অপহরণের নাট্যরূপের ভিডিও সাম্প্রদায়িক দাবি সহ ভাইরাল
বুম দেখে চিত্রনাট্য আধারিত দৃশ্যটি এক সোশাল মিডিয়া কনটেন্ট নির্মাতার, যিনি মজার ছলে ভিডিওটি তৈরি করেন।
দুই ব্যক্তি আটকে দিলেন একটি অপহরণের চেষ্টা, এমন একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় (Social Media) ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটি আসলে নাটকের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। ভিডিওটি মিথ্যে এবং সাম্প্রদায়িক দাবির সঙ্গে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটিতে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে যে, এক মুসলিম (Muslim) মহিলা পার্ক থেকে বাচ্চাদের অপহরণ করছে।
বুম যাচাই করে দেখে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি আসলে একটি নাটক। এটির নির্মাতারা নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে ট্র্যাফিক বাড়ানোর জন্য এই ভিডিওটি তৈরি করেছিলেন।
বুম এর আগেও এ রকম বেশ কিছু নাট্যরূপায়িত ভিডিওর তথ্য যাচাই করেছে যেগুলি অপ্রাসঙ্গিক সাম্প্রদায়িক রঙ চড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হয়েছে। অবশ্য নির্মাতারা এই ভিডিওগুলি আপলোড করার সময় সঙ্গে ডিসক্লেমার দিয়ে দিচ্ছেন, যাতে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, ভিডিওগুলি "শিক্ষার উদ্দেশ্যে" তৈরি। কিন্তু পরে এই ভিডিওগুলি থেকে কিছুটা অংশ কেটে নিয়ে শেয়ার করা হচ্ছে, এবং সেই অপপ্রচারের নিশানা হচ্ছেন প্রধানতঃ মুসলমানরা।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, এক মহিলা নির্জন রাস্তায় একটি ছেলের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে এবং দু'জন লোক গাড়িতে খুব কাছ থেকে তাদের অনুসরণ করছেন। কিছু ক্ষণ পরে লোকদু'টি গাড়ি থেকে নেমে আসেন, এবং মহিলাকে সরাসরি প্রশ্ন করেন যে ছেলেটি কে। মহিলা জানায় যে, এটি তার ছেলে, এবং এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে; কিন্তু ওই দু'জনের মধ্যে এক জন ছেলেটিকে মহিলার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেন। এর পর তাঁরা ওই মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন।
এই সময় ছেলেটিও জানায় যে, ওই মহিলা তার মা নয়। সে আরও জানায় যে, অন্য কিছু মহিলা একটু আগে এই রাস্তা দিয়েই তার বোনকেও নিয়ে গেছে। লোক দু'জন তাদেরও থামান। দু'জনের এক জন মহিলাকে থাপ্পড় মারেন, এবং সত্যি কথা বলতে বলেন। এর পর ওই মহিলা স্বীকার করে নেয় যে, সে বাচ্চাদের অপহরণ করে, আর পরে তাদের ভিক্ষা করতে বাধ্য করে।
একটি ফেসবুক পোস্টে ভিডিওটি শেয়ার করা হয়, সঙ্গে হিন্দিতে ক্যাপশন দেওয়া হয় যার অনুবাদ, "দেখুন, কী ভাবে এই জেহাদি মহিলা পার্ক থেকে একটি বাচ্চাকে অপহরণ করছে। দয়া করে নিজেদের বাচ্চাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন এবং তাদের একা একা পার্কে খেলতে দেবেন না। দেখুন কী ভাবে এই জেহাদি মুসলমান মহিলা একটি বাচ্চাকে অপহরণ করছে।"
( হিন্দি: सभी मित्र बंधुओं से निवेदन है इस वीडियो को ज्यादा से ज्यादा शेयर करें देखिए यह जिहादी औरत कैसे पार्क में से बच्चे को चुरा कर भीख मंगवाने के लिए ले जाती है जितने भी माता-पिता हैं अपने बाल बच्चे को ज्यादा ख्याल रखें ज्यादा ध्यान दें कभी पार्क में अकेले खेलने मत जाने दे नहीं तो देखें यह एक औरत चार पांच बच्चे को कैसे चुरा कर ले कर जा रही थी और कहती है हाथ पैर तोड़ कर भीख मंगवाते हैं इन सब बच्चों से सभी सावधान हो जाएं यह जिहादी मुस्लिम औरत देखिए कैसे करके बच्चे को लेकर जा रही थी)
ভিডিওটি একই সাম্প্রদায়িক দাবি সমেত অন্যান্য ফেসবুক পেজ থেকেও শেয়ার করা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক রঙ ছাড়াও অন্য বিভ্রান্তিকর দাবি নিয়ে ভিডিওটি শেয়ার করা হয়েছে।
একটি ফেসবুক পোস্টে ভিডিওটির সঙ্গে যে হিন্দি ক্যাপশন দেওয়া হয়েছে, তার অনুবাদ, "দেখুন কী ভাবে এই মহিলা পার্ক থেকে বাচ্চাদের অপহরণ করছে। ওই মহিলাকে ধরার জন্য এই ভাইদের ধন্যবাদ।"
(হিন্দি: इस वीडियो को ज्यादा से ज्यादा शेयर करें देखिए यह औरत बच्चों को किडनैप करती है यह तो शुक्र है इन भाइयों का जिन्होंने इस को पकड़ा है पूरी वीडियो देखें कैसा सच सामने आया है)
এই পোস্টগুলি দেখতে এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে ক্লিক করুন।
আরও পড়ুন: প্রেমিকার জন্য উপহার 'দাঁত বাঁধানো নেকলেস'? ভুয়ো দাবিতে ছড়াল কৌতুক
তথ্য যাচাই
বুম ভিডিওটি খুব ভালো করে লক্ষ করে, এবং দেখতে পায় যে, ভিডিওটির ৭ সেকেন্ডের মাথায় একটি ডিসক্লেমার দেওয়া হয়েছে। ওই ডিসক্লেমারে লেখা হয়েছে, "এই ভিডিওতে যা দেখানো হয়েছে তা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই ভিডিওতে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা পরামর্শ হিসাবে গ্রহণ করা বা তা থেকে ক্রেডিট অ্যানালিসিস করার জন্য নয়। এই ভিডিও দেখে কেউ যদি অনুপ্রাণিত হন, তবে তিনি তা সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে করবেন। তার ফলে কোনও ক্ষতি হলে আমরা তার জন্য দায়ী থাকব না। আমরা প্রত্যেক ব্যক্তি, পেশা এবং সংস্থাকে শ্রদ্ধা করি। এখানে আমরা যে সব ভূমিকায় অভিনয় দেখিয়েছি, তা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য এবং কোনও ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের আবেগে আমরা আঘাত করতে চাই না। বাজারে বিনিয়োগ করলে সেখানে সব সময় ঝুঁকি রয়েছে: বিনিয়োগ করার আগে তথ্য যাচাই করে নেওয়া দর্শকের দায়িত্ব।"
এই ডিসক্লেমারটি পড়লেই বোঝা যায় যে, ভিডিওটি আসলে বিনোদনের উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে। কারা এই ভিডিওটি বানিয়েছে, আমরা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। এর আগেও আমরা এই ধরনের ভিডিওর তথ্য যাচাই করেছি। ভিডিওতে ব্যবহার করা হয়েছে, এ রকম কিছু কিওয়ার্ড দিয়ে আমরা ফেসবুকে সার্চ করি।
'বাচ্চা অপহরণের প্র্যাঙ্ক ভিডিও' দিয়ে আমরা ফেসবুকে কিওয়ার্ড সার্চ করি এবং দেখতে পাই যে, ১২ ডিসেম্বর ভিডিওটি একটি ফেসবুক পেজে আপলোড করা হয়েছিল। সঙ্গে ক্যাপশন দেওয়া হয়েছিল, 'বাচ্চা অপহরণের প্র্যাঙ্ক ভিডিও'। দুটি ভিডিওতেই একই চরিত্রদের দেখা গেছে।
আরও কিছু কিওয়ার্ড দিয়ে আমরা ফেসবুকে সার্চ করে এই ভিডিওটিরই আর একটি ভার্সন দেখতে পাই। ওই ভিডিওটি 'ম্যাডি কি দুনিয়া' নামের একটি ফেসবুক পেজে আপলোড করা হয়েছিল। সঙ্গে ক্যাপশন দেওয়া হয়, "বাচ্চার সঙ্গে এ রকম যেন কখনও না হয়'। ভিডিওটি ৯ ডিসেম্বর আপলোড করা হয়েছিল, এবং ৪ মিলিয়ন ভিউস পেয়েছিল।
ফেসবুক পেজের অ্যাবাউট সেকশনে এটিকে 'প্র্যাঙ্কস অ্যান্ড এক্সপোজ' পেজ বলা হয়েছে। ফেসবুক পেজে officialmady01 নামে একটি ইনস্টাগ্রাম আইডি দেওয়া হয়েছে। ইনস্টাগ্রাম পেজটি কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এবং ইউটিউবার হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা এই অ্যাকাউন্টে অবশ্য ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি দেখতে পাইনি। এই ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে একটি ইউটিউব পেজের লিঙ্ক দেওয়া হয়েছে।
ইউটিউব পেজ ম্যাডি কে প্র্যাঙ্ক ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই একই ভিডিও আপলোড করে, এবং ভিডিওটির নাম দেয় 'তোমাকে দেওয়া উপহার'। হোম পেজে আর যে সমস্ত প্র্যাঙ্ক ভিডিও রয়েছে, সবগুলিরই একই নাম দেওয়া হয়েছে— 'তোমাকে দেওয়া উপহার'।
বুম ম্যাডি কি দুনিয়া পেজের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। তাদের কাছ থেকে উত্তর পেলেই এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে তা জানিয়ে দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে বাঘ হামলার ঘটনা বলে ছড়াল সম্পর্কহীন পুরনো ভিডিও