ভাইরাল ছবি কি উত্তরপ্রদেশের একটি স্কুলে মিড-ডে মিল? একটি তথ্য-যাচাই
বুম মালকপুরার প্রধানের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে ছবিটি বিশেষ মধ্যাহ্নভোজের, ছাত্রদের নিত্য খাবার নয়।
উত্তরপ্রদেশের (Uttar Pradesh) জালাউন ( Jalaun) জেলায় একটি সরকারি স্কুলে এক ছাত্রের হাতে ব্যক্তিগতভাবে স্পনসর করা সুখাদ্য সম্ভারের একটি থালার ছবি অনলাইনে ভুয়ো দাবিতে শেয়ার করা হচ্ছে যে রাজ্য সরকার নাকি এই ধরনের উপাদেয়, উত্কৃষ্ট ভোজ্য-পেয় স্কুল-পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল ( Mid-Day Meal ) সরবরাহ করছে।
বুম দেখে ভাইরাল হওয়া ছবিটি উত্তরপ্রদেশের জালাউন জেলার মালাকপুরা গ্রামের প্রধানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সরবরাহ করা বিশেষ মধ্যাহ্নভোজের থালি। মালকপুরা গ্রামের এই সরকারি স্কুলের মতো অন্যত্রও এ ভাবেই যে-কেউ পড়ুয়াদের জন্য বিশেষ মিড-ডে মিলের ভোজনের ব্যবস্থা করতে পারেন।
ভাইরাল হওয়া ছবিতে ইউনিফর্ম পরিহিত এক পড়ুয়াকে একটি থালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, থালাটিতে কয়েকটি পুরি, তরকারি, স্যালাড, আপেল, এক গ্লাস মিল্কশেক, আইসক্রিম ইত্যাদি সাজানো। সে একটি স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার বোর্ডে লেখা —আপার প্রাইমারি স্কুল, মালকপুর, জালাউন জেলা।
ছবিটি শেয়ার করে হিন্দিতে ক্যাপশন দেওয়া হয়েছে, "এটা যদি দিল্লির কোনও স্কুলে ঘটত, তাহলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা প্রথম পাতায় ছাপা হতো।"
হিন্দিতে ক্যাপশনটি, "उत्तर प्रदेश के सरकारी स्कूल का मिड डे मील ❤
अगर दिल्ली के किसी विद्यालय में ऐसा होता तो अंतराष्ट्रीय अखबारों में सुर्खियां बनाई जाती.."
হরিয়ানা বিজেপির আই-টি সেল-এর প্রাক্তন আধিকারিক অরুণ যাদব ছবিটি শেয়ার করেছেন বিভ্রান্তিকর ক্যাপশন দিয়ে।
বিজেপির দিল্লি শাখার নেতা কৌশল মিশ্রও একই ছবি ও লেখা টুইট করেছেন।
ফেসবুকে ভাগোয়া ক্রান্তি সেনার সভানেত্রী সাধ্বী প্রাচীও একই ভুয়ো বর্ণনা ও ছবি টুইট করেছেন।
দক্ষিণপন্থী চ্যানেল সুদর্শন নিউজ-এর সাগর কুমার এবং নিউজ নেশন-এর শ্বেতা নেগিও এই ভুয়ো টুইটটি শেয়ার করেছেন। বুম এর আগেও একাধিকবার সুদর্শন নিউজ ও তার প্রতিবেদকদের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ ভুয়ো খবরের পর্দাফাঁস করেছে।
ফেসবুকে যোগী আদিত্যনাথ এবং বিজেপির বেশ কিছু ফ্যান পেজ-এও এই ভুয়ো খবরটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই ধরনের আরও পোস্ট দেখুন এখানে।
আরও পড়ুন: ইউটিউবার নীতীশ রাজপুতকে ভুল করে আইপিএস আধিকারিক বলা হল
তথ্য যাচাই
বুম ছবিটি যাচাই করতে গিয়ে ফেসবুকে অমিত নামের একটি পেজ দেখতে পায়। অমিতই হলেন জালাউন জেলার মালকপুর গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধান, তিনি ৩১ অগস্ট ওই স্কুলের মিড-ডে মিল-এর ছবিটা পোস্ট করেছিলেন।
অমিত তাঁর ফেসবুক পোস্টে বিস্তারিত বর্ণনা দেন কী কী পড়ুয়াদের থালায় ছিল—"বিদ্যালয়ে আজকের তিথিভোজন ( অ্যাড অন এম ডি এম )" নাম দিয়ে। অমিতের পোস্টে ৩টি ছবি ছিল— একটি থালায় সাজানো রকমারি খাদ্যবস্তুর ছবি, অন্যটি এক পড়ুয়ার সেই থালাটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকার সেই ভাইরাল ছবি, আর তৃতীয়টি পড়ুয়াদের সমবেতভাবে একটি বোর্ড তুলে ধরার ছবি।
আমরা তৃতীয় ছবিতে দেখি স্কুলের পড়ুয়াদের হাতে একটি বোর্ড যেখানে লেখা সৌরভ নামক কোনও এক ব্যক্তিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা এবং বিশেষ ভোজের জন্য ধন্যবাদ। বোর্ডে সাথে লেখা – "তিথি ভোজন ৩১.০৮.২০২২"
বুম অমিতের অন্য কয়েকটি পোস্টও স্ক্যান করে দেখেছে তিনি নিয়মিত পড়ুয়াদের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির আয়োজন করা তিথি ভোজনের ছবি ও কথা প্রচার করে থাকেন। ১ অগস্টের (২০২২) এরকম একটি পোস্টে পড়ুয়াদের জন্য পুরি, চানা মশলা, স্যালাড ও মিষ্টান্ন সেবন করার কথা আছে। এই বিশেষ তিথি-ভোজের জন্য পড়ুয়াদের বোর্ডে এবং অমিতের পোস্টেও বিহারের সমস্তিপুরের জনৈক রৌনককে ধন্যবাদ জানানো হয়ে থাকে।
বুম এ ব্যাপারে অমিতের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, "প্রধান হওয়ার পর ছাত্রদের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে আমি জানতে পারি ওরা ভালমন্দ খেতে খুব পছন্দ করে। কী তাদের পছন্দ জানতে চাইলে অনেকে বলে মটর-পনির। ১৪ তারিখে আমরা মটর পনির বানিয়ে দিই। তারপর আমাদের মনে হয়, এভাবে একদিন কোনও বিশেষ খানা দিয়ে ঠিক হচ্ছে না, এটা নিয়মিত করতে হবে। তাই আমরা অ্যাড-অন মিড-ডে মিল কর্মসূচি নিই, যাতে মাসে অন্তত চার দিন ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ সুস্বাদু ডিশ খাওয়ানো হবে। এ জন্য আমরা নতুন করে মেনু ঠিক করি, রুটিনও তৈরি করি।
"গবেষণা চালিয়ে আমরা দেখি, গুজরাটে এই ধরনের তিথি-ভোজনের ব্যবস্থা পড়ুয়াদের জন্য রয়েছে। এখানেও ১ জুলাই থেকে আমরা সেটা চালু করি। তাতে পড়ুয়ারা যে কতটা খুশি হয়েছে, আনন্দ পেয়েছে, বলবার নয়। বাচ্চাদের সঙ্গে যারা নিজেদের সুখ ও আনন্দ ভাগ করে নিতে চান, তাঁরা অনায়াসে এই ধরনের তিথিভোজন স্পনসর করতে পারেন। এই বন্দোবস্তকে হয়তো নিয়মিত মিড-ডে মিল বলা যাবে না, কিন্তু অনেক রাজ্যেই এই ধরনের বিশেষ ভোজনের ধারণাটা কার্যকর হচ্ছেl" উত্তরপ্রদেশে অমিতরাই প্রথম এটা শুরু করেছেন।
মিড-ডে মিল কী?
১৯৯৫ সালে এই প্রকল্পটির সূচনা হয় দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের রান্না-করা পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা এবং তাদের স্কুলে আটকে রাখার লক্ষ্য নিয়ে। ২০২১ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পটির নামকরণ করে প্রধানমন্ত্রী পোষণ শক্তি নির্মাণ স্কিম। উত্তরপ্রদেশে ২০০৪ সালে এই প্রকল্প চালু করা হয়।
সেই সংক্রান্ত সরকারি ওয়েবসাইট ঘেঁটে আমরা দেখেছি, প্রতি পড়ুয়াকে সপ্তাহে ৪ দিন ভাত এবং ২ দিন রুটি দেবার কথাl তা ছাড়া প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের সপ্তাহে ৪৫০ ক্যালরি শক্তির উপযুক্ত খাবার এবং ১২ গ্রাম প্রোটিন দেবার কথাl আপার প্রাইমারির পড়ুয়াদের জন্য ৭০০ ক্যালরি শক্তি এবং ২০ গ্রাম প্রোটিনযুক্ত খাদ্য দেবার কথা।
বিশ্বে এত বৃহত্ কোনও উন্নয়নমুখী প্রকল্প আর নেই। কিন্তু এই প্রকল্পও ঠিকমত কার্যকর না হওয়া, বণ্টনে অসাম্য এবং দুর্নীতিতে ক্লিষ্ট হওয়ার দায়ে অভিযুক্ত।
আরও পড়ুন: বিজেপি সাংসদ দেবজি পটেল বলে ছড়াল পাকিস্তানি ডাক্তার ও মহিলার নাচের ভিডিও