কলকাতা পুলিশ কী সোশ্যাল মিডিয়া ও ফোনে নজরদারি চালাচ্ছে?
না, কলকাতা পুলিশ এরকম কোনও নজরদারি চালায়নি। ২০১৮ সালেই ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের এই ভুয়ো বার্তাটি সম্পর্কে অবহিত করে কলকাতা পুলিশ।
হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল হওয়া একটি মেসেজে দাবি করা হয়েছে, কলকাতা পুলিশের তরফে ফোন কল রেকর্ডিং ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি চালানো হচ্ছে। পোস্টটিতে আরও লেখা হয়েছে,‘‘সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ মনিটরিং করা হবে। ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণদিত যেকোনো রাজনৈতিক লেখা ও পোস্ট বা বিতর্ক সভা এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ওয়ারেন্ট ছাড়াই আপনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার হতে পারেন।’’
‘‘..উল্টোপাল্টা উস্কানিমূলক পোস্ট দেখলেই, স্ক্রিনশট নিয়ে পোস্টের লিঙ্ক কপি করে Kolkata Police এর অফিসিয়াল পেজের ইনবক্সে দিয়ে আসুন।’’ এই মেসেজটির সঙ্গে কলকাতা পুলিশের অফিশিয়াল ফেসবুক অ্যাকাউন্টের লিঙ্ক দেওয়া হয়েছে।
হোয়াটসঅ্যাপ বার্তাটির সত্যতা জানতে বুমের হেল্পলাইনে (৭৭০০৯০৬১১১) একজন পাঠক আমাদের এই ভাইরাল হওয়া মেসেজটি পাঠেয়েছিলেন।
তথ্য যাচাই
কলকাতা পুলিশের কাছে টুইট করে একই বার্তাটি একজন টুইটার ব্যবহারকারী, এই নির্দেশিকার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। কলকাতা পুলিশ ওই টুইটের প্রত্যুত্তরে এটিকে ভুয়ো তথ্য হিসাবে বর্ণনা করেছে।
ওই টুইটের সঙ্গে ২০১৮ সালের ১১ মার্চের কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পোস্টের একটি লিঙ্ক শেয়ার করা হয়েছে। ওই পোস্টটিতে কলকাতা পুলিশ জানিয়েছিল, ‘‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। নীচের মেসেজটি ফোনে ফোনে ঘুরছে। অনেকে জানতে চাইছেন, সত্যি কিনা। সত্যি নয়। নীচের মেসেজটি সর্বৈব মিথ্যা। ’’
‘‘যে বা যাঁরা এই বার্তার উৎস, যাঁরা ছড়াচ্ছেন এই মিথ্যে, চিহ্নিত করে কড়া ব্যবস্থা নেব।’’
কী বলা আছে আইনে
ফোনের কথা বার্তা রেকর্ডিং করার পদ্ধতিকে বলা হয় ফোন ট্যাপিং। ১৯৩৫ সালের আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যও কিছু বাধ্যবাধকতা সহ, কেন্দ্র সরকারের পাশাপাশি চাইলে ফোন ট্যাপ করতে পারে। ইন্ডিয়ান টেলিগ্রাফ আইনের ৫(২) নং ধারা অনুযায়ী কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ফোনের কথাবার্তা ট্যাপ করতে চাইলে তদন্তকারী সংস্থাকে বা বিভাগকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রালয়ের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। অনুমোদনের আবেদনে নির্দিষ্ট করে কারন দর্শাতে হয়। আবেদন পর্যালোচনা করে ট্যাপিংয়ের যথাযথ গুরুত্ব বিবেচনা করে তবেই অনুমোদন পাওয়া যায়। ফোনে আড়িপাতার আগে যথাযত অনুমোদনের স্লিপ পূরণ করতে হয়। রাজ্যের ক্ষেত্রে রাজ্য সচিবের দস্তাখত প্রয়োজন। বিস্তারিত পড়া যাবে এখানে।
সংবিধানের ১৯(১) নং ধারায় যেমন বাক্-স্বাধীনতাকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। তেমনই অসামাজিক কাজকর্ম ও অপরাধ রুখতে রয়েছে প্রয়োজনীয় সোশ্যাল মিডিয়া আইন। অনলাইন অ্যাবিউজ ও তার সংশ্লিষ্ট আইন নিয়ে বিস্তারিত ন্যায়-এর আইনি সংস্থানগুলি পড়া যাবে এখানে।
তবে হোয়াটসঅ্যাপের বার্তা বিশেষভাবে এনক্রিপটেট হওয়ায় সংশ্লিষ্ট বার্তার উৎস চিহ্নিত করার কারিগরি ও আইনি সীমাবদ্ধতা আছে। হোয়াটসঅ্যাপের বার্তা গ্রাহক ও প্রাপকের কাছে একদমই গোপনীয়ভাবে পৌছায়। এপর্যন্ত তৃতীয় কোনও ব্যক্তির পক্ষে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠোদ্ধার করা সম্ভবপর নয়।
গ্রেফতারির কিছু সাম্প্রতিক নজির
এবছরের জুন মাসে অসমে নিতু বোরা নামে এক বিজেপি আইটি সেল কর্মীকে ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক মন্তব্যের জন্য গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৫ জুন ২০১৯ কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের নামে ভুঁয়ো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চালানোয় পুলিশ তরুন কুমার ঘোষ নামে এক ব্যক্তিকে নদীয়ার নবদ্বীপ থেকে গ্রেফতার করেছে। ২০১৭ সালে আসানসোলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো ভিডিও ও ছবি পোস্ট করার অপরাধে তরুন সেনগুপ্ত নামে বিজেপির এক আইটি সেল কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
এবছরের ২৬ এপ্রিল অনুপম পাল নামে এক ব্যক্তিকে ত্রিপুরা পুলিশ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের পারিবারিক জীবন নিয়ে জাল ফেসবুক প্রোফাইল ও ভুয়ো খবর প্রচারের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন এখনও।
লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন প্রিয়ঙ্কা শর্মা নামে এক বিজেপি কর্মীকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে মিম তৈরির জন্য গ্রেফতার করে রাজ্যের পুলিশ। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য পুলিশকে ভৎসর্না করে প্রিয়াঙ্কাকে জামিনের নির্দেশ দেয় এবং ওই বিজেপি কর্মীকে ক্ষমা চাইতে বলে। গ্রেফতারির ব্যাপারে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, পুলিশ নির্বাচন কমিশনের অধিন। এই গ্রেফতারির ঘটনায় তার কোনও ভূমিকা নেই। দ্য অয়ার-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন একথা।
এমাসের প্রথমে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী অদিত্যনাথ সম্পর্কে সম্মানহানিকর ভিডিও শেয়ার করার অপরাধে প্রশান্ত কানোজিয়া নামে এক সাংবাদিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। সুপ্রিম কোর্ট উত্তরপ্রদেশ পুলিশকে ভৎর্সনা করে ও সত্বর প্রশান্তের মুক্তির নির্দেশ দেয়।
২০১৭ সালে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অভিজিত মিত্র-আইয়ারকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনারকের সূর্য মন্দির সম্পর্কিত ধর্মীয়ভাবাবেগে আঘাত করা ভিডিও পোস্টের অপরাধের জন্য ওড়িশা পুলিশ গ্রেফতার করে। সুপ্রিম কোর্ট তাকে প্রথমে জামিন দিতে অস্বীকার করে। পরে ওড়িশা বিধানসভা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তুলে নিলে তিনি মুক্তি পান।
বুম ২০১৮ সালে এরকম একটি বার্তা খন্ডন করেছিল।