মৌলানা আফকানি কে? এক আফগান ব্যক্তি, নাকি ভেকধারী?
মুসলিমদের পক্ষে কথা বললেও টুইটটি জনপ্রিয় হয়েছে দক্ষিণপন্থী প্রভাবশালীদের কারণে, যারা 'মৌলানা'র বক্তব্যকে বিদ্রূপ করেছেন।
মৌলানা আবদুল আফকানির (হ্যান্ডেল নাম- @maulanaUfkani) টুইটার অ্যাকাউন্টটি (imposter account) আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যেন কোনও মুসলমানের, যে আফগানিস্তানের বাসিন্দা। তার প্রোফাইলের ছবিটি (যা এখন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে) ছিল এক দাড়িওয়ালা ব্যক্তির, যার মাথায় মুসলমানি টুপি। আর টুইটারে তার পোস্টগুলি ছিল চরম গোঁড়া ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির, যা এমন ভাবে উপস্থাপিত হতো যে সেটা হাস্যকর শোনাতো, এমনকী বিদ্রূপাত্মকও হয়ে উঠত।
ওপর-ওপর মনে হবে, টুইটার অ্যাকাউন্টটি মুসলিমদের সমর্থক, অথচ সেটি দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, যারা প্রায়শ টুইটগুলি শেয়ার করত এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে টুইটে প্রকাশিত মৌলানার ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির খিল্লি ওড়াতো।
কিন্তু বুম এই অ্যাকাউন্টটির ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছে, এটি আদতে @HumorLessHarm নামের হ্যান্ডেল থেকে পোস্ট করে এবং অন্যান্য ভারতীয় দক্ষিণপন্থী ব্যক্তিদের সঙ্গে টুইট আদানপ্রদান করেl আমরা আরও লক্ষ্য করেছি যে, ২০২১ সালের মে মাসের আগে এই হ্যান্ডেল থেকে করা সব টুইটই মুছে দেওয়া হয় এবং তার পর থেকেই এটি 'মৌলানা'র নামে চালানো হতে থাকে।
অতি সম্প্রতি বেশ কয়েকজন টুইটার ব্যবহারকারী এই অ্যাকাউন্টটিকে ভুয়ো ও জালিয়াতি বলে ধরে ফেলার পর তার প্রোফাইল থেকে মুসলমানি টুপি পরা দাড়িওয়ালা ব্যক্তির ছবি সরিয়ে দেওয়া হয় এবং এটিকে 'প্যারডি' বা ব্যঙ্গাত্মক অ্যাকাউন্ট বলে চালাবার চেষ্টা হয়। তা সত্ত্বেও অনেক দক্ষিণপন্থীই টুইটারে তার পোস্ট নিয়ে তীব্রপ্রতিক্রিয়া জানাতে ভোলেনি।
কী বিষয়ে টুইট করেন এই "মৌলানা"?
১৩ ডিসেম্বর আর্কাইভ হওয়া একটি অ্যাকাউন্টে নজর বুলিয়ে আমরা দেখেছি, তাতে প্রোফাইলের ছবিতে দাড়িওয়ালা ওই মুসলমানি টুপি পরা ব্যক্তিটিকেই দেখা যাচ্ছে এবং কোথাও 'প্যারডি' কথাটিরও উল্লেখ নেই।
এ থেকে বুঝতে পারা যায় যে, প্রোফাইলের ছবিটি পরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঠিক যেমন পরিচিতির 'প্যারডি' শব্দটিও পরে জোড়া হয়েছে।
অ্যাকাউন্টটি ২০২০ সালের নভেম্বরে শুরু হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে, তবে এর প্রথম পোস্টটি টুইট হয়েছে ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। যা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক, হয় এই টুইটার ব্যবহারকারী অ্যাকাউন্ট খোলার পর থেকে দীর্ঘ ১১ মাস কোনও পোস্ট করেনি, নতুবা সেই সময়ে করা পোস্টগুলি সব মুছে দিয়েছে।
অ্যাকাউন্টটির প্রথম টুইট কী বিষয়ে?
টুইটার ব্যবহারকারী যেন আফগানিস্তানের বাসিন্দা এবং তালিবান সে দেশের দখল নেওয়ার পর স্কুলগুলি আবার খোলা নিয়ে কথা বলছেন। পোস্টে বলা হয়েছে, ছবিতে ছাত্র এবং ছাত্রীদের মধ্যিখানে যে পর্দা টাঙানো দেখা যাচ্ছে, তার উদ্দেশ্য হল মেয়েদের বেশি পরিসর দেওয়া।
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
'মৌলানা' ভাণ করেছেন, যেন তিনি পাকিস্তানি সমাজকর্মী মালালা ইউসুফজাই-এর তুতো ভাই এবং নভেম্বর মাসে আসির মালিকের সঙ্গে মালালার বিয়েতে নিজের ক্ষোভও ব্যক্ত করেছেন। তাঁর ক্ষোভের কারণ, তিনিই নাকি মালালার সবচেয়ে নিকট তুতো ভাই এবং ঐতিহ্য মেনে তাঁর সঙ্গেই মালালার বিয়ে হওয়ার কথা। মালালা সেটা না করায় তিনি ব্যথিত, বেদনাহত।
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
অন্য আর একটি সাম্প্রতিক টুইটে তিনি দক্ষিণপন্থীদের এই অভিযোগে প্রকারান্তরে সত্যতা দিয়েছেন যে, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াতের মৃত্যুতে নাকি মুসলমানরা আনন্দ প্রকাশ করেছে। টুইটার ব্যবহারকারী এই আনন্দ প্রকাশকে যেন সমর্থনই করেছেন এবং টি-২০ বিশ্ব কাপ ক্রিকেটে পাকিস্তানের কাছে সম্প্রতি ভারতীয় দলের পরাজয়ে প্রকাশিত মুসলিম উচ্ছ্বাসকেও সমর্থন করেছেন। একই সঙ্গে তাঁর টুইটগুলি তীব্র বিদ্রূপাত্মক বলেও মনে হয়।
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
অন্য একটি ব্যঙ্গাত্মক টুইটে তিনি অভিযোগ করেছেন যে, মুসলমানরা আহমেদাবাদে বিদ্যুৎ সরবরাহ কর্মীদের উপর পাথর ছুঁড়েছে এবং সেই অপকর্মটিকে এই অপযুক্তিতে সমর্থন করেছেন যে, পাথর ছুঁড়লে নাকি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
এই প্রোফাইলটিতে চোখ বোলালেই এই ধরনের টুইটের দীর্ঘ তালিকা নজরে আসবে।
এই অ্যাকাউন্টটির সঙ্গে কাদের আদানপ্রদান রয়েছে?
বিস্ময়কর ব্যাপার হল, এই অ্যাকাউন্টটির সঙ্গে যাদের আদানপ্রদান চলে, তারা অধিকাংশই ভারতীয় দক্ষিণপন্থী, যাদের কেউ-কেউ বেশ প্রভাবশালীও। এঁদের অন্যতম হলেন তারেক ফাতাহ, যিনি প্রায়শ ভুয়ো খবর শেয়ার করে থাকেন এবং @BefettingFacts, যাঁর অনুসরণকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল, ফিল্ম নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রী, বিজেপি কর্মী কপিল মিশ্র, যুব বিজেপির জাতীয় সম্পাদক তেজিন্দর বাগ্গা এবং ভোট-বিশেষজ্ঞ যশবন্ত দেশমুখ।
ফাতা যেমন ওই অ্যাকাউন্টটির একটি ব্যঙ্গাত্মক টুইট শেয়ার করেছেন, যাতে দাবি করা হয়েছে যে পাকিস্তান একটি নিরাপদ দেশ, কেননা সেখানে ওসামা বিন লাদেন এবং দাউদ ইব্রাহিমের মতো লোকেরা আশ্রয় পেয়েছেন। ফাতা মনে হয়, অ্যাকাউন্টটির এই পোস্টের ভিতরকার ব্যঙ্গটা ধরতে পারেননি এবং এর ভিত্তিতে পাকিস্তানি ইসলামি ধর্মীয় নেতাকে উপহাস করেছেন।
আমরা এমন অনেক দৃষ্টান্ত খুঁজে পেয়েছি, যেখানে এই অ্যাকাউন্টটির সঙ্গে @BefettingFacts হ্যান্ডেল ঘন-ঘন মত বিনিময় করেছে এবং নিয়মিত কথোপকথন চালিয়েছে।
মোহিত গুলাটি নামের এক প্রভাবশালী দক্ষিণপন্থীও (যিনি @desimojito নামের হ্যান্ডেল ব্যবহার করেন) ওই 'মৌলানা'র একটি টুইটের স্ক্রিনশট ব্যবহার করেছেন, যাতে তিনি নিজের আঠেরো ছুঁই-ছুঁই তুতো বোনকে বিয়ে করতে না-পারায় খেদ প্রকাশ করেছেন।
পোস্টটি ভরে রয়েছে সেই সব পোস্টে, যাতে মৌলানাকে তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল মতামতের জন্য উপহাস ও বিদ্রূপ করা হয়েছে। সেখানে এমন অনেক মন্তব্যও রয়েছে, যাতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, আদৌ এই অ্যাকাউন্টটি 'প্যারডি অ্যাকাউন্ট' কিনা।
এই তথাকথিত মৌলানার অনুসরণকারীদের তালিকাও আমরা ঘেঁটে দেখেছি, তাদের মধ্যে কোনও একজনও আফগান কিংবা পাকিস্তানি নেই, সকলেই ভারতীয় দক্ষিণপন্থী, যারা হিন্দুত্বের উগ্র সমর্থক হিসাবে পরিচিত।
মৌলানার ইতিহাস—দক্ষিণপন্থী ভারতীয়দের ট্রোলের ধারাবাহিকতার গল্প
একটি টুইটার থ্রেড-এ অল্টনিউজ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ জুবেইর তৈরি করেছেন তেজিন্দর বাগ্গা সহ দক্ষিণপন্থীদের তালিকা, যারা এই মৌলানার অ্যাকাউন্টকে জনপ্রিয় করেছেন।
এরকমই একটি টুইটে জুবেইর আভাস দিয়েছেন, এই অ্যাকাউন্টটি মৌলানার নামে চালু হওয়ার আগে @HumorLeesHarm নামে চালু ছিল।
আমরা এই অ্যাকাউন্টটির পুরনো পোস্টের হদিশ পেতে খোঁজখবর করে দেখলাম, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত @HumorLeesHarm হ্যান্ডেল থেকে বহু পোস্ট করা হয়েছে।
এই অ্যাকাউন্টটিই যে পরবর্তীতে মৌলানার অ্যাকাউন্টে রূপান্তরিত হয়েছে, সেটাও যাচাই করে দেখলাম।
প্রথমে আমরা মৌলানার অ্যাকাউন্টের ইউনিক টুইটার আই-ডি পেতে চেষ্টা করি। আইডি নম্বর—১৩৩১৬৪৫৪০৭৮৬৫১৮৪২৬৬।
এর পর আমরা @HumorLeesHarm-এর টুইটের আর্কাইভে ঢুকি। এই পদ্ধতিতে উৎস পেজটিতে প্রবেশ করে দেখলাম, @maulanaUfkani ইউনিক আই-ডি নম্বর @HumorLeesHarm--এর নম্বরের সঙ্গে হুবহু এক।
টুইটার বায়োতে এই অ্যাকাউন্টটিকে বিশিষ্ট দক্ষিণপন্থী হ্যান্ডেল @TheSquind এবং @SniperSaffronIN-এর মতো বিশিষ্ট দক্ষিণপন্থী হ্যান্ডেলের ভক্ত বলে দাবি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমোক্ত হ্যান্ডেলটি ইতিমধ্যেই টুইটার দ্বারা সাসপেন্ড হয়েছে।
অন্য একটি আর্কাইভ হওয়া পোস্টে প্রতিবাদী কৃষকদের বিক্ষোভকে খলিস্তানিদের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করা দক্ষিণপন্থী পোস্টের জবাবে ব্যবহারকারী কেবল স্মাইলি দিয়েছেন।
অন্য একটি পোস্টে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণপন্থী আইটি সেল সদস্যদের সঙ্গে রীতিমত বাদানুবাদে লিপ্ত হচ্ছেন ব্যবহারকারী।
আরও এক আর্কাইভ পোস্টে ব্যবহারকারী অন্য এক টুইটার ব্যবহারকারীকে জানাচ্ছেন, কী ভাবে দক্ষিণপন্থীদের সৌজন্যে প্রভাব অর্জন করার পর কিছু অ্যাকাউন্ট তাদেরই ঘৃণা করতে শুরু করেছে।
আমরা আরও একটি আর্কাইভ পোস্টও দেখেছি, যাতে অন্য এক টুইটার ব্যবহারকারী এই ব্যক্তির কাছে অনুযোগের সুরে "অ্যাসোসিযেশন অফ বিলিয়ন মাইন্ডস" নামে বিজেপির নির্বাচনী কৌশল নির্ণয় করার সংস্থাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছেন।
@HumourLessHarm বলছে, বিজেপির নেতারা ভালো লোক, কিন্তু তার আই-টি সেল-এর লোকেরা মনে করে, নেতাদের নামেই নির্বাচনটা জিতে নেওয়া যাবে।
এই টুইটটি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে বিজেপির বিরাট পরাজয়ের ঠিক পরেই পোস্ট হওয়ায় মনে করা হচ্ছে, হয়তো বিজেপির আই-টি সেল-এর সঙ্গে যুক্ত কোনও ব্যক্তিই এই টুইটটি করেছেন।
@HumorLessHarm-এর পুরনো এবং পরে মুছে দেওয়া টুইটগুলির একটিতেও এমন কোনও ইঙ্গিত নেই যে ব্যবহারকারী আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের লোক বা মুসলমান।
তাহলে দেখা যাচ্ছে,
১) এই অ্যাকাউন্টটি আদতে @HumorLessHarm নামেই পরিচিত ছিল
২) নিজের অ্যাকাউন্টকে দক্ষিণপন্থী আই-টি সেল-এর অনুসরণকারী বলে বর্ণনা করতো
৩) দক্ষিণপন্থী বিষয়বস্তুই প্রচার করত এবং দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গেই মত ও ভাববিনিময় করত
৪) ২০২১ সালের মে মাসের পর সব পুরনো পোস্ট মুছে দেয়
৫) প্রোফাইল-নাম পাল্টে @maulanaUfkani রাখে এবং মুসলমানি টুপি পরা এক দাড়িওয়ালার ছবি যোগ করে
৬) ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আফগানিস্তানের এক ধর্মীয় ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করে
৭) ডিসেম্বর মাসেই সে তথ্য-যাচাইকারী এবং টুইটার-ব্যবহারকারীদের কাছে ধরা পড়ে যায়
৮) তার পর থেকেই দাড়িওয়ালা, টুপি পরা লোকটির ছবি উধাও হয়ে যায় এবং টুইটার বায়ো-তে নিজেকে প্যারডি অ্যাকাউন্ট বলে দাবি করে
আরও পড়ুন: অপহরণের নাট্যরূপের ভিডিও সাম্প্রদায়িক দাবি সহ ভাইরাল