চিনে করোনাভাইরাস: যা যা জানা জরুরি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে যে, চিনে পাওয়া রহস্যময় করোনাভাইরাসের উৎস এবং সংক্রমণ পদ্ধতি এখনও নির্ণয় করা যায়নি।
যেসব ভারতীয়রা চিনে যাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে জানুয়ারি ১৭, ২০২০ (শুক্রবার), এক ভ্রমণ এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সতর্ক বার্তা জারি করেছে ভারত। চিনে এক নতুন ও রহস্যময় ভাইরাস দেখা দিয়েছে, যা নিউমোনিয়ার মত অসুখ ছড়াচ্ছে। ইতিমধ্যেই ২০০ সংক্রমণের ঘটনার কথা জানা গেছে। ভাইরাসটি চিনের পাশের দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং থাইল্যান্ডেও ছড়িয়ে পড়েছে। তাই জীবাণুটিকে রুখতে অনেক দেশ বিশেষ ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। ভাইরাসটির প্রথম আবির্ভাব চিনের উহানে। সেখানে প্রায় ৫০০ ভারতীয় ছাত্র ডাক্তারি পড়ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ১৭ জানুয়ারি একটি টুইট মারফত সতর্ক করে এবং সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলি ঘোষণা করে।
ভারতে অসুখটির সংক্রমণ রুখতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলি সম্পর্কে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে ওই মন্ত্রক। প্রায় সব বড় বিমানবন্দরগুলিকে এই মর্মে অনুরোধ করা হয়েছে যে, ভারতগামী যাত্রীদের তারা যেন পরীক্ষা করে এবং সংক্রমণের লক্ষণ দেখা গেলে, তা যেন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। পুনেতে অবস্থিত ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজি এই নতুন ভাইরাসের মোকাবিলা করতে সক্ষম। ২০১৪ সালে মিডিল ইস্ট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম করোনাভাইরাসকে আয়ত্তে এনেছিলেন যে সব বিশেষজ্ঞরা, এই ভাইরাসকেও বাগে আনার প্রশিক্ষণ রয়েছে তাদের।
সপ্তাহান্তে, উহানে ওই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ১৩৯ নতুন ঘটনা নথিভুক্ত হয়। তাছাড়া বেজিংয়ের ড্যাক্সিং জেলা ও দক্ষিণ চিনের শেনজেনের কিছু মানুষ, যারা উহান গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যেও ওই জীবাণুর লক্ষণ দেখা যায়।
ওই রহস্যময় ভাইরাসটি করোনাভাইরাস পরিবারের সদস্য। তাদের মধ্যে ছ'টি মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। নতুন ভাইরাসটি সম্ভবত সপ্তম সংযোজন। ভাইরাসটির উৎস এখনও জানা যায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চিনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন বলেছে, ভাইরাসটির উৎস যতক্ষণ না জানা যাচ্ছে, ততক্ষণ সেটি বিপজ্জনক হয়ে থাকবে। সেটির উৎস নির্দিষ্ট করা গেলে, সেটিকে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
শেজওয়ানে বসবাসকারী ৪৫ বছরের এক ভারতীয় শিক্ষিকাকে নিউমোনিয়ার মত অসুখের লক্ষণ সমেত, অচৈতন্য অবস্থায়, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, উনিই হলেন চিনে বসবাসকারী প্রথম বিদেশী যিনি ওই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে একটি করে সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। থাইল্যান্ডে ওই ধরনের লক্ষণ সমেত দুটি ঘটনার কথা জানা গেছে। সিঙ্গাপুর ও হংকং বিমানবন্দরে যাত্রীদের পরীক্ষা করার কাজ শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের তিন বিমানবন্দরেরে যাত্রীদের পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। সেগুলি হল লস অ্যাঞ্জেলস, নিউ ইয়র্ক ও স্যান ফ্র্যানসিস্কো।
কি এই ভাইরাস?
ভাইরাসটির নাম ২০১৯-নভেল করোনাভাইরাস (২০১৯-এনসিওভি)। এই ভাইরাসটির দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কি কি লক্ষণ দেখা যায়, তার একটা তালিকা প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তার মধ্যে আছে জ্বর, কাশি, নিশ্বাসের কষ্ট, নিউমোনিয়া, অ্যাকিউট রেস্পিরেটারি সিন্ড্রোম, কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়া এবং মৃত্যু।
ভাইরাসটি যাতে না ছড়ায়, তার জন্য চিনের স্বাস্থ্য আধিকারিকরা উহানের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আক্রান্ত ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ আলাদা রাখার ব্যবস্থা করেছেন।
করোনাভাইরাস সাধারণত শ্বাসনালীর ক্ষতি করে। সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা ও সিভিয়ারলি অ্যাকিউট রেস্পিরেটারি সিন্ড্রোম (সারস) অন্য ধরনের করোনাভাইরাসের লক্ষণ। অন্যান্য ধরনের প্রাণী থেকেই সেগুলি ছড়ায়। যেমন, সারস অসুখ যে করোনাভাইরাস থেকে হয়, ভাম (Chivet Cat) থেকে তা ছড়াই মানব শরীরে।
নতুন ভাইরাসটির উৎস এখনও জানা যায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এই ভাইরাস যে মানুষ থেকে মানুষে ছাড়ায় তার কোনও পরমান এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু এও বলা হয়েছে যে, যেহেতু ভাইরাসটি খুবই নতুন, তাই সেই সম্ভাবনাটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ভাইরাসটি যদি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াত, তাহলে যে সব স্বাস্থ্য কর্মী রুগীদের চিকিৎসা বা সেবা করছেন, তারাও আক্রান্ত হতেন। উহান বা বাজেরের কাছাকাছি না থাকা দুই ব্যক্তির মধ্যেও সংক্রমন দেখা দেওয়ায়, মানুষের সংস্পর্শে ছড়ায় কিনা তা নিয়ে সন্দিগ্ধ অনেকেই।ভাইরাসের গতিপথ
মনে করা হচ্ছে, উহা্নের একটি সামুদ্রিক মাছের বাজার থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। বাজারটির নাম 'হুনান সিফুড হোলসেল'। সংক্রমণের প্রথম কয়েকটি ঘটনার কথা ডিসেম্বর ২০১৯'এ জানা যায়।
যারা আক্রান্ত হন, তাদের সকলেরই ওই বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। যারা অন্য জায়গায় অসুস্থ হয়ে পড়েন, তারাও ওই সময় উহানে যাওয়া-আসা করেছিলেন। উহান চিনের একটি বিরাট পরিবহন কেন্দ্র।
ব্রিটেনে যে বিজ্ঞানীরা ওই ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা করছেন, তারা মনে করছেন সংক্রমণের ব্যাপ্তি কমিয়ে দেখান হচ্ছে। তাদের অনুমান, চিনে ১,৭০০'র মত সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। তারা মনে করছেন চিন হল নতুন নতুন ভাইরাসের আঁতুড়ঘর। তার কারণ সেখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং পশুখাদ্যের সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান।
স্বাস্থ্য কর্মীসহ সংক্রমিত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছেন এমন ৭৬৩ জনকে চিহ্নিত করেন স্বাস্থ্য আধিকারিকরা। ২০১৯-এনসিওভি-র লক্ষণ আছে কিনা তা দেখার জন্য তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। পরে তাদের মধ্যে ৬৪৪ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকিদের চিকিৎসা চলছে।
বর্তমানে ওই সামুদ্রিক খাবারের বাজারটি জীবাণুমুক্ত করার জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। চিন কর্তৃপক্ষ বিমানবন্দরসহ দেশের নানা জায়গায় শরীরের তাপমাত্রা স্ক্যান করার যন্ত্র বসিয়েছেন। এই ভাইরাসকে ঠেকানোর অন্যান্য উপায়গুলির মধ্যে রয়েছে ডিম ও মাংস রান্না করা, প্রতিষেধক দেওয়া হয়নি এমন প্রাণীদের থেকে দূরে থাকা এবং সর্দি-কাশিতে ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের খুব কাছে না যাওয়া।