অক্সিজেন প্ল্যান্টের জন্য রাজ্যগুলি কী পিএম কেয়ার্স থেকে টাকা পেয়েছিল?
না, অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানের জন্য রাজ্যগুলিকে কোনও টাকা দেওয়া হয়নি পিএম কেয়ার্স তহবিল থেকে।
ভারতে কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে দিশেহারা হাসপাতাল গুলি যখন অক্সিজেনের (oxygen) খোঁজে বিপদ সঙ্কেত পাঠাচ্ছে, ঠিক সেই পরিস্থিতিতে কয়েকটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে, যাতে দাবি করা হয়েছে যে, মহারাষ্ট্র আর দিল্লি পিএম কেয়ার্স (PM Cares) তহবিলের টাকা যথেষ্ট পরিমাণে খরচ করেনি। মুখ্যমন্ত্রীরা পিএসএ (PSA) অক্সিজেন প্ল্যান্ট (oxygen plant) তৈরি করার জন্য বরাদ্দ টাকা খরচ করতে পারেননি বলে এই পোস্টগুলিতে যে দাবি করা হয়েছে, তা বিভ্রান্তিকর। আসলে, রাজ্যগুলিকে এই ধরনের কোনও অর্থসাহায্য করাই হয়নি।
পিএম কেয়ার্স-এর বরাদ্দ টাকা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের অধীনস্থ সেন্ট্রাল মেডিকেল সাপ্লাই স্টোরকে (CMSS) দেওয়া হয়। এটি একটি স্বশাসিত সংস্থা।
বিভিন্ন ভাবে এই মেসেজটি ছড়িয়ে পড়েছে। পোস্টারের আকারে বা সোশাল মিডিয়ায় পোস্টের মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে যে, পিএম কেয়ার্স তহবিল থেকে যথাক্রমে দশটি এবং আটটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করার জন্য মহারাষ্ট্র এবং দিল্লিকে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, কিন্তু এই রাজ্যগুলি মাত্র একটি করে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করতে পেরেছে।
তথ্য যাচাই
১. পিএম কেয়ার্স কী রাজ্যগুলির জন্য টাকা বরাদ্দ করেছিল?
না, পিএম কেয়ার্স তহবিল থেকে রাজ্যগুলির জন্য কোনও টাকা বরাদ্দ করা হয়নি।
জানুয়ারি মাসে পিএম কেয়ারস ১৬২ টি প্রেশার সুইং অ্যাডসর্পশন মেডিকেল অক্সিজেন জেনেরেশন প্ল্যান্ট তৈরি করার জন্য কেন্দ্রীয় সংস্থা সিএমএসএস-কে ২০১.৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। ভেন্ডর ঠিক করা, তাদের মূল্যায়ন করা, দাম ঠিক করা এবং ভেন্ডররা যথাসময়ে কাজ শেষ করছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব ছিল সিএমসিসির।
এই অর্থবরাদ্দ সম্পর্কে প্রকাশিত প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো এবং প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রালয়ের তথ্য অনুযায়ী রাজ্যগুলিকে টাকা দেওয়ার কোনও উল্লেখ নেই।
এই তথ্যাবলিতে যা উল্লেখ করা হয়েছে:
১. রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা, এবং রাজ্যের নির্দিষ্ট করে দেওয়া হাসপাতালগুলিতে এই প্ল্যান্ট তৈরি হবে
২. প্ল্যান্ট পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য বা হাসপাতাল
৩. প্ল্যান্টগুলির তিন বছরের ওয়ার্যান্টি থাকবে এবং সাত বছরের বার্ষিক দেখভালের চুক্তি থাকবে
৪. উপরে উল্লিখিত সময় পর্যন্ত (মোট দশ বছর) খরচ কেন্দ্র বহন করবে এবং ওই সময় পেরিয়ে গেলে দেখভালের ব্যবস্থা রাজ্যকে করতে হবে
অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে মহারাষ্ট্রে ১০টি এবং দিল্লিতে ৮টি প্ল্যান্ট তৈরির অনুমোদন পায়।
সিএমসিসি ২০২০ সালের অক্টোবরে এই রকম ১৫০টি প্ল্যান্ট তৈরির জন্য দরপত্র চেয়ে টেন্ডার প্রকাশ করে। যেসব হাসপাতালে এই প্ল্যান্ট তৈরি করা হবে, সেগুলিকেও চিহ্নিত করা হয়। দিল্লির ৮টি এবং মহারাষ্ট্রের ১০টি প্ল্যান্ট পাওয়ার কথা। এই টেন্ডারে রাজ্যের হাসপাতালগুলির ভূমিকাও পরিষ্কার করে উল্লেখ করা দেওয়া হয়। অন্যান্য দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে জায়গার ব্যবস্থা করা, ইলেক্ট্রিক সরবরাহ, গোলযোগ সারানো, সিভিল মেরামত, পাইপলাইনের কাজ, এবং লিকেজ ফুটো সারনেরা দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়। লক্ষনীয়, অতিমারি নিয়ন্ত্রণে মোদী সরকার লকডাউন করার প্রায় আট মাসের মাথায় এই টেন্ডার রিলিজ করা হয়।
প্ল্যান্টগুলি সিএমসিসি'র তৈরি করার কথা এবং কেন্দ্র সরকারের সরাসরি টাকা দেওয়ার কথা।
২. কতগুলি প্ল্যান্ট তৈরি হয়েছে?
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক কতগুলি প্ল্যান্ট তৈরি হয়েছে, তার তালিকা দিয়েছে।
অনেকগুলি টুইটের মাধ্যমে এই মন্ত্রক জানিয়েছে যে, ১৬২টি প্ল্যান্ট তৈরির অনুমোদন ছিল এবং ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৩৩টি প্ল্যান্ট তৈরি হয়েছে। এই ৩৩টি প্ল্যান্টের মধ্যে একটি দিল্লিতে এবং একটি মহারাষ্ট্রে তৈরি হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, কেরল ও অন্ধ্রপ্রদেশে একটি করে প্ল্যান্ট তৈরি হয়েছে। হিমাচলপ্রদেশে ৪টি ও মধ্যপ্রদেশে ৫টি প্ল্যান্ট তৈরি হয়েছে।
নিচের টুইটে পুরো লিস্ট দেখতে পাবেন।
জানুয়ারী মাসে যত প্ল্যান্ট তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়েছে, এবং ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত যতগুলি প্ল্যান্ট তৈরি হয়েছে তার পুরো তালিকা নিচে দেওয়া হল।
ওই মন্ত্রক আরও জানিয়েছে যে, তাদের ২০২১ সালের এপ্রিলের শেষের মধ্যে ৫৯টি এবং মে মাসের মধ্যে ৮০টি প্ল্যান্ট তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
স্ক্রোল ইন-এর তথ্য অনুসারে, যে হাসপাতাল এবং সংস্থাগুলিকে এই প্ল্যান্ট তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছে, তারা এই বিলম্বের জন্য পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করছে। হাসপাতালগুলি বলছে যে, তারা মেশিন ইত্যাদি বসানোর জন্য জায়গা তৈরি করে রেখেছে কিন্তু তারা মেশিন পায়নি বা বসানো হয়নি। আবার কিছু কোম্পানি বলছে যে, তাদের তরফে সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে, কিন্তু হাসপাতালগুলিতে যথেষ্ট পরিকাঠামো নেই।
দ্য প্রিন্টও এই সংস্থাগুলির কথা উল্লেখ করে জানিয়েছে যে, হাসপাতালে জায়গা নেই বলেই মেশিন লাগানো যাচ্ছে না। এই শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত একজন দ্য প্রিন্টকে জানিয়েছেন, "জায়গার অভাবের কথা জানানো হচ্ছে। তবে আসল কারণ বোধ হয় এটাই যে, হাসপাতালেই প্রয়োজনীয় অক্সিজেন তৈরি করে নেওয়ার বদলে বাইরে থেকে অক্সিজেন কিনলে কিছু লোকের কায়েমি স্বার্থ সিদ্ধ হয়।"
৩. দিল্লি এবং মহারাষ্ট্র টাকা পাওয়ার কথা অস্বীকার করেছে
যে রাজ্যগুলিকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলির শাসক দল— মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস এবং দিল্লিতে আম আদমি পার্টি— অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বা পিএম কেয়ার্স তহবিল থেকে টাকা পাওয়ার কথা অস্বীকার করেছে। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসের মুখপাত্র শচীন সওন্ত এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, "মহারাষ্ট্র এই প্ল্যান্ট তৈরির জন্য একটা পয়সাও পায়নি। রাজ্যের এই বিষয়ে কোনও ভূমিকা ছিল না। রাজ্য শুধু যেসব হাসপাতালে এই প্ল্যান্ট বসানো যায়, কেন্দ্রকে তার একটি তালিকা পাঠিয়েছে।"
আপও জানিয়েছে যে, তারা প্ল্যান্ট বসানোর জন্য এরকম কোনও টাকা পায়নি। তারা এটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের একটা "মিথ্যে বয়ান" বলে জানিয়েছে, এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাদের প্রতি রাজনৈতিক আক্রমণের উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার করছে বলে তারা অভিযোগ করেছে। দিল্লি সরকার একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, পিএম কেয়ার্স-এর টাকা দিয়ে এই অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর কথা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের। রাজ্য সরকারকে এই খাতে একটি টাকাও দেওয়া হয়নি। ওই বিবৃতিতে বলা হয় যে, "২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এই সমস্ত প্ল্যান্ট তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা এবং সেগুলি রাজ্য সরকারের হাতে হস্তান্তরিত করার কথা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার একজন ভেন্ডরকেই ১৪০টি প্ল্যান্ট তৈরির বরাত দিয়েছিল, আর সেই ভেন্ডর পালিয়ে গেছে।"
দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃতাধীন আপ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, "কেন্দ্রীয় সরকারের নিজের পরিচালনাধীন সফদরজং হাসপাতালে পর্যন্ত পিএসএ প্ল্যান্ট কাজ শুরু করেনি। এ থেকেই বোঝা যায় যে, কেন্দ্র শুধু মিথ্যের জালে আটকে রয়েছে"।
এই প্রতিবেদনটি ভারতের ছ'টি তথ্য-যাচাইকারী সংস্থার যৌথ উদ্যোগ একতা কনসর্টিয়াম-এর অঙ্গ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
আরও পড়ুন: বিজেপি প্রার্থী সুকুমার রায়ের মন্তব্য বলে বিকৃত সংবাদের ছবি ভাইরাল