ভারতের সবচেয়ে পরিচিত ভুয়ো খবরের নেপথ্য কাহিনী
এই ভুয়ো ছবিটির তথ্য যাচাই করে অনেক প্রতিবেদনই লেখা হয়েছে, কিন্তু যে আসল ছবিটি ব্যবহার করে এটি তৈরি, তার কথা বিশেষ কেউ লেখেনি।
তরুণ নরেন্দ্র মোদী ঘরের মেঝে ঝাঁট দিচ্ছেন, ফোটোশপ করা বা অন্যের দেহের সঙ্গে মোদীর মুখ জুড়ে তৈরি এমন একটি ছবি গত মাসে সোশাল মিডিয়ায় জিইয়ে তোলা হয়। এই ছবিটি যে ভুয়ো, সে বিষয়ে অনেক তথ্য-যাচাইকারী প্রতিবেদন ইতিপূর্বে প্রকাশিত হলেও, এটি তৈরি করতে কোন ছবিটিকে ফোটোশপ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে বিশেষ কেউ আলোকপাত করেননি।
গত লোকসভা নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে এই ভুয়ো ছবিটি ভাইরাল হয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার নরেন্দ্র মোদী কত সাধারণ, নিম্নবর্গীয় পটভূমি থেকে উঠে এসেছেন, সেই বিবরণীটি নির্মাণ করতে যে সব ভুয়ো ছবি ও খবর ব্যবহৃত হয়, এটি ছিল সেগুলির অন্যতম।
এ বছরের এপ্রিলে ‘মিশন শ্রীরামমন্দির’ ফেসবুক পেজে এই ভুয়ো ছবিটি আবারও ফিরে এসেছে। ৬০০ জন পেজটি শেয়ার করেছেন। পোস্টটির আর্কাইভ বয়ান দেখুন এখানে।
এরপর পোস্টটি অন্য একটি গোষ্ঠীও শেয়ার করে, যার নাম ‘মিশন মোদী ২০১৯ মে আপনে ১০০ মিত্র কো জোড়ে।’
পোস্টটির আর্কাইভ সংযোগটি দেখুন এখানে।
২০১৬ সালে তথ্য জানার অধিকার বিষয়ে জনতা কা রিপোর্টার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে এই ছবিটি ভুয়ো বলে উল্লেখিত হয়।
তারও আগে ২০১৩ সালের ১২ জুলাই রাজকুমার সোনি নামে জনৈক টুইটার ব্যবহারকারী ফোটোশপ করা এই ছবিটি পোস্ট করেন। পর দিনই অর্থাৎ ২০১৩-র ১৩ জুলাই রিমা সতিন নামে জনৈক ব্লগার সোনির এই ধাপ্পাটি ধরিয়ে দেন। পড়ুন এখানে। বুম সোনির টুইটার টাইমলাইন ঢুঁড়ে আদি টুইটটির খোঁজ চালায়, কিন্তু সেটি মুছে দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জনৈক তেলুগু ব্লগারও ফোটোশপ করা এই ছবিটি প্রকাশ করেন, যে বিষয়ে এখানে পড়তে পারেন।
যে মূল ছবিটিকে ফোটোশপ করে তরুণ নরেন্দ্র মোদীর ঘর ঝাঁট দেওয়ার ছবিটি সাজানো হয়েছে, বুম সেটি উদ্ধার করার চেষ্টাও করে। ২০১৩ সালের আগে এই ছবিটি কোথাও প্রকাশিত হয়েছে কিনা, আমরা গুগল-এ গিয়ে তার সন্ধান করি।
শেষে দেখা যায়, ২০১০ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের নির্দেশিকায় ঝাড়ুদারদের কতগুলি ছবির সমাহারে এই ছবিটি স্থান পেয়েছে।
মূল ছবিটি ১৯৪৬ সালের ২ জুন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-র এক আলোকচিত্রীর তোলা এক ঝাড়ুদারের ছবি। এই ছবিটি তোলার অন্তত ৪ বছর পরে ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদীর জন্ম হয়, সুতরাং এটি কোনও মতেই তাঁর ছবি হতে পারে না।
মূল ছবিটি যে সংবাদসংস্থা এপি-র ফোটোগ্রাফারেরই তোলা, তা জানিয়ে একটি নোটও ওই নির্দেশিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
নোটটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
বুম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে লিখে মূল ছবিটি এবং তার আলোকচিত্রী সম্পর্কে জানতে চায়। তাঁরা জানান—ছবিটি এপি-র এবং তার স্টাফ ফোটোগ্রাফার ম্যাক্স ডেসফর-এর তোলা। এপি-র মিডিয়া রিলেশন্স-এর অধিকর্তা লরেন এস্টন এ কথা বুমকে জানান।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের ফোটো আর্কাইভে গিয়েও আমরা ছবিটি শনাক্ত করি।
এপি-র আর্কাইভে সেই ছবিটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
ছবির লোকটি কে এবং কোথায় সেটি তোলা হয়েছিল, তার কোনও উল্লেখ নেই। শুধু তার ক্যাপশনে লেখা আছে—“ভারতের অন্যতম অস্পৃশ্য বর্ণের একটি লোক যে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ঝাঁট দিয়ে বেড়ায়, হাতে সেই ঝাড়ুটি নিয়ে, ২ জুন, ১৯৪৬ এই অস্পৃশ্যরাই (গান্ধী যাদের হরিজন বা হরির সন্তান বলেন) দেশের যাবতীয় নোংরা সাফ করার কাজ করে থাকেন। গান্ধী বারবারই বলেছেন যে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের অভিশাপ হচ্ছে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের শতাব্দীপ্রাচীন অস্পৃশ্যতার পাপ অনুশীলনের শাস্তিস্বরূপ। (এপি ফোটো/ম্যাক্স ডেসফর)”
১৯৪০-এর দশক থেকে ৬০-এর দশক পর্যন্ত এশিয়ায় ছবি তুলে বেড়ানো ম্যাক্স ডেসফর ছিলেন যুদ্ধবিগ্রহের পুলিতজার পুরস্কার বিজয়ী আলোকচিত্রী। ১৯৫০ সালের কোরীয় যুদ্ধের সময় একটি ভাঙা সেতুর উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পার হওয়া উদ্বাস্তুদের ছবির জন্য তিনি এই পুরস্কার পান। তিনি গত বছরেই ১০৪ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে আরও জানতে এখানে পড়ুন।