পশ্চিমবঙ্গ সরকার করোনা মোকাবিলায় রাষ্ট্রসংঘের শান্তি পুরস্কার পেল? একটি তথ্যযাচাই
বুম দেখে 'ইউনাইটেড নেশন পিস অ্যাসোসিয়েশন' জাপানের একটি অলাভজনক সংস্থা, এর সঙ্গে রাষ্ট্রসংঘের লোগো ও নামের ফারাক রয়েছে।
করোনা মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের প্রশংসা করে ২০২০ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের তৎকালীন শ্রম প্রতিমন্ত্রী নির্মল মাঝিকে জাপানি অলাভজনক সংস্থা ইউনাইটেড নেশন পিস অ্যাসোসিয়েশন (United Nation World Peace Association or UNWPA) সংস্থার তরফে শংসাপত্র পাঠানোর ঘটনা ভুয়ো দাবি সহ সোশাল মিডিয়ায় আবার ভাইরাল হল। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্টে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে, করোনা মোকাবিলায় অসাধারণ ভূমিকার জন্য রাষ্ট্রসংঘের (United Nations) শান্তি পুরস্কার পেল পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) রাজ্য সরকার।
মে মাস জুড়ে চলা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে রাজ্যের দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুতে কিছুটা রাশ টানা গেছে। ৮ জুনের বুলেটিন অনুযায়ী ২৪ ঘন্টায় মৃতের সংখ্যা নামল দুই অঙ্কে। মারা গেছেন ৯৮ জন। ২৪ ঘন্টায় সংক্রমিত হয়েছেন ৫,৪২৭ জন। এই আবহেই শেয়ার করা হচ্ছে ভাইরাল গ্রাফিক পোস্টটি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিসহ একটি গ্রাফিক পোস্ট শেয়ার করা হয়েছে, তার সঙ্গে লেখা, "করোনা মোকাবিলায় অসাধারণ ভূমিকার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তি পুরস্কার পেল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।"
এই গ্রাফিক পোস্টটি ফেসবুকে শেয়ার করে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, " আমাদের বাংলায় সিপিএম বিজেপি, কংগ্রেস, আর কেন্দ্রীয় দল বাংলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে রাজনীতি করেছিল এরা করোনাকালে। রাষ্ট্রসংঘ করোনা মোকাবিলার জন্য বাংলাকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তি পুরস্কার দিল। আজ দিদির মুকুটে আরেকটি সাফল্যের পালক যুক্ত হলো। জয় বাংলা।"
পোস্টটি দেখা যাবে এখানে। পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
বুম ফেসবুকে কিওয়ার্ড সার্চ করে ২০২০ সালের অগস্ট মাসের একাধিক পোস্ট খুঁজে পায়। ওই পোস্টগুলিতে রাজ্যের তৎকালীন শ্রম প্রতিমন্ত্রী নির্মল মাজিকে রাষ্টপুঞ্জের তরফে সম্মান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
নির্মল মাজি তৃণমূল কংগ্রেসের চিকিৎসক বিধায়ক। বিধায়ক নির্মল মাজি বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের চিকিৎসক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি। আগে ওয়েস্টবেঙ্গল মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পদে ছিলেন।
গত বছরের পুরনো ফেসবুক পোস্টে ক্যাপশন লেখা হয়েছিল, "করোনা যোদ্ধা হিসাবে রাষ্টপুঞ্জের সম্মান পেলেন উলুবেড়িয়া উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের নব রূপকার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মাননীয় ডাঃ নির্মল মাজি মহাশয়। মমতা সরকারের ভূয়সী প্রশংসা রাষ্ট্রপুঞ্জের, বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি নির্মল মাজিকে।"
এরকম একটি ফেসবুক পোস্ট আর্কাইভ করা আছে এখানে।
বুম টুইটারে সার্চ করে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রচারের পেজ থেকে ১৯ অগস্ট ২০২০ তারিখের একটি টুইট খুঁজে পায়। ওই টুইটে লেখা হয়, "মানবজাতি আপনার নিরাপদ হাতের মুঠোয়" @Unpwa_wpa বলেছে। আমরা এই কথাটি জানাতে পেরে অত্যন্ত গর্বিত যে @MamataOfficial এবং জিডব্লিউবি'র কোভিড পরিচালনার দূরদর্শনীয় নেতৃত্ব আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। @DrNirmalMajhi1 সম্মানিত ইউএনডাব্লুপি-এর কাছ থেকে এই প্রশংসা পত্র পেয়েছেন।"
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
বুম আর্কইভ-এ এই টুইটের বয়ান সার্চ করে দেখে তৃণমূল কংগ্রেসের যাচাই করা টুইটার হ্যান্ডেল থেকে এই একই বয়ানে টুইট করা হয়েছিল। বর্তমানে অবশ্য এই টুইটটি ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে।
২০২০ সালের ১৭ অগস্ট লেখা ওই চিঠির রেফারেন্স নম্বর ৪৯/০১/আইএনডি। রাষ্ট্রসংঘের মত দেখতে একই রকমের লোগো সহ চিঠিটির লেটারহেডে ইংরেজিতে বড় হরফে লেখা রয়েছে, "ইউনাইটেড নেশন ওয়ার্লড পিস অ্যাসোসিয়েশন পিস অ্যান্ড হিউম্যানেটেরিয়ান মিশন।" (মূল ইংরেজিতে: "United Nation World Peace Association Peace Humanitarian Mission")। ওই চিঠিতে সই রয়েছে এইচ.ই. ফুসাও কিটাগাওয়া (H. E Fusao Kitagawa) ও এইচ.ই টাডাকি ইনুয়ি (H. E Tadaaki Inoue) নামে দুই ব্যক্তির।
আরও পড়ুন: ২০১৭'র বিহারের বেহাল রাস্তার ছবি বাংলার বলে জিইয়ে উঠল
তথ্য যাচাই
রাষ্ট্রসংঘের শংসাপত্র নয়
বুম ইউনাইটেড নেশন ওয়ার্লড পিস অ্যাসোসিয়েশন বা ইউএনপিএ (United Nation World Peace Association or UNWPA) সার্চ করলে সংস্থাটির ওয়েবসাইটের হদিস পায়। সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাটটির "অ্যাবাউট আস"-এ লেখা হয়েছে, "ইউনাইটেড নেশন ওয়ার্লড পিস অ্যাসোসিয়েশন জাপানের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অধীন ইউরোপিয়ান কমিশনে নথিভুক্ত যার আইনি বিভাগ ইউনাইটেড নেশন ইএসএ সিভিল সোশাইটি।"
বুম ইউনাইটেড নেশন ইএসএ সিভিল সোসাইটি নামে কোনও প্রতিষ্ঠানের হদিস পায়নি। তবে এটি ইউনাইটেড নেশনস ডিপার্টমেন্ট অফ ইকোনমিক এ্যান্ড সোশাল অ্যাফায়ার্স (United Nations Department of Economic and Social Affairs or UN DESA)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা সে ব্যাপারে বুম যথেষ্ঠ তথ্য খুঁজে পায়নি।
আরেকটি ওয়েবাসাইট (en.unwpa.org) দাবি করে না যে এটি রাষ্ট্রসংঘের অধীনস্ত কোনও সংস্থা। এই ওয়েবসাইটটির দাবি ফুসাও কিটাগাওয়া (Fusao Kitagawa) ও টাডাকি ইনুয়ি (Tadaaki Inoue) সংস্থাটির একজিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট।
সংস্থাটির উদ্দেশ্য হিসেবে লেখা হয়েছে, "ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্লড পিস অ্যাসোসিয়েশনের লক্ষ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের কাছে সুফল পৌছে দেওয়া যা থেকে পরিবেশ, সামাজিক সমস্যা, দরিদ্রতার সারা বিশ্বে সমাধান পাওয়া যায়। জঙ্গি সমস্যা, অপরাধ, বেশ্যাবৃত্তি, দূর্ণীতি, কর্তব্যে গাফিলতি, অন্যায় প্রভৃতি সমস্যায় জর্জরিত দেশে বাস করা কোটি কোটি শিশুকে সাহায্য করা।" সংস্থাটির আরও কাজকর্ম পড়া যাবে এখানে।
১৭ অগস্ট ২০২০ লেখা চিঠি যার রেফারেন্স নম্বর ৪৯/০১/আইএনডি তাতে বড় হরফে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, "ইউনাইটেড নেশন ওয়ার্লড পিস অ্যাসোসিয়েশন পিস অ্যান্ড হিউম্যানেটেরিয়ান মিশন।" এই চিঠিতে সই রয়েছে এইচ.ই. ফুসাও কিটাগাওয়া (H. E Fusao Kitagawa) ও এইচ.ই টাডাকি ইনুয়ি (H. E Tadaaki Inoue)-এর।
রাষ্ট্রসংঘের সব সংস্থারই নামে "ইউনাইটেড নেশনস" (United Nations) কথাটির উল্লেখ থাকে কিন্তু এই চিঠি ও সংস্থাটির নামে "ইউনাইটেড নেশন" (United Nation) শব্দ লেখা রয়েছে।
বুম রাষ্ট্রসংঘ বা "ইউনাইটেড নেশনস" ও ইউএনপিএ-এর লোগোর তুলনা করে দেখতে পায়, রাষ্ট্রসংঘের লোগোতে বিশ্ব মানচিত্র ও বৃত্তের রঙ একই রঙের ও স্বচ্ছ। কিন্তু ইউএনপিএ-এর লোগোতে বিশ্ব মানচিত্র ও বাইরের বৃত্তের রঙ গাঢ় নীল আর তার সাথে একটি সাদা রঙের ওরিগ্যামি পাখি ও দুটো ফুল রয়েছে।
বুম আগে বর্ণনা করা ইউএনপিএ-সংক্রন্ত দুটি ওয়েবসাইটে যোগাযোগের জন্য কোনও ইমেল খুঁজে পায়নি। কনট্যাক্ট পেজে প্রয়োজনীয় প্রশ্ন পাঠালেও কোনও প্রত্যুত্তর পায়নি।
বুম দেখে ১৯ অগস্ট ২০২০ প্রকাশিত ডেকান হেরল্ডের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায় সেখানে ইউএনপিএ সংস্থাকে অলাভজনক জাপানি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে। বুম নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি রাষ্ট্রসংঘের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
আরও পড়ুন: পলাতক ব্যবসায়ী নীরব মোদীর বক্তব্য বলে ছড়াল মিথ্যে বিবৃতি