ইউটিউব তারকা বিবেক বিন্দ্রার মিথ্যে দাবি তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকিট
বুম যাচাই করে দেখে ভারত সরকার বিবেক বিন্দ্রার ছবি ও নামে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে তাঁর এই দাবি সত্যি নয়।
জনপ্রিয় হিন্দি ইউটিউব ব্যক্তিত্ব (YouTuber) বিবেক বিন্দ্রা (Vivek Bindra) সম্প্রতি দাবি করেছেন, ভারত সরকার তাঁর ছবি ও নামে ডাক টিকিট (Postal Stamp) প্রকাশ করেছে।
বুম যাচাই করে দেখে এই দাবি বিভ্রান্তিকর (misleading)। কারণ, সরকারি ভাবে সে রকম ডাক টিকিট প্রকাশ করেনি ভারত সরকার (Indian Government)।
ইউটিউবার ড. বিবেক বিন্দ্রা অনুপ্রেরণামূলক ভাষণ দেন। তাছাড়া তিনি ব্যবসা চালানোর কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন। তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে দু’কোটি গ্রাহক রয়েছে। কোচিং সেন্টার ‘বড়া বিজনেস’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এমএক্স প্লেয়ারে ‘বিজনেসবাজি’ নামে তাঁর একটি অনুষ্ঠানও সম্প্রচার করা হয়।
সম্প্রতি বিন্দ্রা তাঁর ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্টে কয়েকটি ছবি শেয়ার করেন। সেগুলিতে তাঁর নাম ও ছবি রয়েছে এমন ডাক টিকিট সমেত পোজ দিয়েছেন তিনি। উনি দাবি করেন, ওই ডাক টিকিট ভারত সরকার প্রকাশ করেছে।
১১ জানুয়ারি, ২০২৩-এ শেয়ার করা একটি পোস্টে উনি লেখেন, “চিঠিতে ডাক টিকিট লাগানোর সময় আপনি যদি দেখেন সেই ডাক টিকিটে আপনার ছবি ও নাম রয়েছে, তা হলে কেমন লাগবে আপনার? আমি যখন দেখি, ভারত সরকার আমার ছবি ও নাম সহ একটি ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে, তখন আমার খুব ভাল লাগে। সেটা ছিল গর্ব করার মতো একটি মুহূর্ত। আমাকে এই সম্মান জানানোর জন্য আমি ভারত সরকার/ডাক বিভাগকে আমার উষ্ণ অভিনন্দন জানাই।”
(হিন্দিতে লেখা মূল ক্যাপশন: "कैसा लगेगा जब आप लेटर पर पोस्टल स्टांप लगाने जा रहे हों और उस स्टांप पर आपकी ही तस्वीर हो। ऐसी ही खुशी मुझे हुई जब मैंने देखा कि भारत सरकार ने मेरे नाम और फोटो का स्टांप जारी किया है। यह एक गर्व करने वाला पल था। इस सम्मान के लिए मैं भारत सरकार/डाक विभाग को दिल से धन्यवाद करता हूं.")
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে। ফেসবুকেও তিনি পোস্ট করেন একই ছবি।
বড়া বিজনেস-এর নিজস্ব যাচাই করা ফেসবুক পেজ থেকেও দাবিটি প্রচার করা হয়।
অন্য একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী ছবিগুলি শেয়ার করেন। ক্যাপশনে উনি লেখেন, “বিবেক বিন্দ্রাজির ছবি ও নাম সহ ভারত সরকার ডাক টিকিট বার করেছে। এবার ভেবে দেখুন, আপনি যদি এই রকম একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির ব্যবসায়িক পার্টনার হন, তাহলে আপনার সাফল্য কে রুখবে।”
(হিন্দিতে লেখা মূল ক্যাপশন: "भारत सरकार ने जारी किया विवेक बिंद्रा जी के नाम और फोटो का #पोस्टल #स्टांप. अब आप खुद विचार करें ऐसे विशेष व्यक्ति के साथ यदि आप बिजनेस पार्टनर बनते है तो आपकी उपलब्धि को कोई नहीं रोक सकता.")
পোস্টটি দেখুন এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম যাচাই করে দেখে বিবেক বিন্দ্রার দাবি মিথ্যে।
আসলে, ‘মাই স্ট্যাম্প’ (আমার ডাক টিকিট) নামে ডাক বিভাগের একটি স্কিম আছে। সেই স্কিম অনুযায়ী, যে কোনও ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থা, যে কোনও ছবি, হেরিটেজ বাড়ি, বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র, ঐতিহাসিক স্থান, বন্য প্রাণী ও অন্যান্য পশুপাখির ছবি ও নিজের নাম দিয়ে টিকিট ছাপাতে পারেন।
বিবেক বিন্দ্রা তাঁর পোস্টে যা দাবি করেছেন, তার সত্যতা যাচাই করার জন্য আমরা এই সংক্রান্ত মিডিয়া রিপোর্টগুলি দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু ভারত সরকার ওই ডাক টিকিটটি প্রকাশ করেছে, সে রকম কোনও খবর আমরা দেখতে পাই না।
আমরা ইকনমিক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখি। তাতে ডাক বিভাগের তরফ থেকে বলা হয়েছে, যে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা ১২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে তাঁদের ছবি বা লোগো দিয়ে ডাক টিকিট ছাপাতে পারেন।
ডাক বিভাগের সচিব এস কে সিনহার বক্তব্য ছিল ওই রিপোর্টে। তিনি বলেন, “নিজের মতো করে ছাপানোর জন্য, আমরা যে কোনও ব্যক্তি ও সংস্থার জন্য "মাই স্ট্যাম্প" স্কিমটি চালু করেছি। যে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা ১২ লক্ষ টাকা দিয়ে নিজেদের ছবি অথবা লোগো দিয়ে ডাক টিকিট ছাপাতে পারেন। তার জন্য তাঁরা ৫০০০ শিটে ৬০,০০০ ডাক টিকিট পেতে পারেন।”
২০১৭ সালের জুলাই মাসে দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে পশ্চিম সার্কেল, তামিল নাডুর পোস্টমাস্টার জেনারেল সারদা সম্পত-এর বক্তব্য ছাপা হয়। তিনি বলেন, “ইন্ডিয়া পোস্ট দ্বারা প্রকাশিত স্মারক ডাক টিকিট কেবল বিখ্যাত ও পরলোকগত ব্যক্তিদের ওপর ছাপা হয়। তার জন্য অনেকগুলি সরকারি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া আবশ্যিক। কিন্তু ইন্ডিয়া পোস্ট-এর "মাই স্ট্যাম্প" পরিষেবায়, যে কেউ সহজেই টিকিট ছাপতে পারেন। ডাক টিকিটে নিজেদের ছবি দেখার সাধারণের আকাঙ্খা এই স্কিমের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়।”
ডাক বিভাগের ওয়েবসাইটের "মাই স্ট্যাম্প" সেকশন থেকে এই উদ্যোগ সম্পর্কে আমরা আরও জানার চেষ্টা করি। সেখানে বলা আছে, "মাই স্ট্যাম্প" ইন্ডিয়া পোস্টের একটি বিশেষ ব্যবস্থা। তার মাধ্যমে নিজের পছন্দ মতো ডাক টিকিট ছাপানো যায়। এই পরিষেবার মাধ্যমে, ব্যক্তির ছবি, সংগঠনের লোগো, আর্টওয়ার্ক, হেরিটেজ বাড়ি, বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র, ঐতিহাসিক স্থান, বন্য প্রাণী ও অন্যান্য পশুপাখির ছবি দিয়ে ডাক টিকিট বার করা যায়।
তাতে আরও বলা হয়েছে যে, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা কোনও সংস্থা, তাদের পছন্দ মতো ডাক টিকিটের নমুনা প্রস্তুত করে ডাক বিভাগের মাধ্যমে তা ছাপিয়ে নিতে পারে। তারা তাদের পছন্দের থিম ছাড়াও নিজেদের লোগো দিয়েও ডাক টিকিট তৈরি করতে পারে।
"মাই স্ট্যাম্প"-এর একটি শিটে ৫ টাকা মূল্যের ১২টি স্ট্যাম্প থাকে। একটি শিটের খরচ ৩০০ টাকা।
- ওই ওয়েবসাইট অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি যদি মাই স্ট্যাম্প-এ নিজের নাম ও ছবি ছাপাতে চান, তাহলে তাঁদের স্ট্যাম্প অর্ডার ফর্ম ভরতে হবে। দেখাতে হবে ছবি সমেত পরিচয় পত্রও। তার পর জমা দিতে হবে টাকা।
- তাঁরা তাঁদের ছবি তুলিয়ে নিতে পারেন। অথবা তোলা ছবি/তার ডিজিটাল সংস্করণও জমা করতে পারেন। এমনকি মাই স্ট্যাম্প-এর ক্রেতারা তাঁদের পরিবার, বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের ছবিও জমা দিতে পারেন।
- মাই স্ট্যাম্প-এর জন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আবেদনও নেওয়া হয়। তার জন্য অর্ডার ফর্ম সহ একজন অনুমোদিত ব্যক্তির সই সমেত আবেদন পত্র জমা দিতে হয়। কম্পানি/সংস্থার দেওয়া পরিচয় পত্রও সাক্ষরকারীকে জমা করতে হয়। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ন্যুনতম ১০০ শিট ছাপানো বাধ্যতামূলক।
আমরা এও দেখি যে, ডাক বিভাগ বিন্দ্রার টুইটটি উদ্ধৃত করে লেখে, “দেশের প্রতিটি নাগরিককে পরিষেবা দিতে ডাক বিভাগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা খুশি যে আমাদের ‘মাই স্ট্যাম্প’ পরিষেবা আপনার ভাল লেগেছে। আমাদের প্রশংসা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।”
ইন্ডিয়া পোস্ট স্পষ্ট করেই ‘মাই স্ট্যাম্প’ পরিষেবার উল্লেখ করে। তারা কোথাও বলেনি যে, বিবেক বিন্দ্রার ছবি ও নাম সহ ডাক টিকিট বার করেছে ভারত সরকার।
আরও জানতে আমরা ইন্ডিয়া পোস্ট-এর দিল্লি অঞ্চলের সেকশন অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। উনি বলেন, ‘মাই স্ট্যাম্প’ পরিষেবায়, যে কোনও ব্যক্তি নিজের ছবি ও নাম সহ ডাক টিকিট ছাপাতে পারেন।
ওই সেকশন অফিসার বুমকে বলেন, “একটি নির্দিষ্ট কাঠামো আছে। তাতে দু’টো স্ট্যাম্প থাকে। একটি ফাঁকা থাকে। তাতে আপনার বা অন্য কোনও ব্যক্তির ছবি বসানো হয়। অন্যটিতে থাকে গোলাপ, লালকেল্লা, রাশিচক্র ইত্যাদি। নিজের ইচ্ছে মতো ছবি নির্বাচন করতে পারেন। যে কোনও ভারতীয় নাগরিক, প্রতি শিটের জন্য ৩০০ টাকা দিয়ে ডাক টিকিট ছাপিয়ে নিতে পরেন এবং ডাক পাঠানোর কাজে তা ব্যবহার করেত পারেন।”
বুম বিন্দ্রার বক্তব্য জানার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু বার বার ফোন করা সত্ত্বেও তা সম্ভব হয়নি। আমরা বিন্দ্রার কাছে ইমেলও পাঠিয়েছি। কিন্তু এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত তিনি কোনও জবাব দেননি।