হিন্দুদের প্রতি সাংবিধানিক বৈষম্য: ভাইরাল বার্তার প্রামাণিক ভিত্তি নেই
সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল হওয়া একটি বার্তায় অনেক মতামত ও বিভিন্ন দাবি দিয়ে প্রমাণ করতে চাওয়া হয়েছে যে, ভারতীয় সংবিধানে হিন্দুদের প্রতি বৈষম্য রয়েছে।
একটি ভাইরাল মেসেজে দাবি করা হয়েছে যে ভারতীয় সংবিধানের ২৮, ২৯ এবং ৩০ ধারায় ইসলামি ও খ্রিষ্টান ধর্মগ্রন্থের প্রচার করা হয়েছে, কিন্তু হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এই দাবিটি একেবারেই ভুয়ো, ভিত্তিহীন। সংবিধানের এই ধারাগুলি ধর্মের ভিত্তিকে কোনও রকম বৈষম্য করে না, এবং বাইবেল, কোরান বা গীতার মতো কোনও ধর্মগ্রন্থের কথা সরাসরি উল্লেখও করে না।
বুমের হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন নম্বরে (৭৭০০৯০৬১১১) একটি দীর্ঘ মেসেজ একাধিক বার আসে। নীচে মেসেজটি দেওয়া হল।
এই মেসেজটিতে সরকারকে অভিযুক্ত করে বলা হয়েছে, সংবিধানের ২৮, ২৯ ও ৩০ ধারার সাহায্য নিয়ে, ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে, সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা করে বিভিন্ন কল্যাণপ্রকল্প চালু করেছে। মেসেজটিতে দাবি করা হয়েছে যে এই প্রকল্পগুলির মূল উদ্দেশ্য ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করা।
অনেকেই এই মেসেজটির প্রথম খানিকটা অংশ টুইটারেও শেয়ার করেছেন।
এই মেসেজটির বিভিন্ন দাবি বুম যাচাই করে দেখেছ। কী পাওয়া গেল, নীচে দেখুন।
ভারতীয় সংবিধান কি কোনও একটি বিশেষ ধর্মকে অগ্রাধিকার দেয়?
ভারতীয় সংবিধানের ২৮, ২৯ ও ৩০ ধারা অন্য ধর্মগুলিকে ছোট করে বা বঞ্চিত করে বিশেষ কোনও একটি ধর্মকে অগ্রাধিকার দেয় না। মেসেজে দাবি করা হয়েছে যে ৩০(এ) ধারায় স্কুলে গীতা পাঠ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন কোনও ধারা আদৌ সংবিধানেই নেই।
ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সেই সম্প্রদায়গুলির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা রয়েছে সংবিধানের এই ধারাগুলিতে।
সংবিধানের এই ধারাগুলি কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বা ভাষাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করে, এই দাবিটিকে ন্যস্যাৎ করে দেন বিশিষ্ট আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে। বুমের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন:
"না, এই ধারাগুলি তা করে না। এই ধারাগুলি শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়। তার মধ্যে ভাষাগত সংখ্যালঘুরাও আছেন, যাঁদের ভাষা, অক্ষর বা সংস্কৃতি স্পষ্টতই পৃথক। টিএমএ পাই রায়ে স্পষ্টতই সংখ্যালঘু হিন্দুদেরও স্বার্থরক্ষা করা হয়েছে। কর্নাটকে তামিল ভাষাভাষীরা নিজেদের নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠন করতে পারেন। তামিলনাড়ুতে কন্নড় ভাষাভাষীদেরও একই অধিকার আছে। সংবিধানের এই ধারাগুলিতে আলাদা করে ধর্ম সম্পর্কে কিছু নেই।"
সঞ্জয় হেগড়ে জানালেন বুমকে
মেসেজটিতে মতামত থেকে বিভিন্ন দাবিকে আলাদা করা
এর পাশাপাশি, ভাইরাল হওয়া মেসেজটিতে মোট দশটি পয়েন্ট আছে। সেগুলির দাবি ও অভিমত পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন, কিন্তু ভাইরাল হওয়া মেসেজটির মূল বার্তার সঙ্গে সেগুলির যোগসূত্র স্পষ্ট।
বুম প্রতিটি পয়েন্টকে আলাদা করে বিচার করে দেখেছে। দেখা গিয়েছে, দশটির মধ্যে চারটি পয়েন্ট (এক, আট, নয় এবং দশ নম্বর) আসলে অভিমত।
বাকিগুলি দাবি। সেগুলির বিশ্লেষণ নীচে দেওয়া হল।
দাবি: অমরনাথে যেতে চাইলে আপনাকে কর দিতে হয়, কিন্তু হজে যাওয়ার জন্য ভর্তুকি পাবেন।
সত্য: পুণ্যার্থীদের নিয়ে যে গাড়িগুলি অমরনাথে যেত, ২০১০ সালে সেগুলিকে জম্মু ও কাশ্মীরে কর প্রদান করতে হত। সে বিষয়ে পড়তে পারেন এখানে।
সরকার তখন স্পষ্ট করে জানায় যে তীর্থযাত্রীদের থেকে কোনও অতিরিক্ত কর আদায় করা হচ্ছে না। যাই হোক, বিভিন্ন সংবাদসূত্র অনুসারে জানা গিয়েছে যে এ বছর অমরনাথগামী সব গাড়িকে রাস্তার টোল থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
অন্য দিকে, ২০১৮ সালে সরকার হজ ভর্তুকি বন্ধ করে দেয়।
আরও পড়ুন: হজ ভর্তুকি বিতর্ক
দাবি: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি খরচে শুধুমাত্র মুসলমান ছাত্রদের জন্যই চারটি হস্টেল চলে, কিন্তু হিন্দু ছাত্রদের জন্য তেমন কোনও হস্টেলের ব্যবস্থা নেই।
সত্য: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি হস্টেলের মধ্যে একটি— কারমাইকেল হল— সত্যিই মুসলমান ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত। হস্টেলের তালিকাটি দেখা যেতে পারে এখানে। কারমাইকেল হল সংক্রান্ত নিয়মাবলি দেখা যেতে পারে এখানে। এ ছাড়াও বৌদ্ধ ছাত্রদের জন্য একটি হস্টেল সংরক্ষিত আছে, আর একটি হস্টেল আছে শুধুমাত্র অর্থনীতির ছাত্রদের জন্য। মুসলমান ছাত্রদের জন্য চারটি সংরক্ষিত হস্টেলের কোনও উল্লেখ কোথাও নেই।
কারমাইকেল হস্টেলের সুপারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়া অবধি ফোনে ধরা যায়নি।
দাবি: ভাইরাল হওয়া মেসেজটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, হিন্দু মেয়েরা যেখানে যথেষ্ট স্কলারশিপ পাচ্ছে না, সেখানে মুসলমান মেয়েদের জন্য প্রচুর সংখ্যক স্কলারশিপের ব্যবস্থা আছে।
সত্য: কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল স্কলারশিপ পোর্টালের তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ সালে স্কলারশিপের পরিসংখ্যান এই রকম:
- স্কলারশিপের জন্য যত আবেদনপত্র জমা পড়েছিল, তার ৮০.৪% মুসলমানদের, হিন্দুদের আবেদনের অনুপাত মাত্র ৪.৮%। ভেরিফায়েড অ্যাপ্লিক্যান্টদের ৮০% মুসলমান, মাত্র ৪.৭% হিন্দু।
- মুসলমানদের দেওয়া হয়েছিল ১০৩১.২১ কোটি টাকা, আর হিন্দুদের দেওয়া হয়েছিল ১২৭.৭৫ কোটি টাকা।
সফল আবেদনকারীদের মধ্যে নারী ও পুরুষের অনুপাত কী, এই তথ্যে তার কোনও উল্লেখ নেই। তথ্য থেকে জানা যায় যে ওই একই শিক্ষাবর্ষে:
- মেয়েদের মধ্যে প্রি-ম্যাট্রিকুলেশন স্কলারশিপ বাবদ ৬.৮৬ কোটি টাকা, এবং পোস্ট-ম্যাট্রিকুলেশন, অ্যাচিভার ও মিনস-কাম-মেরিট স্কলারশিপ বাবদ ৪.১২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
- স্কলারশিপের জন্য মহিলা আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ৭৫.৫ লক্ষ, আর ভেরিফায়েড মহিলা আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ৫৮.৫ লক্ষ।
মহিলা আবেদনকারীদের ধর্মভিত্তিক সংখ্যা এবং কোন ধর্মের মেয়েরা কত স্কলারশিপ পেয়েছেন, সেই পরিসংখ্যান দেওয়া নেই। কোনও হ্যান্ডআউট বা গ্রান্টেরও উল্লেখ নেই।
তথ্য-পরিসংখ্যান দেখা যেতে পারে এখানে।
দাবি: মুসলমানদের জন্য বিশেষ সুদবিহীন ঋণের ব্যবস্থা আছে। হিন্দুদের জন্য তেমন কোনও সুবিধা নেই।
সত্য: ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদহীন ঋণ প্রদানের অধিকার দেয় না। কাজেই, প্রতিটি ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য ঋণপ্রদানকারী সংস্থাকে ঋণের ওপর সুদ আদায় করতে হয় ও তার ওপর কর জমা করতে হয়। তবে, মুসলমানরা তাঁদের নিজেদের সুদহীন ঋণের দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালান, যেমন উত্তরপ্রদেশে মুসলিম ট্রাস্ট ফান্ড এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলি সরকার-পোষিত নয়।
৭ নম্বর দাগের দাবি: মন্দিরগুলিকে তাদের আয়ের ওপর রাজস্ব প্রদান করতে হয়, কিন্তু কোনও মসজিদ বা চার্চকে তাদের আয়ের ওপর কর দিতে হয় না।
সত্য: ১৯৬১ সালের ভারতীয় আয়কর আইনের ১১ ও ১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে, দাতব্য বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে কোনও ট্রাস্ট যে টাকা জোগাড় করে, তার ওপর আয়কর দিতে হয় না। এই করছাড়ের অবশ্য একটি সীমা আছে। কোনও বিশেষ ধর্মের জন্য কোনও প্রতিষ্ঠানেই কোনও পৃথক ছাড়ের ব্যবস্থা নেই।
গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স-এর ওপর লেভি আদায়ের ক্ষেত্রে যে বৈষম্যের দাবি এই মেসেজটিতে করা হয়েছে, অর্থ দফতর তাকেও মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।