টেট পাশ না করেই প্রাইমারিতে চাকরি? ভুয়ো দাবি সহ ছড়াল তৃণমূল নেতার ছবি
বুম যাচাই করে দেখে রাজনৈতিক পরিচিতি থাকলেও ভাইরাল ছবির ব্যক্তি আকাশ দাস ২০১৬ সালে টেট উত্তীর্ণ হন।
টেট পরীক্ষা পাশ না করে প্রাইমারি চাকরির নিয়োগপত্র পেয়েছে ভুয়ো দাবি সহ ছড়াল তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদ কর্মী আকাশ দাসের ছবি।
বুম যাচাই করে দেখে আকাশ দাস টেট পাশ করেন ২০১৬ সালে। সম্প্রতি তিনি নদীয়া জেলায় প্রাইমারি বিদ্যালয়ে নিয়োগপত্র পান। আকাশের সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা এডুকেশনে এমএড। ভূগোলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে আকাশের। এডুকেশন বিষয়ে ইউজিসির নেট দু'দুবার ও রাজ্যের কলেজ সার্ভিস কমিশনে সেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি।
সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যায় তৃণমূল কংগ্রেস মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্যের পাশে বসে রয়েছেন ওই ব্যক্তি। নিচে দেখুন ছবিটি।
ছবিটি শেয়ার করে ফেসবুক পোস্টে ক্যাপশন লেখা হয়েছে "ইনি তৃণমূলের ছাত্রনেতা আকাশ দাস। রানাঘাট টিএমছিপির সহ সভাপতি। টেট পাশ না করেও প্রাইমারিতে পছন্দের স্কুলে জয়েন করে ফেলেছে।''
ফেসবুকে একাধিক গ্রুপে ও পেজে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে।
আরও পড়ুন: শিবসেনার প্রতিবাদের ভিডিও বজরংদলের কৃষিআইন-বিরোধী প্রতিবাদ বলে ভাইরাল
তথ্য যাচাই
বুমের তরফে আকাশ দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বুমকে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও টেট পাশ করার সমস্ত নথি দেখান।
আকাশ দাস বুমকে ২০১৪ সালের প্রাইমারি টেট পরীক্ষায় বসার নথি অ্যাডমিট কার্ড দেখান।
২০১৪ সালের টেট পরীক্ষা যার ফলাফল বেরোয় ২০১৬ সালে, আকাশ দাস সেই পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার ফলাফলের অনলাইন তথ্যের মুদ্রিত কপিও আমাদের শেয়ার করেন।
বুম পর্ষদের ওয়েবসাইটে আকাশের রোল নম্বর যাচাই করে দেখে সেখানে ২০১৪ টেট পাশ করা প্রার্থীদের তালিকায় নাম রয়েছে আকাশ দাসের।
টেট পাশ করার পর এমপ্যানেল হওয়ার জন্য আকাশ দাস আবেদন করেন পর্ষদের ওয়েবসাইটে। সেই আবেদনপত্রের নথি বুমকে দেখান তিনি।
আকাশ বুমকে বলেন, "নিয়োগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রাথমিক পর্ষদের ডিসেম্বর মাসের সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ার ধাপ অনুসরণ করেই এই চাকরি পেয়েছি। ১২ জানুয়ারি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে সাক্ষাৎকার দেন তিনি। সাক্ষাৎকারের জন্য ই-মেল পাই।"
"সরস্বতী পুজোর আগের দিন পর্ষদের বিজ্ঞপ্তি দেখার পর নদীয়া জেলা প্রাইমারি স্কুল কাউন্সিল (DPSC) কাউন্সিলিং করে স্কুল পছন্দ করি। নিয়োগপত্র দিয়ে বলা হয় এসআই অফিসে গিয়ে নথি যাচাই করতে। পরের দিন সেটি নিয়ে এসআই অফিসে নথি যাচাই করে জমা দিই। নিয়োগপত্র হাতে পায়।" বুমকে বলেন আকাশ।
জেলা ভিত্তিক তালিকায় আকাশ দাসের নাম অসংরক্ষিত তালিকায় নাম ছিল প্রথমে। সংরক্ষিত তালিকায় নাম ছিল ৫ নম্বরে।
"অসংরক্ষিত প্রার্থী হিসেবে ৩৭ জন ও সংরক্ষিত তালিকায় ১৭ জনের নাম বের করে নদীয়া জেলা প্রাইমারি কাউন্সিল। অসংরক্ষিত তালিকায় ৫-এ নাম হয় আমার," বুমকে বলেন আকাশ।
আকাশের শিক্ষাগত যোগ্যতা
বুমকে পাঠানো নথি অনুযায়ী আকাশ ভূগোলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। এডুকেশনে এমএ করেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এডুকেশন বিষয়ে ইউজিসির নেট দু'দুবার ও রাজ্যের কলেজ সার্ভিস কমিশনে সেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। নেট ও সেট হল গবেষণা ও অধ্যাপনার মূল যোগ্যতামান। বুম এই নথিগুলি ক্ষতিয়ে দেখেছে।
''রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও, আমি টেট পাশ করেই এই নিয়োগ পেয়েছি,''
আকাশ নদীয়া জেলা তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদের সহ সভাপতি। মঙ্গলবার আকাশ ফেসবুকে নিজের নথি দিয়ে ফেসবুক লাইভ ভিডিওতে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে ইন্টারভিউয়ে অংশ নিলেও সে সময় বিএড ডিগ্রি না থাকায় তিনি ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সফল হননি। ''রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও, আমি টেট পাশ করেই এই নিয়োগ পেয়েছি,'' বুমকে বলেন আকাশ দাস।
বুমের তরফে কোন স্কুলে চাকরি পেয়েছেন জানতে চাওয়া হলে "ব্যক্তিগত তথ্য" বলে আকাশ প্রশ্নের জবাব দেননি।
প্রাইমারি টেট বৃত্তান্ত
২০১২ সালের টেট উত্তীর্ণরা নিয়োগ পান ২০১৩ সালে। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের তরফে আরও একবার ২০১২ সালের টেট অনুত্তীর্ণদের ২০১৪ সালে নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ২০১২ সালে টেট উত্তীর্ণরাও টেট স্কোরের মান বৃদ্ধির জন্য ২০১৪ সালে আবার পরীক্ষায় বসার সুযোগ পান। পুনরায় পরীক্ষায় বসার জন্য অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ পর্ষদের ওয়েবসাইট থেকে ডাইনলোড করে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান তাঁরা।
নতুন প্রাথীরা ২০১৪ সালে হাতে তোলা ফর্ম ফিলাপ করে পরীক্ষায় বসেন। ২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর নেওয়া সেই পরীক্ষা। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে ওই পরীক্ষার ফলাফল বের হয় ২০১৬ সালে। পিটিটিআই প্রশিক্ষিতরা মামলা করেন নিয়োগ পাবে শুধু প্রশিক্ষিতরা। বিচারপতি সিএস কারনান রায় দেন নিয়োগে প্রশিক্ষিতদের অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য।
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে নিয়োগের জন্য সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি করে পর্ষদ। তারমধ্যে ২০১৫ সালের টেটে বসা অপ্রশিক্ষিত প্রার্থী যারা পরে প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন তাঁরা প্রশিক্ষণের (বিএড/ডিএলএড) নথি জমা দেওয়ার সুযোগ পান। ২৩ ডিসেম্বর ২০২০ থেকে ৬ জানুয়ারি সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়ার ফর্ম ফিলাপ হয়। এই ফলাফল পর্ষদ বের করে ১৫ ফেব্রুয়ারি। প্রার্থীদের রোল নম্বর দিয়ে পর্ষদের ওয়েবসাইটে এমপ্যানেল কিনা যাচাই করতে বলা হয়। নির্বাচিত প্রার্থীদের ইমেল পাঠানো হয় জেলা প্রাইমারি কাউন্সিলে কাউন্সিলিংয়ের জন্য।
১৫ হাজার ২৮৪ জনের মেধা তালিকা প্রকাশ করা হয়। ফাঁকা রাখা হয় ১ হাজার ২১৬ টি পদ। আদালতে বিচারাধীন চাকুরিপ্রার্থীদের জন্য পদ খালি রাখা হয়।
ইতিমধ্যেই নথি যাচাই করে বেশ কয়েকটি জেলায় নিয়োগ পেয়েছে চাকুরিপার্থীরা। সদ্য কাজে নিযুক্ত হয়েছেন অনেকেই।
সোমবার কলকাতা হাই কোর্টে এই নিয়োগে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগে মামলা দায়ের করে প্রার্থীদের একাংশ। যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন তাঁদের চাকরি কী হবে? সংশ্লিষ্ট প্যানেল বাতিল হবে কিনা এখনও এপ্রসঙ্গে কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি পর্ষদের তরফে। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন।
২০১৭ সালে আবার প্রাইমারি টেট পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি বের হয়। সেই পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি। এই পরীক্ষার ফলাফল এখনও বের হয়নি।
আরও পড়ুন: ২০১৫'র গুজরাতে বিজেপির অনুষ্ঠানের ছবি কেরলে আদিত্যনাথের সভা বলে ভাইরাল