লোকসভা নির্বাচনের চতুর্থ পর্যায়ঃ বেগুসরাই, আসানসোল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র
লোকসভা ভোটের চতুর্থ পর্যায়ের প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী প্রার্থীরা অনেকেই কংগ্রেসের, আর সবচেয়ে বেশি ফৌজদারি মামলা রয়েছে শাসক এনডিএ শিবিরের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের চতুর্থ পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তরুণ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ। এবারকার প্রার্থীদের ৯.৫৯ শতাংশেরই বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ।
এই দফায় মাত্র ৭২টি আসনে ভোটগ্রহণ হচ্ছে, মোট ৭ দফার ভোটের মধ্যে সবচেয়ে কম আসনে । কিন্তু সবচেয়ে বড় নির্বাচনী লড়াইগুলির কয়েকটি এই পর্যায়েই ঘটতে চলেছে ।
এর মধ্যে ৩১টি আসনেই লাল সতর্কীকরণ চিহ্ন ঝুলিয়ে দেওয়া যায়, যেখানে অন্তত তিনজন করে প্রার্থী তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ঝুলে থাকার কথা নিজেরাই কমিশনকে দেওয়া হলফনামায় ঘোষণা করেছেন । ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত প্রার্থীর সংখ্যাতেও আগের তিনটি পর্যায়কে ছাপিয়ে গিয়েছে এবারের পর্যায় ।
প্রার্থীদের সম্পর্কে জানতে বুম গণতান্ত্রিক সংস্কার সমিতির রিপোর্টের সাহায্য নিয়েছে, যাতে কমিশনকে পেশ করা ৯৪৩ জন প্রার্থীর হলফনামার মধ্যে ৯২৮টিই পর্যালোচিত হয়েছে ।
চতুর্থ পর্যায়ের এই প্রার্থীরাই আবার তুলনামূলকভাবে বেশি শিক্ষিতও বটে, অন্তত অর্ধেক প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম গ্র্যাজুয়েট ।
অপরাধের খতিয়ান
চতুর্থ পর্যায়ের লোকসভা ভোটের প্রার্থীদের মধ্যে স্বঘোষিত প্রমাণিত অপরাধীর সংখ্যা ১২ । তৃতীয় পর্যায়ে এই সংখ্যাটা ছিল ১৪ এবং প্রথম পর্যায়ে ১২ ।
নির্দিষ্ট অপরাধের মামলাঃ প্রার্থীদের সংখ্যা
অর্ধেকেরও বেশি আসনে (৭২-এর মধ্যে ৩৭টি আসনে) অন্তত ৩জন করে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে ।
লাল সতর্কীকরণ যুক্ত আসনগুলিঃ চতুর্থ পর্যায়
এই নির্বাচনে এবারই প্রথম ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত প্রার্থীদের সংখ্যায় শাসক এনডিএ শিবিরের দলগুলি শীর্ষস্থান দখল করেছে । সবার উপরে রয়েছে শিব সেনা, যার ৫৭ শতাংশ প্রার্থীর বিরুদ্ধেই আদালতে ফৌজদারি মামলা ঝুলছে, যার মধ্যে ৪৩ শতাংশের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলি রীতিমত গুরুতর ।
এ ব্যাপারে বিজেপি যে খুব পিছনে পড়ে আছে, এমনটা ভাবার কারণ নেই । এই দলের প্রার্থীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ৩৪ শতাংশের অপরাধ খুবই গুরুতর ।
তবে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় এবারের বিস্ময়কর অন্তর্ভুক্তি নির্দল প্রার্থীদের —প্রায় ১৭ শতাংশ নির্দল প্রার্থীও কোনও-না-কোনও ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত, যার মধ্যে ১৩ শতাংশের অপরাধ বেশ গুরুতর ।
গণতান্ত্রিক সংস্কার সমিতির সংজ্ঞা অনুযায়ী গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ হলঃ
১)৫ বছর বা তার বেশি শাস্তি কিংবা জামিন-অযোগ্য কোনও অপরাধ
২)ভোটদাতাদের ঘুষ দেবার মতো কোনও নির্বাচনী অপরাধ
৩)হামলা, খুন, অপহরণ বা ধর্ষণ
৪)১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন লঙ্ঘনজনিত অপরাধ
৫)দুর্নীতি-নিরোধ আইনে চিহ্নিত দুর্নীতির অপরাধ
চতুর্থ পর্যায়ের ভোটে টাকা কীভাবে কথা বলছে
আগের তিনটি পর্যায়ের তুলনায় এবারের প্রার্থীরা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল । গণতান্ত্রিক সংস্কার সমিতি প্রার্থীদের সম্পদ অনুযায়ী ৫টি শ্রেণিতে তাদের ভাগ করেছে, যার মধ্যে ৬১ শতাংশ প্রার্থীই নিচের দুটি শ্রেণিতে পড়েছে । এদের প্রত্যেকের ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ ৫০ লক্ষ টাকার কম l আগের দুটি পর্যায়ের ভোটে এই শতাংশ ছিল যথাক্রমে ৬৪ ও ৬৫ শতাংশ ।
এই পর্যায়ের প্রার্থীদের মধ্যে কংগ্রেস প্রার্থীদের গড় সম্পদের পরিমাণ ২৯ কোটি টাকা, আর বিজেপি প্রার্থীদের গড় সম্পদের পরিমাণ ১৩ কোটি টাকা ।
এই তালিকায় সকলকে অবাক করে ঢুকে পড়েছে ২০১৮ সালে প্রকাশ আম্বেদকর প্রতিষ্ঠিত বঞ্চিত বহুজন আগাধি । এই দলের একজন প্রার্থীই এই পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ঘোষিত সম্পদের মালিক । তবে তা ছাড়াও আরও ১৭ জন দলীয় প্রার্থীর প্রত্যেকেরই সম্পদের গড় পরিমাণ ৯ কোটি টাকা ।
আর দল-নির্বিশেষে সব প্রার্থী মিলিয়ে গড় সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সব দল কিন্তু সমসংখ্যক প্রার্থী মনোনীত করেনি । কংগ্রেস ও বিজেপি যেখানে ৫৭ জন করে প্রার্থী মনোনীত করেছে, শিব সেনা সেখানে ২১ জন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে, আর তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি এবং শরদ পাওয়ারের এনসিপি যথাক্রমে ১১, ১০ ও ৭ জন প্রার্থী দিয়েছে ।
মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের পুত্র কংগ্রেসের নকুল নাথ তাঁর বাবার আসন ছিন্দওয়ারা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন । এই পর্যায়ের প্রার্থীদের মধ্যে তাঁর ঘোষিত সম্পদের পরিমাণই সর্বোচ্চ —৬৬০ কোটি টাকা । আবার শিব সেনার দুই প্রার্থী ঘোষিত সম্পদের নিরিখে প্রথম দশ প্রার্থীর মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন, যা এই প্রথম ঘটল ।
ঘোষিত সম্পদ অনুযায়ী প্রথম ১০ প্রার্থী
চতুর্থ পর্যায়ের ভোটগ্রহণ পর্বে রাজনৈতিক পরিবারের বংশধর এবং সেলিব্রিটিরাও শীর্ষে । তালিকার শীর্ষে থাকা নকুল নাথের কথা আগেই বলা হয়েছে । তাঁর ঠিক পিছনেই রয়েছেন প্রাক্তন কংগ্রেস রাজনীতিকদের সন্তান —প্রিয়া দত্ত এবং মিলিন্দ দেওরা । প্রাক্তন অভিনেত্রী এবং রাজনীতিতে নবাগত ঊর্মিলা মাতণ্ডকরও তালিকার উপর দিকেই রয়েছেন । এই শ্রেণিতে প্রথম ৫টি স্থানই কংগ্রেসের দখলে ।
বিশিষ্ট সেলিব্রিটি, রাজনৈতিক বংশধর এবং ওজনদার প্রার্থীরা
এই পর্যায়ের বড় লড়াইগুলি
বুম কয়েকটি আলোড়ন তোলা লড়াইয়ের তালিকা বানিয়েছে যেগুলি নিয়ে বিপুল আলোচনা ও তর্ক চলবে ।
বেগুসরাই
‘বিহারের লেনিনগ্রাদ’ কিংবা ‘ছোট মস্কো’ বলে পরিচিত বেগুসরাই বরাবরই বামপন্থীদের ঘাঁটি, যেখানে ২০১৪ সালে বিজেপি জয়ী হয় ।
বিদায়ী সাংসদ ডঃ উদয় সিং ২০১৮ সালের অক্টোবরে মারা যান, সেই থেকে আসনটি খালিই পড়ে আছে । বেগুসরাইয়ে এবার কঠিন ত্রিমুখী লড়াই । একদিকে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী বিজেপির গিরিরাজ সিং, অন্য দিকে বিজেপি-বিরোধী ভোটে ভাগ বসাতে সিপিআইয়ের প্রার্থী জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আগুনখোর প্রাক্তন ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার এবং ইউপিএ মিত্র রাষ্ট্রীয় জনতা দলের তনভির হাসান, যিনি ২০১৪-র নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ।
আসানসোল
পশ্চিমবঙ্গের এই শিল্পনগরী থেকে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে প্রাক্তন অভিনেত্রী মুনমুন সেন এবং জনপ্রিয় গায়ক ও বর্তমান সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় ।
মুম্বই
মুম্বইয়ের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব সময়েই প্রভূত উদ্দীপনার সঞ্চার করে l এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না । ইউপিএ এবং এনডিএ, উভয় শিবিরই এখানে মরণপণ লড়াইয়ে মেতেছে ।
মুম্বই দক্ষিণঃ শিব সেনার বর্তমান সাংসদ অরবিন্দ সাবন্ত এই কেন্দ্রে মহড়া নেবেন দু বারের সাংসদ এবং সদ্য মুম্বইয়ের কংগ্রেস সভাপতি নিযুক্ত মিলিন্দ দেওরার l
মুম্বই দক্ষিণ-মধ্যঃ বিজেপি সাংসদ রাহুল সেওয়ালে এই কেন্দ্রে কংগ্রেস নেতা একনাথ গায়কোয়াড়ের বিরুদ্ধে লড়ছেন ।
মুম্বই উত্তরঃ বর্তমান সাংসদ গোপাল শেট্টি লড়ছেন রাজনীতিতে নবাগতা প্রাক্তন অভিনেত্রী ঊর্মিলা মাতণ্ডকরের বিরুদ্ধে ।
মুম্বই উত্তর-পূর্বঃ শহরে এনসিপি-র একমাত্র প্রার্থী সঞ্জয় পাটিল লড়ছেন বিজেপির মনোজ কোটাকের বিরুদ্ধে ।
মুম্বই উত্তর-মধ্যঃ বর্তমান সাংসদ বিজেপির পুনম মহাজনের বিরুদ্ধে এই আসনে লড়াই হতে চলেছে কংগ্রেসের প্রিয়া দত্তের ।
মুম্বই উত্তর-পশ্চিমঃ বিজেপির গঞ্জন কীর্তিকার লড়ছেন কংগ্রেসের প্রাক্তন মুম্বই সভাপতি এবং বর্তমান সাংসদ সঞ্জয় নিরুপমের বিরুদ্ধে ।