ভারতে মাথাপিছু আয় এখন দ্বিগুণ, বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার দাবি সত্যি?
মুদ্রাস্ফীতি হার ধার্তব্যে না এনে মধ্যপ্রদেশ ও ভারতের জিডিপি অঙ্ক, আয়ের সূচক বাড়তে নাড্ডা মর্জিমাফিক তথ্য বেছে নেন।
![ভারতে মাথাপিছু আয় এখন দ্বিগুণ, বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার দাবি সত্যি? ভারতে মাথাপিছু আয় এখন দ্বিগুণ, বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার দাবি সত্যি?](https://bangla.boomlive.in/h-upload/2022/06/13/979285-978863-jp-nadda-01.webp)
ভারতীয় জনতা পার্টির (BJP) সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডা (Jagat Prakash Nadda) দাবি করেছেন যে, ভারতের মাথাপিছু মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GDP) ৭৯,০০০ টাকা থেকে কার্যত দ্বিগুণ হয়ে ১.৫ লক্ষ টাকায় পৌঁছেছে। দাবিটি বিভ্রান্তিকর। নাড্ডা তাঁর দাবির পক্ষে আর কোনও তথ্যপ্রমাণ পেশ করেননি।
বুম ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখে, এবং লক্ষ করে যে, নাড্ডা তাঁর সুবিধা অনুসারে কিছু পরিসংখ্যান বেছে নিয়েছেন। গত আর্থিক বর্ষে ভারতে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ দেড় লক্ষ টাকার অনেক বেশিই হয়েছে— অর্থাৎ, নাড্ডার দাবির চেয়ে বেশি— কিন্তু সেই হিসাবটি নমিনাল প্রাইস, অর্থাৎ চলতি নগদ মূল্যের। যেহেতু এই হিসাবটি চালু অর্থবর্ষের মূল্যস্তর অনুসারে কষা হয়, তাই এই পরিসংখ্যানটি অন্য কোনও বছরের (বা অন্য কোনও সময়কালের) পরিসংখ্যানের সঙ্গে তুলনীয় নয়, কারণ এতে মূল্যস্ফীতির ফলে পণ্যমূল্যের ওঠাপড়ার প্রভাব থাকে।
দু'টি পৃথক সময়কালের জিডিপির তুলনা করতে হলে যে হিসাবটি দেখতে হয়, তা হল প্রকৃত মূল্যে জিডিপি। সেই অঙ্কের নিরিখে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি এখনও দেড় লক্ষ টাকায় পৌঁছায়নি, অর্থাৎ নাড্ডা যা দাবি করেছেন, ভারতের মাথাপিছু জিডিপি তার চেয়ে কম। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের অনুমান, ২০২৭ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ দেড় লক্ষ টাকায় পৌঁছবে।
মধ্যপ্রদেশের ভুপালে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে নাড্ডা এই দাবিটি করেন। ভারতের জিডিপি সংক্রান্ত দাবির পাশাপাশি তিনি আরও দাবি করেন যে, গত বছরের তুলনায় মধ্যপ্রদেশের জিডিপি বেড়েছে ১৯.৭ শতাংশ হারে, এবং সেই রাজ্যে বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ বেড়ে দাড়িয়েছে ১.২৪ লক্ষ টাকায়। বুম অনুসন্ধান করে দেখল যে, এই দাবিটিও বিভ্রান্তিকর, কারণ এই ক্ষেত্রেও অঙ্কগুলি নমিনাল, অর্থাৎ চালু বছরের মূল্যস্তরের নিরিখে কষা। তার ফলেই রাজ্যের অর্থনৈতিক সূচকগুলিকে প্রকৃত চেহারার চেয়ে উজ্জ্বলতর দেখাচ্ছে।
মধ্যপ্রদেশের আর্থিক বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এই সংখ্যাগুলি উল্লেখ করেছেন নাড্ডা। মধ্যপ্রদেশ ভারতের আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলির অন্যতম বলে পরিচিত; এবং এই রাজ্যটি ভারতের বিমারু (বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যগুলির অন্যতম।
নাড্ডার মন্তব্যটি নীচে দেখা যাবে।
এর আগে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান এবং মধ্যপ্রদেশ রাজ্য বিজেপির সভাপতি ভি ডি শর্মাও বিবৃতি দিয়ে জানান যে, রাজ্যের জিডিপি ১৯.৭৪ শতাংশের তাৎপর্যপূর্ণ হারে বাড়ছে।
এই সংখ্যাগুলির তথ্য যাচাই করার আগে এক বার দেখে নেওয়া যাক, স্থির ও চালু মূল্যস্তরের নিরিখে জিডিপি (জিডিপি অ্যাট কনস্ট্যান্ট অ্যান্ড কারেন্ট প্রাইসেস) বলতে ঠিক কী বোঝায়।
টাকার অঙ্কে জিডিপি ও প্রকৃত জিডিপি
যে কোনও দেশের ভৌগোলিক সীমান্তের মধ্যে যে পণ্য ও পরিষেবা উৎপন্ন হয়, কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়কালে টাকার অঙ্কে সেই উৎপাদিত পণ্য ও পরিষেবার মূল্যকেই বলা হয় জিডিপি। কিন্তু, কোন মূল্যস্তর ব্যবহার করে এই হিসাবটি কষা হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে জিডিপি-র হিসাবটি নমিনাল অর্থাৎ বর্চমান মূল্যস্তরের নিরিখে, না কি রিয়াল, বা প্রকৃত উৎপাদন।
বুম জিডিপির বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে বোঝার জন্য ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক গ্রোথ-এর আরবিআই চেয়ার প্রফেসর সব্যসাচী করের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
তিনি বলেন, "কোনও দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়কালে, সাধারণত এক বছরে, মোট যে পরিমাণ পণ্য ও পরিষেবা উৎপন্ন হয়, চলতি বাজারদরে তার অর্থমূল্যকেই নমিনাল জিডিপি বলা হয়, এবং সেই নির্দিষ্ট সময়কালে দেশে মোট কত আয় উপার্জিত হয়েছে, এটি তার একটি আনুমানিক মাপ।
"মনে রাখা প্রয়োজন যে, যে কোনও দু'টি সময়কালে এই নমিনাল জিডিপির অঙ্কে তারতম্য হয় দু'টি কারণে— এক, পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদনের প্রকৃত পরিমাণে পরিবর্তন ঘটার জন্য; এবং দুই, মূল্যস্ফীতির কারণে। কাজেই,নমিনাল জিডিপির ১০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটলে এমনটাও হতে পারে যে, প্রকৃত উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে পাঁচ শতাংশ, আর বাকি পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে মূল্যস্ফীতির কারণে," অধ্যাপক কর আরও জানালেন।
নমিনাল জিডিপির বৃদ্ধির কতখানি প্রকৃত উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে ঘটছে, তা কতখানির জন্য দায়ী মূল্যস্ফীতি, যেহেতু তার কোনও সুনির্দিষ্ট বিভাজন সম্ভব হয় না, ফলে দু'টি বছরের নমিনাল জিডিপির মধ্যে তুলনা করা গোলমেলে। এই সমস্যাটি দূর করতে প্রকৃত জিডিপির হিসাবও করা হয়। "রিয়াল জিডিপি বা প্রকৃত জিডিপি নির্ণয় করার জন্য নমিনাল জিডিপি থেকে মূল্যস্ফীতির পরিমাণটি বাদ দেওয়া হয়। মূল্যস্ফীতির অঙ্কটি হিসাব করা হয় একটি মূল্যসূচক ব্যবহার করে," জানালেন অধ্যাপক কর।
রিয়াল এবং নমিনাল, জিডিপির দুই হিসাবেরই ব্যবহার আছে। অধ্যাপক কর জানালেন, "কোন হিসাবটি ব্যবহার করা হবে, তা নির্ভর করে ব্যবহারের উদ্দেশ্যের উপর। উদ্দেশ্য যদি হয় আয়ের তুলনা করা— ধরুন, সরকার বুঝতে চাইছে যে, কর রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কী ভাবে বাড়ানো যায়— তখন নমিনাল জিডিপির অঙ্কটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, অর্থনীতির বেশির ভাগ প্রয়োজনেই প্রকৃত জিডিপির অঙ্কটি ব্যবহার করা ভাল, যেমন দু'টি আলাদা সময়কালে নাগরিকদের কল্যাণের মধ্যে তুলনা করার ক্ষেত্রে। এই তুলনা করার জন্য নমিনাল জিডিপি থেকে মূল্যস্ফীতির অঙ্কটি বাদ দেওয়া হয়।"
আরও পড়ুন: গুজরাতে অগ্নিকাণ্ডের ভিডিও পশ্চিমবঙ্গে হিংসার ঘটনা বলে ছড়াল
নাড্ডার বক্তব্যের তথ্য যাচাই
১. ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৭৯,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ১.৫ লক্ষ টাকা হয়েছে
যদিও নাড্ডা বলেছেন যে, ভারতের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ৭৯,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ১.৫ লক্ষ টাকা হয়েছে, কিন্তু তাঁর বিবৃতিতে তিনি কোন সময়কালের কথা বলছেন, তার উল্লেখ ছিল না, অন্য কোনও তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশকেরও উল্লেখ ছিল না।
কোনও একটি অর্থব্যবস্থায়, বা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় (যেমন কোনও দেশ, রাজ্য, বা গোটা বিশ্ব) মানুষের গড় আয়কেই পার ক্যাপিটা ইনকাম বা মাথাপিছু আয় বলা হয়। সেই এলাকার জিডিপিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয়ের অঙ্কটি পাওয়া যায়।
বুম ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া মাথাপিছু আয়ের সারণিটি ব্যবহার করে, যেখানে ২০১১-১২ অর্থবর্ষকে ভিত্তিবছর হিসাবে ধরে ২০০৪-০৫ অর্থবর্ষ থেকে মাথাপিছু আয়ের হিসাব দেওয়া আছে।
সেই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে ভারতে চলতি বছরের মূল্যস্তরে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ৮০,৫১৮ টাকা (নাড্ডার উল্লেখ করা ৭৯,০০০ টাকার চেয়ে সামান্য বেশি)। তবে, ধ্রুব মূল্যস্তরে হিসাব করলে জিডিপির অঙ্কটি এই স্তরে পৌঁছেছিল ২০১৪-১৫ সালে।
পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যাচ্ছে যে, চলতি বছরের মূল্যস্তরে হিসাব করলে ভারতের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি দু'বার ১.৫ লক্ষ টাকার সীমা অতিক্রম করেছে: ২০১৯-২০ ও ২০২১-২২ অর্থবর্ষে। কিন্তু, এই হিসাবগুলির তুলনা বিভ্রান্তিকর, কারণ দু'টি আলাদা বছরের নমিনাল জিডিপির মধ্যে সরাসরি তুলনা করা চলে না।
ভারতের মাথাপিছু প্রকৃত জি়ডিপির অঙ্ক এখনও দেড় লক্ষ টাকার সীমা অতিক্রম করতে পারেনি।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান নীচে দেওয়া হল।
ভারতের মাথাপিছু জিডিপি (চালু মূল্যস্তরে এবং ধ্রুব মূল্যস্তরে)
ভিত্তিবছর ২০১১-২০১২
সাল | মাথাপিছু জিডিপি (ধ্রুব মূল্যস্তর) | মাথাপিছু জিডিপি (চালু মূল্যস্তর)
|
২০১১-১২ | ৭১,৬০৯ | ৭১,৬০৯ |
২০১২-১৩ | ৭৪,৫৯৯ | ৮০,৫১৮ |
২০১৩-১৪ | ৭৮,৩৪৮ | ৮৯,৭৯৬ |
২০১৪-১৫ | ৮৩,০৯১ | ৯৮,৪০৫ |
২০১৫-১৬ | ৮৮,৬১৬ | ১০৭,৩৪১ |
২০১৬-১৭ | ৯৪,৭৫১ | ১১৮,৪৮৯ |
২০১৭-১৮ | ১০০,০৩৫ | ১৩০,০৬১ |
২০১৮-১৯ | ১০৫,৫২৬ | ১৪২,৩২৮ |
২০১৯-২০ | ১০৮,৬৪৫ | ১৫১,৭৬০ |
২০২০-২১ | ৯৯,৬৯৪ | ১৪৫,৬৮০ |
২০২১-২২ | ১০৭,৬৭০ | ১৭২,৯১৩ |
২. মধ্যপ্রদেশে জিডিপির বৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু জিডিপি
মধ্যপ্রদেশের জিডিপি ১৯.৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, নাড্ডার এই দাবিটি ভুল নয়।
মধ্যপ্রদেশের ২০২১-২২ অর্থবর্ষের অর্থনৈতিক সমীক্ষয় দেখা যাচ্ছে যে, ২০২০-২১ সালে রাজ্যের মোট আয় যেখানে ৯,৭৬,২৮১ কোটি টাকা ছিল, সেখানে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে তা বেড়ে ১১,৬৯,০০৪ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে অনুমান। অর্থাৎ বৃদ্ধির পরিমাণ ১৯.৭৪ শতাংশ। কিন্তু, এই হিসাব নমিনাল জিডিপির, এর মধ্য মূল্যস্ফীতির অঙ্কটিও রয়েছে।
২০২১ অর্থবর্ষে রাজ্যের প্রকৃত জিডিপি ছিল ৫,৬৪,৫১৪ কোটি টাকা, যা ২০২২ অর্থবর্ষে বৃদ্ধি পেয়ে ৬,২১,৬৫৩ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা। অর্থাৎ, এই পরিসংখ্যান অনুসারে প্রকৃত জিডিপির বৃদ্ধির হার ১০.১২ শতাংশ।
![](https://bangla.boomlive.in/h-upload/2022/06/13/979304-978737-gsdp-estimates-mp.webp)
মধ্যপ্রদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে আরও জানা যায় যে, রাজ্যের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ সত্যিই ১,০৪,৮৯৬ টাকা থেকে বেড়ে ১,২৪,৬২৬ টাকায় পৌঁছেছে (নাড্ডা যে অঙ্কটি উল্লেখ করেছেন), অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ১৮.৮৭ শতাংশ। কিন্তু আবারও এই অঙ্কগুলি নমিনাল জিডিপির, যার মধ্যে মূল্যস্ফীতির অঙ্কটিও ঢুকে রয়েছে।
মধ্যপ্রদেশে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপি ছিল ৫৮,৩৩৪ টাকা, যা ৮.৫৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ অর্থবর্ষে ৬৩,৩৪৫ টাকায় দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা।
নীচে এই পরিসংখ্যানটি দেখা যাবে।
![](https://bangla.boomlive.in/h-upload/2022/06/13/979305-978738-per-capita-income-mp.webp)