প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বকালে বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে ভারতের ঋণ কি শূন্যয় নামিয়ে আনা গেছে?
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির কাছে ভারতের ঋণের বোঝা সোশাল মিডিয়ায় সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় মর্যাদার ওপর আঘাত বলা হচ্ছে ওই দেনাকে।
সোশাল মিডিয়ায় একটি ভাইরাল পোস্টে বলা হয়েছে যে ৬২ বছরে এই প্রথম বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে ভারতের সব ঋণ মিটে গেছে। কিন্তু এ দাবি সত্য নয়। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য বলছে ওই সংস্থার কাছে ভারতের ঋণের পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১,৫০০ কোটি ডলার। 'নরেন্দ্র মোদী' নামের এক ফেসবুক পেজে পোস্টটি প্রথম বেরয়। ওই পেজের ২১,০০০ ফলোয়ার আছে। তবে পেজটির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর কোনও সম্পর্ক নেই।
পোস্টটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন; আর্কাইভ সংস্করণের জন্য এখানে ।
বুম দেখে যে, বেশ কয়েকজন ফেসবুক আর টুইটার ব্যবহারকারী পোস্টটি শেয়ার করেছেন। আর নিজেদের ধারণাগুলিও প্রকাশ করেছেন সেই সঙ্গে।
ওই পোস্টটি বুমের হেল্পলাইনে (৭৭০০৯০৬১১১০) একাধিকবার আসে।
তথ্য-যাচাই
বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যে দুটি সংস্থা আছে — ইন্টারন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ রিকন্সট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আই আর ডি এ) এবং ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আই ডি এ)। আই আর ডি এ নিম্ন ও মাঝারি আয়ের দেশগুলিকে ঋণ দেয়। এবং আই ডি এ খুব গরিব দেশগুলিকে সুদ ছাড়া ঋণ বা গ্রান্ট দিয়ে থাকে। আরও জানতে এখানে পড়ুন।
পোস্টটিতে যা দাবি করা হয়েছে, তা যাচাই করতে বুম আই আর ডি এ এবং আই ডি এ-র দেওয়া ঋণের খতিয়ান খুঁটিয়ে দেখে। ব্যাঙ্কের দুই সংস্থার প্রদত্ত ঋণের হিসেবটা এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত।
আই আর ডি এ'র দেওয়া ঋণের তালিকায় দেখা যায় ভারত সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ১২৩ ধরনের ঋণ নিয়েছে এই সংস্থার কাছ থেকে। তার মধ্যে আছে সেই সব ধার যা ইতিমধ্যেই আই আর ডি এ দিয়ে দিয়েছে (বা দিতে চলেছে) এবং যেসব ঋণ ফেরত দেওয়ার কাজ চলছে।
সম্মিলিতভাবে আই আর ডি এ-এর কাছে ভারতের ঋণের পরিমাণ ১৪.৫৮ বিলিয়ন ডলার। যে সব ঋণ বাতিল ও ফেরত দেওয়া হয়ে গেছে, সেগুলি বাদ দিয়েই ওই অঙ্ক দাঁড়ায়।
প্রধান ঋণ প্রাপকরা হল 'কন্ট্রোলার অফ এইড, অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড অডিট'(সিএএএ)। এটি হল অর্থ মন্ত্রকের অধীনে ডিপার্টমেন্ট অফ ইকনমিক অ্যাফেয়ারস-এর একটি বিভাগ। এই বিভাগ ঋণপ্রদানকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে এবং সময় মত ঋণ শোধ দেওয়ার কাজেরও তদারকি করে। অন্যান্য ঋণ গ্রহণকারীদের মধ্যে আছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন, রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি ও আরও অনেকে।
ওই ঋণ এবং যে সব ঋণের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে, সেগুলির মধ্যে ১২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এখনও প্রদান করা বাকি আছে।
আই আর ডি এ-এর ঋণের সাম্প্রতিকতম তালিকা নীচে দেওয়া হল।
সিএএএ'র ওয়েবসাইটে এই ১২৩ টি অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেতে হলে, এখানে ক্লিক করুন। ঋণের এই লেজার ৮ মে ২০১৯ তারিখ অবধি আপডেট করা আছে আর ঋণের অঙ্ক মার্কিন ডলার ও ভারতীয় টাকায় দেখানো হয়েছে।
আই ডি এ
একমাত্র সিএএএ আইডিএ'র কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। নীচের তালিকায়, ভারতকে দেওয়া আইডিএ'র ঋণের হিসেব পাওয়া যাবে।
দেখা যাচ্ছে, ২৩ টি লোন অ্যাকাউন্ট আছে। এবং সেই খাতে ভারতের ঋণের পরিমাণ ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আরও ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ এখনও প্রদান করা বাকি আছে। এবং ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার'র আরও দুটি ঋণ, অনুমোদন পেয়ে গেছে।
অতএব, সোশাল মিডিয়ায় যাই দাবি করা হোক না কেন, তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে ভারতের ঋণের অঙ্ক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।
বুম বিশ্বব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতের ঋণের বিবরণ চেয়েছে। সেটি পাওয়া মাত্রই এই প্রতিবেদন আপডেট করা হবে।
বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণ সম্পর্কে বিরূপতা কেন?
এই প্রথম সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণ সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করলেন, এমন নয়।
নীচের পোস্টগুলি থেকে বোঝা যায় যে, বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণ সম্পর্কে অনেকেই কিরকম ধারণা পোষণ করেন । এখানে, গত তিন বছরে বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে কোনও ঋণ না নেওয়ার জন্য বাহবা দেওয়া হচ্ছে ভারতকে। তার ফলে নাকি বিশ্বব্যাঙ্কের আধিকারিকরা ভারতে এসে ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন।
বাস্তবে, বিশ্বব্যাঙ্ক ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে একটি বিশেষজ্ঞ সংস্থা। ঋণ পাওয়ার যোগ্য যারা, তাদেরকেই ঋণ বা আর্থিক সাহায্য দেয় তারা। সেই ঋণ আইবিআরডি'র মাধ্যমে আসতে পারে বা আইডিএ'র মাধ্যমে এইড/গ্রান্ট হিসেবেও আসতে পারে। সেই ঋণের টাকা বহু ধরনের উন্নয়নমূলক ক্ষেত্রে লগ্নি করা যেতে পারে। যেমন, রাস্তা তৈরি, সেচ ব্যবস্থা, সামাজিক পরিকাঠামো, বিপর্যয় মোকাবিলা, পরিচ্ছন্ন শক্তি ইত্যাদি।
ভারতের যে সব প্রকল্প বিশ্বব্যাঙ্ক সম্প্রতি অনুমোদন করেছে, তার মধ্যে আছে রাজস্থানে রাস্তা তৈরির কাজ, অন্ধ্রপ্রদেশে স্বাস্থ্য পরিষেবা আরও উন্নত করার প্রকল্প, সৌর শক্তি আর হাইব্রিড প্রযুক্তি ব্যবহার এবং উত্তরপ্রদেশে রাস্তা বিস্তারের প্রকল্প। এ সম্পর্কে আরও জানতে এখানে ক্লিক করুন।
বিশ্বব্যাঙ্কের কাজ হল উন্নয়নের ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য দেওয়া আর আইএমএফ'র দায়িত্ব হল আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখা। কোনও দেশ আর্থিক অসুবিধের মধ্যে পড়লে, আইএমএফ'র সাহায্য চায় সে দেশ।
তবে, আইএমএফ'র সাহায্যপ্রাপ্ত দেশ সেই টাকা কেমন ভাবে ব্যবহার করছে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৯১ সালে এক আর্থিক সঙ্কট থেকে ভারতকে উদ্ধার করেছিল আইএমএফ। আর এ বছর জুলাই মসে তারা পাকিস্তানকে আর্থিক সঙ্কট থেকে উদ্ধার করার জন্য ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাহায্য অনুমোদন করেছে। এই নিয়ে, ১৯৮০'র দশকের শেষ থেকে, পাকিস্তানকে ১৩ বার সাহায্য করতে হলো আইএসএফ-কে।