ফাস্টট্যাগ কেলেঙ্কারির অভিযোগ দাবিতে সাজানো ভিডিও সত্যি বলে ভাইরাল
ফেসবুকে মূল ভিডিওটি যিনি আপলোড করেছেন, তিনি বুমকে জানান ভিডিওটি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তৈরি করা হয়েছে।
ফাস্টট্যাগ কেলেঙ্কারির (FastTag Scam) অভিযোগ নিয়ে দুই ব্যক্তি কথা বলছে, এমন একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করে জনসাধারণকে সতর্ক করা হচ্ছে, তাঁরা যেন এই দুর্নীতিগ্রস্তদের ফাঁদে 'পা' না দেন।
বুম দেখলো, ভাইরাল এই ভিডিওটি সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে, এটি বাস্তবে ঘটছে, এমন নয়।
সত্যি ঘটনা বলে চালানো, কিন্তু অভিনয় করে তৈরি, এই ধরনের বেশ কয়েকটি ভিডিওর অতীতে পর্দাফাঁস করেছে বুমl দাবি করা হয়, এগুলি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বানানো হয়, কিন্তু সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা অনেকেই এগুলিকে সত্যই ধরে নেন।
আমাদের এই ধরনের তথ্য-যাচাইকারী প্রতিবেদনগুলি দেখে নিতে পারেন এখানে।
আলোচ্য ভিডিওটি একটি মোটরগাড়ির ভিতরে বসে তোলা হয়েছে এবং এক অল্পবয়সীকে গাড়ির কাচ পরিষ্কার করতেও দেখা যাচ্ছে। কাচ পরিষ্কার করা হয়ে গেলে ভিডিও রেকর্ডকারী ব্যক্তি তাকে ডেকে নিয়ে জিগ্যেস করেন, সে কেন তার এই পরিষেবার জন্য কোনও মজুরি চাইছে না! এর পর যেই না তিনি তরুণের কব্জিতে আঁটা ঘড়িটি নিয়ে প্রশ্ন করেন, তখনই সে ছুটে পালায়।
গাড়িতে বসা অন্য লোকটি তখন ওই তরুণের পিছু ধাওয়া করতে থাকে, আর সেই অবসরে রেকর্ডকারী ব্যক্তি ফাস্টট্যাগ কেলেংকারি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বলেন, এই কেলেংকারির নায়করা তরুণদের অত্যাধুনিক ঘড়ি সরবরাহ করে, যা দিয়ে ফাস্টট্যাগ-এর বেতার তরঙ্গ মাপা যায়। আর সেই ঘড়ি বা স্মার্টওয়াচ পরেই গাড়ির কাচ পরিষ্কার করার অজুহাতে ওই তরুণরা গাড়ির ফাস্টট্যাগের রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি মেপে নেয় এবং গাড়িতে লাগানো ফাস্টট্যাগে মালিক বা চালক যে টাকা ভরেছে, তা হাপিশ হয়ে যায়।
ভিডিওটির দ্বিতীয় অংশে দেখা যাচ্ছে, পলাতক তরুণটিকে পিছু-ধাওয়া করেও ধরা যায়নি।
ফাস্টট্যাগ কি?
ফাস্টট্যাগ হল গাড়িতে লাগানো একটি ট্যাগ, যাতে আগে থেকেই টাকা ভরা থাকে এবং ফুরিয়ে গেলে আবার টাকা ভরাও যায়l এর মাধ্যমে বিভিন্ন জাতীয় সড়কে বা সেতুতে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে যান্ত্রিকভাবে টোল সংগ্রহ করা হয়, মানুষের সাহায্য ছাড়াই। এই ট্যাগ লাগানো থাকলে টোল প্লাজায় গাড়ির চালককে আর গাড়ি থেকে নেমে নগদ টাকা দিয়ে ট্যাক্স মেটাতে হয় না, লাইনও দিতে হয় না, আপনিই ট্যাগে আগে থেকে ভরা তহবিল থেকে টাকা কেটে যায়। গাড়ির সামনের কাচ বা উইন্ডশিল্ডে লাগানো ট্যাগটিতেই রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি শনাক্ত করার প্রযুক্তি রয়েছে। তার মাধ্যমেই স্ক্যানার গাড়ির দেয় টোল বা ট্যাক্সের পরিমাণ ব্যাংককে জানিয়ে দেয়, আর সেখানের ফাস্টট্যাগ আমানত থেকে প্রয়োজনীয় টাকা কেটে নেওয়া হয়।
এনপিসিআই এবং এনএইচএআই-এর অধীন ২৩টি ব্যাংক এই ফাস্টট্যাগ পরিচালনা করে।
ভাইরাল ভিডিওটি সোশাল মিডিয়ায় বেশ সাড়া ফেলেছে এবং বেশ কয়েকজন ব্যবহারকারী এটিকে সত্যি বলে ধরেও নিয়েছে।
মূল ধারার সংবাদমাধ্যম পাঞ্জাব কেশরীও ভিডিওটি শেয়ার করেছে, যার হিন্দি ক্যাপশন হল, "সাবধান! রাস্তার মোড়ে বাচ্চারা আপনার গাড়ির কাচ পরিষ্কার করছে না তো?"
আরও কয়েকজন সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারী এই ভিডিওটি শেয়ার করেছেন এটিকে ফাস্টট্যাগ কেলেঙ্কারি আখ্যা দিয়ে। টুইটারে একই ক্যাপশন সহ ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে।
বুম-এর হেল্পলাইন নম্বরেও ভিডিওটি পৌঁছেছে তথ্য যাচাইয়ের জন্য।
তথ্য যাচাই
বুম ফেসবুকে ফাস্টট্যাগ নিয়ে খোঁজখবর করে দেখেছে, সেখানেও ব্যাকলোল ভিডিও নামের একটি যাচাই-করা পেজ-এ এই ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছে।
২৪ জুন, ২০২২ ভিডিওটি শেয়ার করে হিন্দি ক্যাপশন দেওয়া হয়েছে— "যদি আপনার গাড়িতে ফাস্টট্যাগ লাগানো থাকে, তাহলে এই ভিডিওটি দেখুন!"
(মূল হিন্দিতে ক্যাপশন: अगर आपकी गाडी पे FASTAG है तो ये वीडियो जरूर देखे)
বুম দেখে এই ভিডিও পেজটির ৪৭ লক্ষ অনুগামী আছে এবং পেজটির ভূমিকা অংশে লেখা আছে— "আমরা বিনোদন উপভোগ করি"! পেজটি ভিডিও রচয়িতা হিসাবেই শনাক্ত হয়েছে।
আমরা ওই পেজটিতে আপলোড হওয়া অন্যান্য ভিডিও-ও দেখেছি, এবং সেখানেও ফাস্টট্যাগ-এর ভিডিওতে দেখা দুই ব্যক্তিকেই অন্য নানা ভূমিকায় দেখা গেছে। সেই অন্য ভিডিওগুলি দেখতে ক্লিক করুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
এ থেকেই প্রমাণ হয়, ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যে দুই ব্যক্তিকে দেখা গেছে, তাঁরা উভয়েই অভিনেতা, যাঁরা বিভিন্ন চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করছেন। নীচে সেই ভূমিকাগুলির তুলনা করলেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়।
তথ্য যাচাই করতে গিয়ে বুম পেটিএম এবং ফাস্টট্যাগ-এর টুইটার হ্যান্ডেল থেকে করা কয়েকটি টুইটও পেয়েছে, যাতে এই ভিডিওটিকে সাজানো এবং অসত্য বলা হয়েছে।
পেটিএম-এর টুইটার হ্যান্ডেল থেকে পোস্ট করা হয়েছে, "একটি ভিডিওতে পেটিএম-এর ফাস্টট্যাগ সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, স্মার্টওয়াচ দিয়ে নাকি ফাস্টট্যাগ স্ক্যান করে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ফাস্টট্যাগের টাকা অনুমোদিত বাণিজ্যসংস্থা ছাড়া কেউ ভরতে বা তুলতে পারে না, এতটাই নিরাপদ ফাস্টট্যাগ-পেটিএম-এর বন্দোবস্ত।"
একই ভাবে ফাস্টট্যাগের টুইটার হ্যান্ডেল থেকেও একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয়েছে। "সোশাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ানো এই ভিডিওটি ভুয়ো এবং ভিত্তিহীন। নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মাথায় রাখুন, ১. প্রকাশ্য ইন্টারনেট সংযোগ মারফত কোনও লেনদেন করা হয় না, ২. ছবিতে যে সব পূর্বশর্ত আরোপ করা রয়েছে, সেগুলি পূরণ না করে কোনও লেনদেন সূচিত হতে পারে নাl এনপিসিআই ইতিমধ্যেই এই ধরনের বিভ্রান্তিকর ভিডিওকে সোশাল মিডিয়ার মঞ্চ থেকে ছাঁটাই করার ব্যবস্থা নিয়েছে।"
এ বিষয়ে আরও তথ্য জানতে বুম বাকলোল ভিডিও পেজটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। তাঁরা উত্তরে জানিয়েছে, এই ভিডিওটি অন্যগুলির মতোই সাজানো, অভিনীত চিত্রনাট্য, যার উদ্দেশ্যই হল জনচেতনা বৃদ্ধি করা।
সাইবার সুরক্ষা বিশেষজ্ঞের মতে ফাস্টট্যাগ একটি নিরাপদ বন্দোবস্ত
বুম এই বিষয় নিয়ে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রাহুল শশীর সঙ্গে কথা বলে। তিনি বুমকে জানান, "ব্যাপারটা এত সোজা নয় যে স্মার্টওয়াচ পরা কোনও বাচ্চা ছেলে ইচ্ছে করলেই ফাস্টট্যাগের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি থেকে টাকা বের করে নিতে পারবে। সুতরাং এই ভিডিও দেখে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কেবলমাত্র অনুমোদিত বাণিজ্যসংস্থাই টাকা কেটে নেবার অধিকার রাখে।"
"যদি কোনও হ্যাকার কখনও এটা চেষ্টা করে, তাহলেও তাকে অনুমোদিত ব্যাঙ্ক বা বাণিজ্যিক সংস্থার পরিকাঠামোয় অন্তর্ঘাত করতে হবে এবং সেখান থেকে টাকা কেটে নেওয়ার ভুয়ো অনুরোধ জানাতে হবে। কিন্তু সেটাও খুব সহজে হওয়ার নয়, যেহেতু কেটে নেওয়া টাকাটা যে-কোনও ব্যাংকের আমানতে জমা পড়ে না, যে ব্যাংক বা বাণিজ্যসংস্থার সঙ্গে গ্রাহকের চুক্তি রয়েছে, শুধু সেখানের আমানতেই জমা পড়বে", জানালেন শশী।
শশীও ভিডিওটির সঙ্গে একটি বিবৃতি তাঁর লিংকড-ইন অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন। বুমকে তিনি জানান—সামগ্রিকভাবে ফাস্টট্যাগের বন্দোবস্তটা খুবই নিশ্ছিদ্র ও নিরাপদ।
আরও পড়ুন: না, ভাইরাল ভিডিওটি অযোধ্যায় হিন্দু রাষ্ট্রের জন্য কলস যাত্রার দৃশ্য নয়