লাল কেল্লায় কি Khalistan পতাকা ওড়ানো হয়েছে? একটি তথ্যযাচাই
বুম দেখে উত্তোলিত পতাকাগুলি নিশান সাহিব ও এক কৃষক সংগঠনের। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ জানাল সংশ্লিষ্ট পোলে পতাকা টাঙানো হয়নি।
একাধিক সোশাল মিডিয়া পোস্টে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে যে, প্রতিবাদী কৃষকরা লাল কেল্লায় (Red Fort) ভারতের পতাকা সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় খালিস্তানি পতাকা (Khalistani Flag) লাগিয়ে দেয়। বুম দেখে, বিক্ষোভকারীরা শিখ ধর্মীয় পতাকা নিশান সাহিব (Nishan Sahib) ও কিষাণ মজদুর একতা (Kisan Mazdoor Ekta) সংগঠনের পতাকা ওড়ায় সেখানে। পতাকাগুলি লাগানো হয় একটি খালি পোলের ওপর। কেল্লার মাঝখানে লাগানো ভারতের পতাকা (Indian Flag) অক্ষত রয়েছে।
২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসে, কৃষকদের বিক্ষোভ হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। দিল্লির কিষাণ ট্র্যাক্টর র্যালিতে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বেঁধে যায় একাধিক জায়গায়। বিক্ষোভকারীদের একাংশ ব্যারিকেড ভেঙে লাল কেল্লাতেও ঢুকে পড়ে।
কিছু কিছু পোস্টে দাবি করা হয় যে, কৃষকরা ভারতের তেরঙা পতাকা খুলে ফেলে তার জায়গায় নিজেদের পতাকা লাগিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন: চিনে দ্রুত গতির ভাসমান ট্রেন বলে ছড়াল ভিডিও গেমের দশ্য
তথ্য যাচাই
বুম দেখে দুটি দাবিই মিথ্যে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, কৃষকরা ভারতের পতাকা খুলে ফেলেননি ও খালিস্তানের পতাকাও লাগান হয়নি। যা লাগানো হয়েছিল, তা হল শিখদের ধর্মীয় ফ্ল্যাগ নিশান সাহিব ও কৃষক ইউনিয়ন কিষাণ মজদুর একতা-র পতাকা।
দাবি-১: কৃষকরা ভারতের পতাকা খুলে ফেলে
বিক্ষোভকারী কৃষকরা ফেসবুকে যে সব ভিডিও আপলোড করেন, আমরা সেগুলি খুঁটিয়ে দেখি। দেখা যায়, যে পোলে তাঁরা পতাকা লাগান, তাতে ভারতের পতাকা লাগানো ছিল না।
একটি ফেসবুক লাইভে, ট্র্যাক্টরে করে, নাচতে নাচতে, গান গাইতে গাইতে কৃষকদের আসতে দেখা যায়। ভিডিওটি লাল কেল্লার বাইরের প্রাচীরের ওপার থেকে তোলা। তাতে পুরো কেল্লাটি সমেত যে পোলে পতাকা লাগানো হচ্ছে, সেটিও দেখা যায়। ওই পোলটি ফাঁকা। ভারতের পতাকা উড়ছে কেবল মাঝখানে, সাদা গম্বুজগুলি যেখানে আছে, সেইখানে।
নিচে ওই ভিডিওর একটি স্ক্রিনশট দেওয়া হল।
সম্পূর্ণ ভিডিওটি দেখা যাবে এখানে। সেটির সব দৃশ্যেই দেখা যাচ্ছে যে, পোলটির ওপর কোনও ফ্ল্যাগ নেই।
আমরা আরও একটি ফেসবুক লাইভ দেখতে পাই। তাতে ফ্ল্যাগ পোলের ঠিক নীচে পুলিশ কর্মীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ৩ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের মাথায়, আমরা দেখতে পাই, ওই খালি পোলের পাশে পুলিশরা দাঁড়িয়ে আছেন, আর কৃষকরা কেল্লার নীচে। ১১ মিনিট ৩ সেকেন্ডের মাথায়, কৃষকরা দৌড়ে পোলটির কাছে পৌঁছে যান। তাঁদের এক জনের হাতে ছিল একটি তিনকোণা হলুদ পতাকা। দুটি দৃশ্যেই দেখা যাচ্ছে যে, পোলটির মাথায় কোনও পতাকা নেই। অর্থাৎ, সেখান থেকে ভারতের পতাকা খুলে অন্য পতাকা লাগানো হয়নি।
১৩ মিনিট ২২ সেকেন্ডের মাথায়, প্রথম বিক্ষোভকারী পোলে উঠে পতাকা লাগানোর চেষ্টা করেন। সেখানেও দেখা যায়, পোলের মাথায় কোনও পতাকা নেই। ১৬ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের মাথায়, আরও দু'জন কৃষক ওঠার চেষ্টা করেন। সেই সময়েও পোলের মাথায় কোনও পতাকা ছিল না। অবশেষে, ২৩ মিনিট ৪২ সেকেন্ডের মাথায় আরও এক ব্যক্তিকে উঠতে দেখা যায়। এবং তিনি পোলের মাথায় পতাকা লাগাতে সক্ষম হন। তাই দেখে সমবেত জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে।
আমরা তিনটি দৃশ্য নীচে দিলাম। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, পোলের মাথাটা সব সময়েই খালি ছিল।
ওই একই ভিডিও নীচে দেখা যাবে।
সংবাদ সংস্থা এএনআই-এর টুইট-করা ফুটেজও পতাকা তোলার পোলের মাথায় ভারতের পতাকা ছিল না।
আমরা ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের (এএসআই) সঙ্গে যোগাযোগ করি। এএসআই-এর একজন আধিকারিক জানান যে, প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ওই সংশ্লিষ্ট পতাকা তোলার পোলটির ওপর ভারতের পতাকা লাগানো ছিল না। উনি বলেন, "ভারতের বড় পতাকাটি রোজই লাল কেল্লায় তোলা হয়। তা ছাড়া, স্বাধীনতা দিবসে সাদা গম্বুজগুলিতে ছোট আকারের ভারতীয় পতাকা লাগানো হয়। যে পতাকা তোলার পোলগুলিতে কৃষকরা তাঁদের পতাকা তোলেন, সেগুলিতে ভারতের পতাকা লাগানো ছিল না।" নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আধিকারিক, কৃষকদের কাজটিকে উপেক্ষা করার সুরে বলেন, "ওই জায়গায় ঢোকাটা বেআইনি ছিল। কিন্তু সেখানে তাঁরা কোনও পতাকা খোলেননি।"
দাবি-২: কৃষকরা খালিস্তানি পতাকা লাগান
বুম দেখে কৃষকরা শিখ ধর্মীয় পতাকা নিশান সাহিব লাগান। পরে, কৃষক ইউনিয়ন কিষাণ মজদুর একতা-র পতাকাও লাগানো হয়।
এএনআই-এর একটি টুইটে দুটি পতাকাই দেখতে পাই আমরা। দেখা যায়, খালিস্তান আন্দোলনের পতাকার সঙ্গে সেগুলির কোনও মিল নেই।
কমলা রঙের তিনকোণা যে পতাকাটি প্রথমে লাগানো হয়, আমরা সেটি শিখ ধর্মীয় পতাকা নিশান সাহিব আর গেট্টি ইমেজেস থেকে পাওয়া খালিস্তান আন্দোলনের পতাকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। দেখা যায়, যে পতাকাটি প্রথমে লাগানো হয়, রঙ আর আকৃতিতে সেটি নিশান সাহিবের সঙ্গে মিলে যায়। খালিস্তান আন্দোলনের যে পতাকা গেট্টি ইমেজেস-এ আছে, এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ গোষ্ঠীগুলি যেটি ব্যবহার করে, সেটির রঙ হলুদ ও আকৃতি চৌকো। সেটির মাঝখানে শিখদের প্রতীক 'খণ্ড' আঁকা আর 'খালিস্তান' লেখা থাকে।
নিশান সাহিব কি?
নিশান সাহিব হল শিখ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পতাকা, যা সাধারণত গুরুদোয়ারা লাগানো হয়। শিখ ধর্মীয় ব্লগগুলিতে সেটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করা হয়। সেটি একটি হলুদ কাপড়ে মোড়া ইস্পাতের পোলের ওপর লাগানো হয়।
দ্বিতীয় ফ্ল্যাগ
দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, দ্বিতীয়টি হল কিষাণ মজদুর একতা-র পতাকা। সেটি প্রতিবাদী কৃষকদের একটি যৌথ সংগঠন। আমরা সেটির কোনও যাচাই-করা ফেসবুক পেজ বা টুইটার হ্যন্ডেল দেখতে পাইনি। ফলে, দ্বিতীয় পতাকাটি তাদের কিনা তা মিলিয়ে দেখা যায় নি। তবে, ২৫ জানুয়ারি, ২০২১ 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঞ্জাবের বেশ কিছু ব্যবসায়ী ওই কৃষক সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। লেখাটিতে ওই পতাকা বিক্রি করছেন এমন একজনের ছবি ব্যবহার করা হয়। লাল কেল্লায় যে দ্বিতীয় পতাকাটি লাগানো হয়, সেটির সঙ্গে বিক্রেতার পতাকাগুলির মিল আছে।
তাছাড়া, অভিনেতা থেকে কৃষক হওয়া দীপ সিধু লাল কেল্লায় উপস্থিত ছিলেন। বলা হচ্ছে, লাগানোর জন্য তিনি একটি পতাকা এগিয়ে দিয়ে ছিলেন। তিনি একটি ভিডিও পোস্ট করে বলেছেন যে, ভারতের কোনও পতাকা খুলে ফেলা হয়নি। কেবল, কিষাণ মজদুর একতা-র পতাকা ও নিশান সাহিব লাগানো হয়।
(অতিরিক্ত রিপোর্টিং: আনমোল আলফানসো)
আরও পড়ুন: ২০১১ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে বিহারের মানের শরিফের ট্যাবলোকে বলা হল টিপু সুলতান