শব্দ স্বতই অসম্ভব।"
রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্ম প্রসঙ্গেও একাধিক মতামত লেখেন ওই চিঠিতে। চিঠির সব অংশ পড়লে রবীন্দ্রনাথের ধর্ম সমন্বয়ের ভাবনাই প্রকাশ পায়।
"অপর পক্ষে, হিন্দুজাতিও এক হিসেবে মুসলমানদের মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহু প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্যের ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয়— অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non-violent- non co-operation। হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে বেড়া আরও কঠিন। মুসলমানধর্ম স্বীকার করে মুসলমানদের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথ অতিশয় সংকীর্ণ। আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখান করে না, হিন্দু সেখনেও সতর্ক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত না কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে টানতে পারেনি। আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধে সেতু, সেইখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে। আমি যখন প্রথম আমার জমিদারির কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম তখন দেখেছিলুম, কাছারিতে মুসলমান প্রজাকে বসতে দিতে হলে জাজিমের এক প্রান্ত তুলে দিয়ে সেইখানে তাকে স্থান দেওয়া হত। অন্য-আচার-অবলম্বীদের অশুচি বলে গণ্য করার মতো মানুষের সঙ্গে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনে এমন ভীষণ বাধা আর কিছু নেই। ভারতবর্ষের এমনই কপাল যে, এখানে হিন্দু মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে; ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয় আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যেদিকে দ্বার খোলা, অন্যপক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ।...'' (রাবীন্দ্রিক বানান বদল করা হয়নি)
সমগ্র লেখাটি পড়া যাবে এখানে।
আরও পড়ুন: নবী মহম্মদের নামে তৈরি ইসলামি সঙ্গীত ছড়াল কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বলে