উত্তরপ্রদেশের একটি দোকান থেকে কি ৩০০ ইভিএম বাজেয়াপ্ত হয়েছে?
ভাইরাল হওয়া পোস্টের দাবি, উত্তরপ্রদেশের চন্দৌলির এক বিজেপি নেতার দোকান থেকে ৩০০টি ইভিএম বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তবে এগুলি ভোট-না-পড়া ইভিএম, যা সরকারি অফিসাররা একটি স্ট্রংরুম থেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
স্ট্রংরুম থেকে ইভিএম সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, যাতে দাবি করা হচ্ছে, এগুলি এক বিজেপি নেতার দোকান থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ভিডিওর সঙ্গে হিন্দিতে ক্যাপশন—আরও একবার ৩০০র বেশি ইভিএম স্থানীয় লোকেদের সহায়তায় অফিসাররা একটি দোকান থেকে উদ্ধার করলো। দোকানটি বিজেপি নেতার।
অন্ধকারে তোলা ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, একটি স্থান থেকে ইভিএম সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিরা তাদের মোবাইল ক্যামেরায় যার ছবি তুলছে।
কিন্তু এই ঘরটি আসলে চন্দৌলির নবীন মণ্ডি স্থলের একটি স্ট্রংরুম এবং সেখান থেকে যারা ইভিএম সরাচ্ছে, তারা কেউ স্থানীয় লোক নয়, সরকারি অফিসার।
বুম ভিডিওটির একটি স্ক্রিনশট নিয়ে তার উপর জুম করে দেখেছে, যে-ঘরটিতে ইভিএমগুলি রাখা আছে, তার দেওয়ালে সেখানে স্পষ্ট হিন্দিতে ‘স্ট্রংরুম’ কথাটি লেখা আছে।
এই ভিডিও এবং ইভিএম এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার আরও অনেক ভিডিও ১৯ মে নির্বাচন সাঙ্গ হওয়ার পর সোশাল মিডিয়ায় ‘ইভিএমে কারিকুরি করার অভিযোগ’ নিয়ে ভাইরাল হয়েছে।
আম আদমি পার্টির গুরগাঁও শাখার ফেসবুক পেজে এই ভিডিওটিই শেয়ার হয়েছে, যার ক্যাপশন হল: “৩০০র বেশি ইভিএম একটি দোকান থেকে স্থানীয় জনসাধারণ আটক করেছে। এ ভাবেই গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে।”
বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ এবং ট্যুইটার হ্যান্ডেল এই ভিডিওটি মোটামুটি একই ধরনের ক্যাপশন দিয়ে শেয়ার করেছে। কোনও-কোনও পোস্টে ঘটনাস্থল হিসাবে উত্তরপ্রদেশের চন্দৌলির উল্লেখ করা হয়েছে। ভাইরাল হওয়া পোস্টটি দেখুন এখানে।
নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরা যা বলছেন
বুম চন্দৌলির জেলা নির্বাচনী আধিকারিক নবনীত সিং চাহালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি গোটা বিষয়টিকে ভুয়ো বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন—“ভিডিওটি চন্দৌলির নবীন মণ্ডি স্থলে তোলা। কয়েকটি ভোট-না-পড়া ইভিএম চন্দৌলির সকলডিহা কেন্দ্র থেকে সরানো হচ্ছিল। বিকেলের দিকে সেগুলিকে আলাদা একটি স্ট্রংরুমে সরানো হচ্ছিল, তখন কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী আপত্তি তোলেন।” পরে চাহাল এবং অন্য অফিসাররা ঘটনাস্থলে পৌঁছন এবং উত্তেজিত দলীয় কর্মীদের শান্ত করেন।
“পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ভোট-না-পড়া ইভিএমগুলি নবীন মণ্ডি স্থলের স্ট্রংরুম থেকে জেলা কালেক্টরেটে নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।”
নবনীত সিং চাহাল, জেলা নির্বাচনী আধিকারিক, আইএএস
তিনি দৃঢভাবে অস্বীকার করেন যে, ভিডিওতে দেখানো স্ট্রংরুমটি কোনও বিজেপি নেতার দোকান।
একই জায়গার অন্য একটি ভিডিও
বুম ইতিমধ্যে ফেসবুকে একই জায়গার অন্য একটি ভিডিও খুঁজে পেয়েছে, যেটি বিকেলে তোলা। ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা- “যোগী সরকারের গুণ্ডামি। বিজেপি সরকারের চাপে প্রশাসন ইভিএম পাল্টে দিচ্ছে। প্রকাশ্য দিবালোকে গণতন্ত্রকে খুন করা হচ্ছে। বিরোধী পক্ষ এবং মিডিয়া মুখে কুলুপ এঁটেছে। লজ্জা হওয়া উচিত।”
(হিন্দিতে লেখা মূল পোস্টটি: योगी सरकार की गुंडई, प्रशासन भाजपा सरकार के दबाव में चंदौली में EVM बदलवा रही है, सरेआम लोकतंत्र की हत्या हो रही है, विपक्ष समेत मीडिया भी खामोश है…शर्म करो।)
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে। একই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ট্যুইটারেও।
আমরা দেখেছি যে ভিডিও ক্লিপটি একই জায়গার, তবে তা দিনের বেলায় তোলা।
ভিডিওটি চালু হতেই একজনকে ফোনে বলতে শোনা যাচ্ছে—“আমি এখন এখানে রয়েছি, ছবি তুলছি। ওরা এখানে ইভিএম নামাচ্ছে, আর কেউ এখানে নেই। ওরা আমাদের কিছু বলছেও না। রুম নম্বর ১০ কোনও দলের কেউ নেই। ওরা ইভিএমগুলো ১০ নম্বর রুমে নিয়ে যাচ্ছে। ”
একটা সময় ওই ব্যক্তিই ইভিএম বহনকারীদের প্রশ্ন করতে শুরু করেন। জানতে চান—কোথা থেকে ইভিএমগুলো আনা হচ্ছে? উত্তরে একজনকে বলতে শোনা যাচ্ছে—সকলডিহা।
চন্দৌলি উত্তরপ্রদেশের একটি জেলা, যেটিতে লোকসভা নির্বাচনের শেষ দিনে ভোটগ্রহণ হয়। সকলডিহা হচ্ছে ওই জেলারই একটি বিধানসভা কেন্দ্র। ইভিএম বয়ে আনা একজন জানাচ্ছে, এই যন্ত্রগুলি সংরক্ষিত ইভিএম, তহশিলদারের নির্দেশে যেগুলি সরিয়ে আনা হচ্ছে। ব্যক্তিটি নিজেকে একজন সাফাই কর্মী হিসাবে শনাক্ত করেন।
এটা জানার পর বুম সকলডিহার তহশিলদার নুপূর সিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি স্বীকার করেন, তাঁর নির্দেশেই ইভিএমগুলি সরানো হচ্ছিল এবং এগুলি সংরক্ষিত মেশিন।
“সহকারী রিটার্নিং অফিসার আমাদের এই মেশিনগুলি সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। এগুলি সবই ছিল সংরক্ষিত মেশিন।”
নুপূর সিং, সকলডিহার তহশিলদার
বুম চন্দৌলির এআরও-র সঙ্গেও যোগাযোগ করে। তিনি বলেন, তাঁর নির্দেশেই ইভিএমগুলি চন্দৌলির স্ট্রংরুমে সরানো হচ্ছিল। যখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ১৯ মে এই কাজটা করা হয়নি কেন, উত্তরে তিনি বলেন—“আমরা ভোট-পড়ে-যাওয়া ইভিএমগুলি সিল করা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এ ধরনের দেরি হয়েই থাকে। আমরা সংশ্লিষ্ট সব অফিসারদের এটা জানিয়েছিলাম, পরে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদেরও জানাই।”
নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়া
ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনও ভোট-পড়া ইভিএমগুলির নিরাপত্তা বিষয়ে একটি প্রেস-বিবৃতি জারি করেছে:
সাধারণভাবে একটি বিবৃতি দেওয়া ছাড়াও নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া আধিকারিকদের রিপোর্টও ট্যুইট করেছে। তার মধ্যে চন্দৌলির আরও-র পাঠানো রিপোর্টে স্পষ্টভাবে সংরক্ষিত ইভিএমগুলি স্ট্রংরুমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিশদ রিপোর্ট রয়েছে।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে পাঠানো এক চিঠিতে জেলা নির্বাচনী আধিকারিক জানিয়েছেন—“১৯ মে সপ্তম দফার ভোটগ্রহণ শেষ হলে ইভএম ও ভিভিপ্যাট যন্ত্রগুলি ডাবল স্ট্রংরুমে রাখা হয়। স্ট্রংরুম থাকে সিআরপিএফের হেফাজতে। ২০ মে সকলডিহায় ৩৮১ নম্বরে রাখা সংরক্ষিত ইভিএম ও ভিভিপ্যাট যন্ত্রগুলি সহকারী রিটার্নিং অফিসার চন্দৌলির নবীন মণ্ডি কমটিতে নিয়ে যান। যখন একটি অতিরিক্ত স্ট্রংরুমে ইভিএমগুলি রাখার প্রস্তুতি চলছিল, তখনই সমাজবাদী পার্টির কিছু সমর্থক তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও তাতে যোগ দেন। যাই হোক, পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে এবং প্রতিবাদীদের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়।”
নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্র জেলা নির্বাচনী আধিকারিককে লেখা জেলর সমাজবাদী পার্টির প্রধান সত্যনারায়ণ রাজভড়-এর একটি চিঠিও শেয়ার করেন, যাতে তিনি ইভিএম নিয়ে অফিসারদের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে তাঁর দলের তরফে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।