চক্রান্তের সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্ক উস্কেছে নিউজএক্স, এর মূলে ফেসবুক পোস্ট
ফেসবুক পোস্টটি প্রমাণ করে যে, বন্দুকবাজ ২০১৮’য় পাকিস্তানে গিয়েছিল। আর জল্পনা-কল্পনা উস্কে দিয়ে নিউজএক্স বলতে চেয়েছে যে, ট্যারান্টের ওই সফর ও মসজিদ আক্রমণের মধ্যে সম্পর্ক আছে।
![](https://bangla.boomlive.in/wp-content/uploads/sites/3/2019/03/NewsX-Debate.jpg)
একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে, ইংরেজি টেলিভিশন সংবাদ মাধ্যম ‘নিউজএক্স’ গত সপ্তাহে এক ঘন্টার এক বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তাতে নানা রকমভাবে বলার চেষ্টা করা হয় যে, ব্রেন্টন হ্যারিসন ট্যারান্ট, যে নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে গুলি চালিয়ে ৫০ জনকে হত্যা করে, সে পাকিস্তানের প্রক্সি হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে।
ছাপান্ন মিনিটের ওই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় মার্চ ১৫, ২০১৯। সে দিনই আক্রমণ হয় ক্রাইস্টচার্চে। শুরুতেই চ্যানেলটি অক্টোবর ২০১৮’র একটি ফেসবুক পোস্টের ছবি দেখায়। তাতে ট্যারান্ট’র ছবি ছিল।
![](https://bangla.boomlive.in/wp-content/uploads/sites/3/2019/03/Osho.jpg)
পাকিস্তানের এক হোটেল মালিক সৈয়দ ইশার হুসেনের টাইমলাইনে ফেসবুক পোস্টটি আবিষ্কার করেন সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা। অল্প সময়ের মধ্যেই সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলি সেটি তুলে নেয়। কিন্তু নিউজএক্স সেটিকে আবিষ্কার করার কৃতিত্ব দেয় অস্ট্রেলিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্টকে।
“আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে পর্যটনকে উৎসাহ দিতে আর তাকে কার্যকর করে তোলার জন্য পাকিস্তান সরকার ও ইমরান খান ভিসা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করবেন, যাতে বিশ্বের মানুষ পাকিস্তানের সৌন্দর্য দেখার জন্য এদেশে আসতে পারে।” (ফেসবুক পোস্টের অংশবিশেষ)।
ফেসবুক পোস্টটি প্রমাণ করে যে, ওই বন্দুকবাজ ২০১৮’য় পাকিস্তানে গিয়েছিল। কিন্তু নিউজএক্স অনুমান আর জল্পনার ভিত্তিতে বলার চেষ্টা করে যে, ট্যারান্ট’র পাকিস্তান সফর এবং তার হামলার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে।
চ্যানেলটি লিখিত গ্রাফিক ব্যবহার করে। তাতে লেখা হয়: “একক বন্দুকবাজ নাকি পাক প্রক্সি”, “ব্যবহৃত বন্দুক ফেসবুকে ছিল”, আর “অসি (অস্ট্রেলিয়া) মিডিয়া যোগাযোগ ফাঁস করে দিয়েছে”। সেই সঙ্গে একজন রিপোর্টার পাকিস্তানের ম্যাপ ধরে দেখিয়ে দেন, যে হোটেলে ট্যারান্ট ছিল, তার অবস্থান।
বুম নিউজএক্সকে একটি প্রশ্নাবলি পাঠিয়েছে। তার উত্তর পাওয়া মাত্রই আমরা এই রিপোর্ট আপডেট করব।
নিউজএক্সে’র উদয় প্রতাপ সিং দাবি করেন যে, ‘এক পাকিস্তানি সন্ত্রাসী সম্পর্ক’ দেখা গেছে। আলোচনাটি এগোয় এই ভাবে:
দেবিকা চোপরা (রিপোর্টার): একটি পাকিস্তানি সম্পর্কের কথা প্রতিষ্ঠা করা গেছে। তবে আমরা স্পষ্ট করে দিতে চাই যে, অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্টেই সে কথা বলা হয়েছে।
উদয় প্রতাপ সিং (অ্যাঙ্কার): স্পষ্টতই, একটা পাকিস্তানি জঙ্গি সম্পর্ক ফুটে উঠছে। তার সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসি আক্রমণের যোগ আছে, যাতে ৪৯ জন মারা গেছেন।
এর পরই, উপস্থিত প্যানেলিস্টদের জন্য আলোচনা খুলে দেন অ্যাঙ্কার।
বিতর্ক যতই গড়ায়, ততই নানা তত্ত্ব সামনে আসতে থাকে। যেমন, বলা হয় ওই বন্দুকবাজ আসলে পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) এক ‘স্লিপার সেল’ বা ঘুমন্ত সেলের সদস্য।
এবং পুলওয়ামার ঘটনা থেকে দৃষ্টি সরাতেই ওই আক্রমণ সংগঠিত করা হয়। এমনকি বিতর্কে অংশগ্রহণকারীরা অভিযুক্তের ধর্ম নিয়েও প্রশ্ন তোলেন, এবং শুধুই বিদ্বেষের কারণেই ওই ঘটনা ঘটানো হয়েছে কি না সে বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন।
![](https://bangla.boomlive.in/wp-content/uploads/sites/3/2019/03/Add-a-heading-768x384-700x350.jpg)
থিওরি-১: “পুলওয়ামা থেকে দৃষ্টি ঘোরানো”
অ্যাঙ্কার (উদয়): শেষমেশ, ঘটনাটি আরও অনুসন্ধান দাবি করে। শুটিংটা তো মাত্র ১২ ঘন্টা আগে হয়েছে। আপনি তো এখন জানেন, স্যার, যে একটা পাকিস্তানি যোগাযোগ বেরিয়ে আসছে। এই সম্পর্কে আপনার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, স্যার। কারণ, পাকিস্তান তো সন্ত্রাসের ঘাঁটি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। আর একথা শুধু ভারত বলছে না, সারা বিশ্ব…
বক্তা (এয়ার মারশাল চোপরা): নিছকই এটাকে একটা বিদ্বেষজনিত সন্ত্রাস হিসেবে দেখলেও, একজন একটা বন্দুক তুলে নিচ্ছে—শুনেছি সে একটা একে-৪৭ রাইফেল কিনে ছিল—পুলওয়ামার সঙ্গে পাকিস্তানের যোগাযোগ থেকে বিশ্বের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে বেশ কিছু সম্ভাব্য তাৎপর্য…
থিওরি-২: বিদেশিদের র্যাডিকালাইজ করার অ্যঙ্গেল
অ্যা্ঙ্কার (উদয়): বিদেশিদের র্যাডিকালাইজ (বা জঙ্গিআয়ন) করার বিষয়টায় আমি ফিরে আসতে চাই। লেফ্টেনেন্ট জেনারেল মেথা যেমন বললেন, তেমনটা আগেও হয়েছে, ডেভিড হ্যালির ক্ষেত্রে। কিন্তু আরও অনেক বিদেশিকে র্যাডিকালাইজ করা হয়েছে, বিশেষ করে পাকিস্তানে, তাই নয় কি? সেই জন্যই বিষয়টা আরও তদন্ত করা প্রয়োজন।
বক্তা (প্রতিকৃত): তাদের সে রকমই একটা কর্মসূচি আছে। আর সেটা বেশ সুসংগঠিত। আইএসআইএস-কেই দেখুন না। ইয়োরোপের অনেকেই তো তাদের কাছে গিয়ে জঙ্গিয়ানা অর্জন করেছে, তা সে যে কারণেই হোক না কেন…
থিওরি-৩: পাকিস্তান-আইএসআই বিষয়
বক্তা (কমোডোর সোধি): ওই ভদ্রলোকটির, অভিযুক্ত ব্যক্তিটির, নাম তদন্ত করা উচিৎ তাদের। তার ধর্ম কি এক, নাকি ভিন্ন? তার উদ্দেশ্যটা কি? সে কেন এসেছিল? পাকিস্তানে কাদের সঙ্গে দেখা করেছিল। আইএসআই কি তাকে জঙ্গি করে তুলেছিল? এই সূত্রটা প্রকাশ হওয়া উচিৎ। ওই তিন জন কারা, আইএসআই তাদের একত্রিত করেছিল…
থিওরি-৪: ‘হেট ক্রাইম’ বা বিদ্বেষজনিত অপরাধ মেলানো যাচ্ছে না
বক্তা: দেখুন উদয়, আপনি বিদ্বেষজনিত অপরাধের কথা বলেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, সেই অপরাধের কথা ধরে নিলেও, এখানে একজন ব্যক্তি পাকিস্তান যাচ্ছে, পাকিস্তানের প্রশংসা করছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করছে, এবং এই ঘটনাটা সে একটা মসজিদে ঘটাচ্ছে — এই সব মেলানো যাচ্ছে না।
অ্যাঙ্কার: হুঁ, ঠিকই বলছেন, মেলানো যাচ্ছে না।
তথ্য যাচাই
নিউজএক্স দাবি করে যে, হোটেল মালিকের নাম ‘ইশার ওশো থাঙ্গ’। কিন্তু ‘ওশো থাঙ্গ’ পাকিস্তানের গিলগিট-বাল্টিস্তান অঞ্চলে একটি রিসর্টের নাম।
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ ইশার ওশো থাঙ্গ’র মালিক ইশার হুসেনের সঙ্গে পাকিস্তানের মিনাপিন’এ যোগাযোগ করে। হুসেন খবরের কাগজটিকে জানান যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি এক ‘ব্যাকপ্যাকার’দের দলের সঙ্গে সেখানে দু/তিন দিন ছিলেন।
বুম ইশারের সঙ্গে ফেসবুক মারফত যোগযোগ করে। কিন্তু উনি কোনও উত্তর দেননি।
![](https://bangla.boomlive.in/wp-content/uploads/sites/3/2019/03/Israr-bio-2.jpg)
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ তাদের রিপোর্টে জানায় যে, অভিযুক্তের যা নাম, সেই একই নামের এক ব্যক্তি অক্টোবর মাসে দুটি হোটেলে থাকে পাকিস্তানে।
![](https://bangla.boomlive.in/wp-content/uploads/sites/3/2019/03/post-444x365.jpg)
হামলার পর থেকে ট্যারান্ট’র ভ্রমণ বৃত্তান্ত খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। পাকিস্তান ছাড়াও সে তুরস্ক, বুলগেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়ায় ভ্রমণ করেছে। কিন্তু নিউজএক্স’র বিতর্কে সে কথা উল্লেখ করা হয়নি।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ তাদের রিপোর্টে বলে যে, ট্যারান্ট তার ম্যানিফেস্টোতে নিজের ভ্রমণ সম্পর্কে ইতিবাচক কথাই লেখে। কিন্তু ২০১৭’য় স্টকহোম একজন উজবেক আশ্রয়প্রার্থী একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ট্রাক দিয়ে ধাক্কা মারলে সাত ব্যক্তি মারা যান। সেই ঘটনাই অভিবাসন সম্পর্কে তার মনোভাব কঠোর করে।
“ম্যানিফেস্টোতে সে লেখে কী ভাবে ২০১৭ সালে ইয়োরোপ সফরকালে অভিবাসন সম্পর্কে তার মনোভাব ‘নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়’ — একটা অভিজ্ঞতা যা তাকে উগ্রপন্থী করে তোলে। ওই সফরে, সে ফ্রান্স, পোর্তুগাল ও অন্যান্য জায়গায় যায়। কিন্তু স্টকহোমে একটি ট্রাক হামলা তাকে আতঙ্কিত করে। ওই কান্ডে একটি বাচ্চা মেয়ে নিহত হয়,” জানিয়েছে পোস্ট।
অভিযুক্ত বন্দুকবাজের ম্যানিফেস্টো
সে হামলা করার আগে ৭৪-পাতার একটি ম্যানিফেস্টো অনলাইনে পোস্ট করে। “ওই ডকুমেন্টে, যেটির সে নাম দেয় ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ (মহা প্রতিস্থাপন), তাতে সে নিজেকে এক ‘সাধারণ পরিবারের সাধারণ শ্বেতাঙ্গ’ বলে বর্ণনা করে, আর বলে যে ‘নিজের মানুষের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আমি একটা অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই’,” রিপোর্ট করে ‘দ্য গার্ডিয়ান’।
দক্ষিণপন্থী উগ্রপন্থা একটি কারণ
অনেক রিপোর্টে, ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’ বা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ আর দক্ষিণপন্থী উগ্রপন্থাকে ওই আক্রমণের কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ঘটনাটিকে একটি “হিংসাত্মক, উগ্রপন্থী, দক্ষিণপন্থী উগ্রবাদী আক্রমণ” বলে বর্ণনা করেন।