ভুয়ো দাবি: মুসলমান শিশুদের হাসপাতালে জন্মের হার অন্য ধর্মের চেয়ে বেশি
পোস্টে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে দিল্লি, কেরল সহ সারা দেশে সরকারি হাসপাতালে মুসলিম শিশুর জন্মের হার অন্য ধর্মের তুলনায় বেশি।
![ভুয়ো দাবি: মুসলমান শিশুদের হাসপাতালে জন্মের হার অন্য ধর্মের চেয়ে বেশি ভুয়ো দাবি: মুসলমান শিশুদের হাসপাতালে জন্মের হার অন্য ধর্মের চেয়ে বেশি](https://bangla.boomlive.in/h-upload/2022/07/03/980669-population-control-act-01.webp)
সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া পোস্টে দাবি করা হয়েছে সারা ভারতের সরকারি (Govt. Hospital) হাসপাতালগুলিতে দৈনিক ৫৮,১৬৭ জন মুসলিম (Muslims) শিশুর (baby) জন্ম হয়, যা কিনা অন্যান্য সম্প্রদায়ের (others religion) শিশু জন্ম হারের (population rate) চেয়ে অনেক বেশি। এই দাবিটি মিথ্যে।
দাবি করা হয়েছে যে, ভারতের সরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রতিদিন ৫৮,১৬৭টি মুসলমান শিশুর জন্ম হয়। এই সংখ্যাটি হিন্দু (৩,৩৩৭), খ্রিস্টান (১,২২২) ও শিখ (১,১১৭) নবজাতকের সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। দাবিটিতে আরও বলা হয়েছে যে, দিল্লির সরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রতিদিন ১৬৭ মুসলমান শিশু জন্মায়। সেই তুলনায় হিন্দু শিশু জন্মায় ৩৭, খ্রিস্টান ১২ ও শিখ ১৭। ফলে তাদের তুলনায় মুসলমানদের জন্মহার অনেক বেশি।
এই দাবিটি মিথ্যে। কারণ, সারা দেশে জন্ম ও মৃত্যু নথিভুক্ত করার জন্য কেন্দ্রীয় গৃহ মন্ত্রকের যে সিভিল রেজিস্ট্রেশন সিসটেম (সিআরএস) বা অসামরিক নথিকরণ ব্যবস্থা চালু আছে, তা থেকে ধর্ম ভিত্তিক কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। দিল্লি সরকার ওই ধরনের তথ্য রাখে এবং ধর্মীয় ভিত্তিতেও তথ্য নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু সেই তথ্য দেখিয়ে দেয় যে, হিন্দু শিশুর জন্ম হার মুসলমান শিশুর জন্ম হারের চেয়ে বেশি।
একই দাবি সহ বার্তাটি ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। একটি ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে।
![](https://bangla.boomlive.in/h-upload/2022/07/03/980671-pupulation-control-bill-muslims.webp)
আগে, দিল্লি ও কেরল রাজ্যের পরিসংখ্যান বলে চালানো হয়েছিল একই ভাইরাল বার্তা।
আরও পড়ুন: 'প্রধানমন্ত্রী ঋণ যোজনা' নামে প্রচারিত অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ভুয়ো
তথ্য যাচাই
সর্বসাধারণের জন্য কেন্দ্রীয় ও দিল্লি সরকারের প্রকাশিত তথ্য দেখিয়ে দেয় যে, ভাইরাল দাবিটিতে যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে, সেগুলি মিথ্যে।
১। কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রকের সিআরএস
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল, সাম্প্রতিকতম সিআরএসটি প্রকাশ করে জুন ২০২১-এ। সেটিতে ২০১৯-এর পরিসংখ্যান দেওয়া হয়।
তাতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-এ, ২,৪৮,২০,৮৮৬ (২.৪৮ কোটি) শিশুর জন্ম হয় ভারতে।
ওই তথ্যকে ভাগ করা হয় এই ভাবে:
১। লিঙ্গ: ৫২.১% ছেলে, ৪৭.৯% মেয়ে
২। চিকিৎসা ব্যবস্থার সাহায্য: ৮১.২% শিশুর জন্ম হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, ৪.৫% প্রশিক্ষণহীন দাইদের হাতে, ৮.৪% জন্মায় ডাক্তার, নার্স বা দাই'র হাতে, ৩.৩% জন্মায় "অন্যান্যদের" হাতে, ২.৭% শিশুর জন্মের বিবরণ পাওয়া যায় না
৩। নথিকরণ: ২০১৯-এ, আনুমানিক জন্মের ৯২.৭% নথিভুক্ত করা হয়
৪। জেলা স্তরে, শিশুর জন্ম ও মৃত শিশু প্রসব, লিঙ্গ অনুযায়ী নথিভুক্ত করা হয়
৫। জন্ম নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধান (দিনের হিসেবে)
৬।জন্মকালে ছেলে-মেয়ের অনুপাত
৭। শহর ও গ্রাম: ৫৪.২% শিশু জন্মায় শহরে; গ্রামাঞ্চলে ৪৫.৮%
এই তালিকায়, ভারতব্যাপী জন্ম সংখ্যার কোনও ধর্মভিত্তিক ভাগ নেই।
ওই তথ্য দেখা যাবে এখানে।
২. দিল্লি সরকার
দিল্লি সরকারের ডাইরেক্টরেট অফ ইকনমিক্স ও স্ট্যাটিস্টিক্স বা অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান দপ্তর ও জন্ম-মৃত্যুর চিফ রেজিস্ট্রার-এর অফিস, রাজ্য স্তরে ওই তথ্য নথিবদ্ধ করে। অক্টোবর ২০২১-এ তারা ২০২০'র তথ্য প্রকাশ করে।
দিল্লির ২০২০'র সিআরএস থেকে জানা যায়, সে বছর ওই রাজ্যে ৩,০১,৬৪৫ শিশু জন্মায়। গড় হিসেবে, দিনে ৮২৪টি শিশুর জন্ম হয় সেখানে।
তার মধ্যে ২,৪৯,২৬২ (প্রায় ৮২.৬%) হিন্দু শিশু জন্মায়, মুসলমান শিশু জন্মায় ৪৬,৫১৩ (১৫.৪%), শিখ শিশু ১,২৬২, ৩,০৪৮ খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মের শিশু জন্মায় ১,৫৬০।
ওই তালিকায়, দিল্লিতে প্রাতিষ্ঠানিক ও লিঙ্গ ভিত্তিক জন্মেরও হিসেব পাওয়া যায়। সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি হাসপাতাল, ও কোনও প্রতিষ্ঠানের বাইরে কতগুলি শিশুর জন্ম হয়, সেই হিসেবও পাওয়া যায় ওই তালিকায়। সরকারি হাসপাতালে জন্ম হয় ১,৭৭,১৬২ শিশুর, বা গড়ে প্রতিদিন ৪৮৪। কিন্তু তাতে ধর্ম ভিত্তিক কোনও ভাগ করা হয়নি।
দিল্লি সরকার সদ্যজাতকদের লিঙ্গ, শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে জন্মের ব্যবধান, নথিভুক্তির সময় ও সেক্স রেশিও অথবা জন্মকালীন লিঙ্গ অনুপাতের তথ্যও দেয় তাদের তালিকায়। সেই সঙ্গে প্রসবের সময় মায়ের বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও জীবিকারও উল্লেখ থাকে। বাবার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও জীবিকার কথাও লেখা হয় তাতে। মৃত শিশুর জন্ম ও সদ্যজাতের ওজনও নথিভুক্ত করা হয়।
জন্মের সামগ্রিক হিসেবে ধর্ম ভিত্তিক ভাগ ছাড়া, আর যে ক্ষেত্রে ধর্ম ভিত্তিক ভাগ রয়েছে তা হল, প্রসবের সময় মায়ের বয়স, বাচ্চাদের জন্মের ক্রম ও জন্মের স্থান, অর্থাৎ, শহর না গ্রামাঞ্চল। যেমন, শহরাঞ্চলে ২,২৫,৬৮২ শিশুর জন্ম হয় হিন্দু পরিবারে। তথ্য কী ভাবে সাজানো হয়েছে তা নীচের তালিকায় দেখা যাবে।
![](https://bangla.boomlive.in/h-upload/2022/07/03/980670-966919-tempsnip.webp)
প্রতিষ্ঠানে জন্মের ক্ষেত্রে, কোনও ধর্ম ভিত্তিক ভাগ করা হয়নি। অথচ তেমনটাই বলা হয়েছে দাবিটিতে।
সেই তথ্য দেখা যাবে এখানে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইনের পক্ষে সওয়াল
প্রায়ই এই ধরনের দাবি করা হয়ে থাকে। কারণ, মনে করা হয় যে, ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা এক দিন হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে। এও বলা হয়, এই দেশে একটি মাত্র ধর্ম কায়েম করার জন্য এটি হল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
ওই ষড়যন্ত্র বানচাল করার অজুহাতে, এই মতের সমর্থকরা সরকারকে থেকে থেকেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করার কথা বলে। কিন্তু সরকারের ঘোষিত অবস্থান হল, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন আনা বা দুই-সন্তান নীতি চালু করার কোনও পরিকল্পনা তাদের নেই। গত বছর জুলাই মাসে, এক লিখিত জবাবে, সরকার সংসদে জানায় যে, জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হয় না। তাতে আরও বলা হয়, কোনও রকম বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা আরোপ না করেও পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও তামিলনাড়ুর মতো রাজ্য নিজেদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে।
গত বছর মার্চে, সরকার সংসদকে আরও জানায় যে, ভারতের ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলের মধ্যে ২৮টি তাদের উর্বরতা হার ২.১-এ নামিয়ে এনেছে, যা প্রতিস্থাপন হারের চেয়ে কম। প্রতিস্থাপন হার হল সেই হার যার মাধ্যমে এক প্রজন্মের জনসংখ্যা পূরণ হয়ে যায় পরের প্রজন্মের দ্বারা।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয় যে, ভারতের জনসংখ্যায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আনুপাতিক হার ১৯৫১ থেকে প্রায় একই থেকেছে। সেপ্টেম্বর ২০২১তে প্রকাশিত পিউ'র গবেষণায় দেখানো হয় যে, মুসলমানদের মধ্যেই উর্বতার হার সবচেয়ে বেশি (২.৬)। সেই তুলনায় হিন্দুদের মধ্যে উর্বতার হার হল ২.১। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে উর্বরতার হার হ্রাস পেয়েছে উল্লেখ যোগ্য ভাবে। ১৯৯০-এর দশকে তা ছিল ৪.১।
ভারতের সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই উর্বরতার হার কমছে। এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সেই হার একই হওয়ার দিকে এগোচ্ছে।
আরও পড়ুন: তিস্তা শেতলবাদের প্রপিতামহ কি জেনারেল ডায়ারকে 'ক্লিন চিট' দিয়েছিলেন?
https://bangla.boomlive.in/fact-check/teesta-setalvad-chimanlal-setalvad-hunter-commission-jallianwala-bagh-massacre-clean-chit-gujarat-riots-2002-modi-18390