ভিডিওটি কি অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীর মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর দিকে ঝাঁপ দেওয়া?
বুম দেখে ২০১২ সালে নিউ মেক্সিকোয় অস্ট্রীয় স্কাইডাইভার ফেলিক্স বামগার্টনারের সুপারসনিক ফ্রিফল জাম্পে রেকর্ড গড়ার ভিডিও।
একটি ভাইরাল ভিডিওতে অস্ট্রিয়ার স্কাইডাইভার ফেলিক্স বামগার্টনারকে (Austrian skydiver Felix Baumgartner) দেখা যাচ্ছে। তিনি ২০১২ সালের অক্টোবরে একটি হিলিয়াম বেলুন (Helium Balloon) থেকে ভূপৃষ্ঠ থেকে ১,২৮,০৯৭ ফুট (1,28,097 Feet) উচ্চতায় স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে একটি রেকর্ড-ভাঙা সুপারসনিক ফ্রিফল ঝাঁপ দিয়েছিলেন। এই ভিডিওটি শেয়ার করে বিভ্রান্তিকর দাবি করা হচ্ছে যে, এক অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী (Australian Scientist) মহাশূন্য (Space) থেকে ঝাঁপ দিচ্ছেন এবং পৃথিবীর (Earth) বুকে নামছেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় যে কারমান লাইন, মহাকাশ সংক্রান্ত আইনের ক্ষেত্রে, এবং এরোস্পেস রেকর্ডের ক্ষেত্রে তাকেই আউটার স্পেস বা মহাশূন্যের সূচনাবিন্দু হিসাবে গণ্য করা হয়। বুম যাচাই করে দেখে ফ্রিফল ঝাঁপের যে রুদ্ধশ্বাস ভিডিওটি শেয়ার করা হচ্ছে,তা তুলনায় অনেক কম উচ্চতার। এই ঝাঁপটি দেওয়া হয়েছিল স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে (২৪ মাইলের বেশি উচ্চতা), ৩৯ কিলোমিটারের মতো উচ্চতা থেকে, মহাশূন্য থেকে নয়।
৪ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, কাস্টমাইজড স্পেসস্যুট পরিহিত এক ব্যক্তি হিলিয়াম বেলুন থেকে ঝাঁপ দিচ্ছেন এবং একটি প্যারাশুটের সাহায্যে সফলভাবে ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করছেন।
ভিডিওটির সঙ্গে যে ক্যাপশন রয়েছে, তাতে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে, "অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী মহাশূন্য ১,২৮,০০০ ফুট উচ্চতা থেকে ঝাঁপ দিলেন, এবং ভূপৃষ্ঠে পৌঁছলেন। ৪ মিনিট ৫ সেকেন্ড সময়ে তিনি মোট ১২৩৬ কিলোমাটির দূরত্ব পাড়ি দিলেন। তিনি স্পষ্ট দেখলেন যে পৃথিবী ঘুরছে। দুর্দান্ত ভিডিও দেখুন।
( ইংরেজিতে লেখা মূল ক্যাপশন: *Australian scientist jumped from space to a height of 1,28000 feet and reached the earth, completing the journey of 1236 km in 4 minutes and 5 seconds . He clearly saw the earth moving. Awesome video!*)
একই বিভ্রান্তিকর দাবির সঙ্গে ভিডিওটি ফেসবুকে ব্যপকভাবে শেয়ার করা হচ্ছে।
তথ্য যাচাই
বুম যাচাই করে দেখে ভিডিওটিতে যাঁকে দেখা যাচ্ছে তিনি অস্ট্রিয়ার স্কাইডাইভার ফেলিক্স বামগার্টনার। তিনি ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে একটি হিলিয়াম বেলুন থেকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে (২৪ মাইলের বেশি উচ্চতা) ভূপৃষ্ঠ থেকে ১,২৮,০৯৭ ফুট উচ্চতায় রেকর্ড-ভাঙা সুপারসনিক ফ্রিফল ঝাঁপ দিয়েছিলেন।
ভিডিওতে যাঁকে দেখা যাচ্ছে, তিনি এক জন অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী, এই দাবিটি ভুয়ো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় যে কারমান লাইন, মহাকাশ সংক্রান্ত আইনের ক্ষেত্রে এবং এরোস্পেস রেকর্ডের ক্ষেত্রে তাকেই আউটার স্পেস বা মহাশূন্যের সূচনাবিন্দু হিসাবে গণ্য করা হয়। ভাইরাল ভিডিওতে ফ্রিফল ঝাঁপের যে দৃশ্যটি দেখা যাচ্ছে, তা তুলনায় অনেক কম উচ্চতার। এই ঝাঁপটি দেওয়া হয়েছিল স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে, ৩৯ কিলোমিটারের মতো উচ্চতা থেকে, মহাশূন্য থেকে নয়।
ভিডিওটিতে অনেকগুলি দৃশ্য ও অডিও সূত্র রয়েছে। যেমন, যিনি ঝাঁপ দিচ্ছেন, তাঁকে ফেলিক্স নাম উল্লেখ করা হচ্ছে, ভিডিওটিতে বিবিসির একটি লোগো দেখা যাচ্ছে এবং তিন মিনিট ১৬ সেকেন্ডের মাথায় একটি বড় বোর্ড দেখা যাচ্ছে, যাতে লেখা "রেড বুল স্ট্র্যাটোস: মিশন কন্ট্রোল: রোজওয়েল, নিউ মেক্সিকো।"
এই কিওয়ার্ডগুলি ব্যবহার করে আমরা আসল ভিডিওটি খুঁজে পাই। ভিডিওটি ২০১৬ সালে আপলোড করা হয়েছিল। তার শিরোনাম ছিল, "স্পেস থেকে ঝাঁপ! - রেড বুল স্পেস ডাইভ - বিবিসি" (Jumping From Space! - Red Bull Space Dive - BBC) এবং ক্যাপশন ছিল, "সেই মুহূর্তটি উপস্থিত, এবার ফেলিক্স বামগার্টনার স্পেস ডাইভ করবেন। রেড বুল স্পেস ডাইভ থেকে নেওয়া।"
এই সুপারসনিক ফ্রিফল ঝাঁপ সম্বন্ধে বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে অস্ট্রিয়ার ফেলিক্স বামগার্টনারই প্রথম স্কাইডাইভার, যিনি শব্দের বেগের চেয়ে দ্রুততর গতিতে পৌঁছেছিলেন। তাঁর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় ৮৩৩.৯ মাইল (ঘণ্টায় ১,৩৪২ কিলোমিটার)।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয় যে, বামগার্টনার নিউ মেক্সিকোয় ভূপৃষ্ঠ থেকে ১২৮,০০০ ফুট উচ্চতায় (২৪ মাইল; ৩৯ কিলোমিটার) একটি বেলুন থেকে ঝাঁপ দেন, এবং রেড বুল স্ট্র্যাটোস মিশন-এর অংশ হিসাবে পূর্ববর্তী সর্বোচ্চ ফ্রিফল-এর রেকর্ডটি ভেঙে দেন।
বামগার্টনারের সুপারসনিক ঝাঁপটির স্পনসর ছিল এনার্জি ড্রিঙ্ক সংস্থা রেড বুল। ২০১২ সালের ১৫ অক্টোবর তারাও এই মিশনের হাইলাইট হিসাবে একটি ভিডিও আপলোড করে। সেই ভিডিওটির শিরোনাম ছিল, '১২৮,০০০ ফুট উচ্চতা থেকে ফেলিক্স বামগার্টনারের সুপারসনিক ফ্রিফল- মিশন হাইলাইটস'।
ক্যাপশনে লেখা হয়েছিল, "একটি হিলিয়াম বেলুনে ৩৯,০৪৫ মিটার (১২৮,১০০ ফুট) উচ্চতায় পৌঁছনোর পর ফেলিক্স বামগার্টনার বহু যুগ পরে মহাশূন্যের কিনারা থেকে ঝাঁপের রেকর্ডটি ভেঙে দিলেন। চাক ইয়াগার একটি এক্সপেরিমেন্টাল রকেট-পাওয়ার্ড বিমান চালিয়ে শব্দের গতিবেগকে টপকে যাওয়ার ঠিক ৬৫ বছর পর। ফেলিক্স তার ৪ মিনিট ২০ সেকেন্ড দীর্ঘ ফ্রিফলে প্রায় বায়ুশূন্য স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৩৫৭.৬ কিলোমিটার বা ৮৪৩.৬ মাইল বেগে পৌঁছলেন, তার পর বায়ুমণ্ডলের চাপ তার পতনের বেগ কমিয়ে দেয়।
বিবিসি-র ভিডিও এবং রেড বুলের ভিডিওর দৃশ্যগুলি ভাইরাল হওয়া ভিডিওর সঙ্গে মিলে যায়, ফলে প্রমাণ হয় যে, সেই ভিডিওগুলি এই রেকর্ড-ভাঙা ঘটনাটিরই।
রেড বুল স্ট্র্যাটোস মিশন এই ঝাঁপটিকে "মহাশূন্যের কিনারায় অভিযান" (Mission to the Edge of Space) হিসাবে উল্লেখ করেছে এবং বিবিসির ভিডিওর মতো অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও এই ঘটনাটিকে 'মহাশূন্য থেকে ঝাঁপ' বলা হয়েছে বটে, অনেকেই এই বর্ণনাটিকে প্রশ্ন করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন যে, মহাশূন্যের সীমানা হিসাবে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে স্বীকৃত হল কারমান লাইন, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) উচ্চতায় অবস্থিত।
নাসা/জেপিএল সোলার সিস্টেম অ্যাম্বাস্যাডার প্রোগ্রামের এক স্বেচ্ছাসেবক টম রাইস ২০১২ সালের ১৬ অক্টোবর ডব্লিউআরএএল নিউজ-এ একটি নিবন্ধে এই বিতর্ক সম্বন্ধে বলেন, "ফেলিক্স বামগার্টনারের ঝাঁপটি অবিশ্বাস্য, এবং তথ্যগুলি পরীক্ষা করা হয়ে গেলেই গতিবেগ (ঘণ্টায় ৮৩৩.৯ মাইল/ম্যাচ ১.২৪), ঝাঁপের উচ্চতা (১২৮,১০০ ফুট) এবং ফ্রিফল (১১৯,৮৪৬ ফুট) সংক্রান্ত রেকর্ডগুলি নথিভুক্ত করা হবে। কিন্তু একে যদি 'মহাশূন্যের কিনারা থেকে ঝাঁপ' বলা হয়, তা নিতান্তই কাব্যিক বর্ণনা।"
২০১৪ সালের ২৪ অক্টোবর গুগল-এর কর্মী অ্যালান ইউস্ট্যাস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ৪১,৪২২ মিটার (১৩৫,৮৯৮ ফুট) উচ্চতা থেকে ঝাঁপ দিয়ে ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করেন, এবং ফ্রিফল প্যারাশুট জাম্প হিসাবে ফেলিক্সের উচ্চতম রেকর্ডটি ভেঙে দিলেন।
আরও পড়ুন: ভুয়ো দাবিতে ছড়াল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইনজীবীর পোশাক পরা পুরনো ছবি