ভুয়ো বার্তা: মাইক্রোয়েভে রান্না ক্যান্সারের কারণ তাই জাপানে নিষিদ্ধ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে মাইক্রোয়েভ বিকিরণ যন্ত্রের ভিতরে থাকা খাদ্যবস্তুতে ছড়ায় না শুধু ভেতরের খাবারকে গরম করে।
ক্যান্সার ছড়ায় বলে জাপান (Japan) এ বছরের শেষ দিকে মাইক্রোয়েভ (Microwave) চুল্লির উত্পাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করছে বলে ভাইরাল হওয়া একটি বার্তা সম্পূর্ণ ভুয়ো। কেননা জাপান সরকার যেমন এ ধরনের কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি, তেমনই এটাও প্রমাণিত হয়নি যে মাইক্রোয়েভ বিকিরণ ক্যান্সার (Cancer) রোগের কারণ।
এই ভুয়ো বার্তাবাহী পোস্টটি দাবি করেছে যে, এ বছরের শেষ দিকেই মাইক্রোয়েভ চুল্লির বিদায়ঘন্টা বেজে যাবেl তবে গত বেশ কয়েক বছর ধরেই এমন বার্তা ঘুরছেl বার্তাটিতে হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের নাম নিয়ে বলা হচ্ছে যে, তাঁরা নাকি মাইক্রোয়েভ থেকে নিঃসৃত বেতার তরঙ্গের ক্ষতিকর দিক নিয়ে চর্চা করেছেন এবং ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে ফেলা পরমাণু বোমার বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট তীব্র উত্তাপের সঙ্গে এর তুলনা করেছেন।
বুম দেখেছে, এই ভুয়ো দাবিটি আসলে রাশিয়ার একটি প্যারডি সাইট থেকে পাওয়া যায়, যা সোশাল মিডিয়া পরে ছড়িয়ে দেয়।
পোস্টটির আরও দাবি, কাশিরা ক্যান্সার সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে নাকি মাইক্রোয়েভে প্রস্তুত খাবার না খাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গুগল সার্চ-এ তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও কাশিরা সেন্টারে এ ধরনের কোনও সম্মেলনের খবর পাওয়া যায়নি। এমনকী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও জানিয়েছে যে মাইক্রোয়েভ থেকে ক্যান্সার ছড়ানোর দাবির মধ্যে কোনও সত্যতা নেই।
বার্তাটির সত্যতা নিরূপণের অনুরোধ জানিয়ে বুম-এর হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন নম্বরেও একাধিক বার্তা এসেছে:
ফেসবুকেও দাবিটি ভাইরাল হয়েছে।
আরও পড়ুন: ভুয়ো খবর: ফাইজার অধিকর্তা বুর্লাকে এফবিআই প্রতারণায় গ্রেফতার করেনি
তথ্য যাচাই
বুম দেখে আই এ প্যানোরমা নামে একটি ব্যঙ্গাত্মক রুশ ওয়েবসাইট হচ্ছে এই বার্তাটির উত্স। এখানে প্রকাশিত প্রতিটি প্রতিবেদনের শেষেই লেখা থাকে যে, এগুলি ব্যঙ্গ পরিহাসের ছলে লেখা এবং এর মধ্যে সত্যের লেশমাত্র নেইl সেই বার্তাটির অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: "এই সাইটে প্রচারিত সব লেখাই সত্যের বিদ্রূপাত্মক অনুকরণ, এবং যথার্থ সত্য নয় l"
জাপান সরকারের সরকারি ওয়েবসাইটেও বুম খোঁজ করে দেখেছে, সেখানে মাইক্রোয়েভ-এ নিষেধাজ্ঞার কোনও নির্দেশ নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য-বিবৃতির আর্কাইভ বয়ানেও লেখা রয়েছে যে মাইক্রোয়েভ চুল্লির ব্যবহার নিরাপদ এবং এ থেকে ক্যান্সার হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেইl তাতে আরও লেখা আছেঃ "মাইক্রোয়েভ চুল্লি এমন ভাবেই তৈরি যে যন্ত্রটিতে যখন খাবার গরম করা হয় এবং তার দরজা বন্ধ করে সুইচ অন করা হয়, তখন তরঙ্গের বিকিরণ যন্ত্রটির ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে l কাচের দরজার চারপাশে বা ফাঁক দিয়ে কোনও তরঙ্গ গলে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, এমন ভাবেই এগুলি তৈরি l বেরলেও তা বিপদসীমার ওপরে যায় না l তবে তা সত্ত্বেও বিকিরণ বাইরে বেরতে পারে, যদি যন্ত্রটি পরিষ্কার না করা হয়, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা না হয় কিংবা যন্ত্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে l তাই মাইক্রোয়েভ যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ খুবই জরুরি l"
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও জানিয়েছে যে, কোনও পাত্রে মজুত রাখা মাইক্রোয়েভে রান্না খাবারও বিকিরণ-দোষে দুষ্ট হয় না।
আমেরিকান সোসাইটি অফ ক্লিনিকাল অঙ্কোলজিও এই দাবিটিকে ভুয়ো বলে নস্যাত্ করে দিয়েছেl সংস্থাটির বক্তব্য, "যত ক্ষণ মাইক্রোয়েভ চুল্লির দরজা বন্ধ থাকে, তত ক্ষণ বিকিরণ চুল্লির ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে l বস্তুত, চুল্লি গুলো তৈরিই হয় এমন ভাবে যে, দরজা ঠিক মতো বন্ধ থাকলে, তবেই যন্ত্রটি কাজ করে l তা ছাড়া, মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এ ব্যাপারে খুব কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করে যা চুল্লি নির্মাতারা মেনে চলতে বাধ্য-- যেমন চুল্লির দরজা খোলা থাকলে যাতে সেটি কাজ না করে, সেটা নিশ্চিত করতে দু-দুটি স্বতন্ত্র সেফটি-লক চুল্লিতে রাখা থাকে l"
ভুয়ো বার্তাটিতে আরও প্রচার করা হয়েছে, কাশিরা ক্যান্সার সেন্টারে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ক্যান্সার থেকে নিরাপদ থাকার যে সব পন্থা সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল মাইক্রোয়েভ চুল্লি থেকে দূরে থাকাl বুম কিন্তু এ ধরনের কোনও সম্মেলন সংক্রান্ত খবর কিংবা কাশিরা ক্যান্সার কেন্দ্র নামে কোনও সংস্থার অস্তিত্বও খুঁজে পায়নি।
এই প্রথম যে ক্যান্সার নিরোধক কোনও ব্যবস্থা হিসাবে কোনও যন্ত্রের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা সুপারিশ নিয়ে বার্তা ভাইরাল হলো, এমন নয়l বুম অতীতে এ ধরনের অনেক ভুয়ো খবরের পর্দাফাঁস করেছে, যথা: গরম লেবুর জল ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলে, কিংবা কালো রসুন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি কমায়, কিংবা তিন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর দাবি, ক্যান্সার ওষুধ ছাড়াই সারানো যায় অথবা গরম ডাবের জল খেলে ক্যান্সার কোষ মরে যায়, ইত্যাদি।
আরও পড়ুন: ভুয়ো বার্তা: থ্রম্বোসিস কোভিড মৃত্যুর প্রধান কারণ খুঁজে পেল সিঙ্গাপুর