টাইমস নাউ ওয়েলসের ভিডিও দেখিয়ে দাবি করল পঞ্জশিরে পাকিস্তানি বিমান হানা
বুম দেখে ভিডিওটি ব্রিটেনের ওয়েলসের অঞ্চলের আকাশে একটি ফাইটার বিমানের প্রশিক্ষণ নেওয়ার দৃশ্য।
পার্বত্য অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (USA) বিমান বাহিনীর একটি ফাইটার বিমানকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার এক ভিডিও টাইমস নাউ (Times Now) চ্যানেল সম্প্রচার করে দাবি করে আফগানিস্তানের পঞ্জশির উপত্যকায় (Panjshir) তালিবান-বিরোধী প্রতিরোধ চূর্ণ করতে পাকিস্তানি বিমানের হামলার ছবি।
বুম দেখেছে, ভিডিওটি মার্কিন বিমান বহরের একটি এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ছবি। ব্রিটেনের ল্যাকেনহিথ বিমানঘাঁটি (যেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ব্যবহার করে)থেকে উড়ে ওয়েল্স-এর ম্যাচ-লুপ অঞ্চলের পার্বত্য উপত্যকায় বিমানটি যুদ্ধের মহড়া চালাচ্ছিল। ছোট-ছোট পাহাড়ে আকীর্ণ এই উপত্যকা নিচু দিয়ে দ্রুতগামী যুদ্ধবিমান চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণের পক্ষে আদর্শ।
চ্যানেলের দেখানো দৃশ্যে পর্বতসংকুল এলাকায় একটি ফাইটার জেট-কে উড়তে দেখানো হচ্ছে, আর দাবি করা হচ্ছে যে, এটি তালিবানের বিরুদ্ধে পঞ্জশির উপত্যকায় গড়ে ওঠা প্রতিরোধ দমন করতে পাকিস্তানি বিমানের হানাদারি।
১৫ অগস্ট কাবুলের পতন হওয়ার পর বেশ কিছু তালিবান-বিরোধী শক্তি এবং আফগান সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট অংশ আহমদ মাসুদের নেতৃত্বে পঞ্জশির উপত্যকায় জড়ো হয়ে প্রতিরোধের লড়াই চালাচ্ছে। অধিকাংশ ভারতীয় সংবাদ-মাধ্যম এখন পঞ্জশির উপত্যকায় তালিবানের অধিকার কায়েম হওয়ার কথা জানাচ্ছে, তবে এইখানেই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় তালিবানকে বিদ্রোহীরা ঠেকিয়ে রেখেছিল।
টাইমস নাউ ভিডিওটি দেখানোর সময় সন্ত্রাসবাদের পাকিস্তানি মদতের 'ব্রেকিং নিউজ' অর্থাত্ এক্ষুণি পাওয়া খবর হিসাবে পেশ করে এবং তার ভাষ্যকার দাবি করেন, "সর্বশেষ পাওয়া এই দৃশ্যে পঞ্জশির উপত্যকার আকাশে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানকে উড়তে দেখা যাচ্ছে। আপনারা টেলিভিশনের পর্দায় সেই জেট বিমানের ছবি দেখতে পাচ্ছেন, যেগুলি পাকিস্তান পাঠিয়েছে তালিবানকে সাহায্য করতে এবং তার বিরোধীদের প্রতিরোধ চূর্ণ করতে।"
নিচে দেখুন ভিডিওটি।
সংবাদপাঠিক এরপর সংবাদদাতা প্রদীপ দত্তের কাছে আসেন, যিনি বলতে থাকেন— "এটা পঞ্জশির উপত্যকায় পাকিস্তানের সার্বিক আগ্রাসনের চি্ত্র।না, এখানে তালিবান লড়াই করছে না, তাদের হয়ে উপত্যকায় হামলা চালাচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনী। "তাঁর আরও বক্তব্য—'এটাই প্রমাণ করে যে পাকিস্তান সরাসরি মিথ্যা কথা বলছে এবং তালিবানের লড়াইটা তারাই লড়ছে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ ধ্বংস করতে'।
ভিডিওটি টুইট করে টাইমস নাউ লেখে, "এটাই পাকিস্তানি ফাইটার জেটের প্রথম ছবি, যা পঞ্জশির উপত্যকার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।" পরে অবশ্য টুইটটি মুছে দেওয়া হয়, তবে সেটির একটি স্ক্রিনশট নিচে দেখতে পারেন।
টুইটটির আর্কাইভ করা আছে এখানে।
ওই একই ভিডিও টুইট করা হয়েছে আফগান জাতীয় প্রতিরোধ ফ্রন্টের টুইটার হ্যান্ডেল দাবি করা অ্যাকাউন্ট থেকেও, যার ক্যাপশনে পঞ্জশিরের পুরো আকাশ পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর দখলে চলে যাওয়ার কথা বলা হয়।
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
আরও পড়ুন: ২০১৮ সালে মজদুর কিশান সংঘর্ষ র্যালির ছবিকে বলা হল দিল্লিতে কৃষকদের ঢল
তথ্য যাচাই
বুম দেখে ভিডিওটি আদৌ পঞ্জশির উপত্যকার নয়, ব্রিটেনের ওয়েল্স এলাকার, যেখানে ফাইটার জেট নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। আমরা আরও দেখলাম, ভিডিওর জেটগুলি আদৌ পাকিস্তানি ফাইটার জেট নয়, বরং আমেরিকার "ম্যাকডোনেল ডগলাস এফ-১৫ স্ট্রাইক ঈগল জেট", যাদের ঘাঁটি ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ারফোর্স-এর ল্যাকেনহিথ বিমানঘাঁটিতে।
প্রথমেই আমাদের নজর পড়ে বেশ কয়েকটি টুইট ও টাইমস নাউ-এর সম্প্রচারের জবাবে, যেখানে দাবি করা হয়, ভিডিওটি মার্কিন বিমানবহরের এফ-১৫ বিমানের, যা ব্রিটেনের ওয়েল্স-এর আকাশে উড়ে যাচ্ছে, আফগানিস্তানের পঞ্জশিরের আকাশে নয়।
আফগান জাতীয় প্রতিরোধ মোর্চার টুইটের জনৈক ব্রিটিশ নাগরিকের দেওয়া জবাবে আমরা দেখলাম লেখা— "ওটি এফ-১৫ ঈগল।কোনও রুশ বিমান নয়, কোনও পাকিস্তানি বিমানও নয়, বরং একটি মার্কিন জেট, যা এখানকার অর্থাৎ ব্রিটেনের ম্যাচ লুপ প্রশিক্ষণ এলাকা দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।"
উপরের এই সূত্রগুলি ধরে আমরা "ম্যাচলুপ+এফ ১৫ ঈগল+ওয়েলস" ইত্যাদি শব্দ বসিয়ে খোঁজখবর চালিয়ে দেখলাম, ব্রিটেনের এক বিমান-আগ্রহী ড্যারেন এডওয়ার্ডস গত ৯ মে, ২০২১ ইউ-টিউবে একটি আপলোড দিয়েছেন তাঁর নামাঙ্কিত চ্যানেলেই।
এডওয়ার্ডস-এর ওই চ্যানেলেই ওয়েলসের পাহাড়শ্রেণির মধ্যে নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া এফ-১৫ জেট বিমানের ভিডিও দেওয়া রয়েছে। সেখানে তিনি জানাচ্ছেন— "ওয়েলসের ল্যাকেনহিথ ঘাঁটি থেকে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে নিচুতে উড়ে যাওয়া এফ-১৫ ঈগল জেট দুর্দান্ত আওয়াজ করতে-করতে ম্যাচ-লুপ অঞ্চলে প্রশিক্ষণ নেয়, যার একের পর এক দৃশ্য আমি তুলে রেখেছি।"
রয়্যাল এয়ারফোর্স ল্যাকেনহিথ-এর ওয়েবসাইট অনুযায়ী এটি হল ব্রিটেনে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি এবং ইউরোপে মার্কিন এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের একমাত্র শাখা।
ইউটিউবে ভিডিওটির ১ মিনিট ৩৮ সেকেন্ড থেকে যে দৃশ্যের সূচনা, টাইমস নাউ সেখান থেকেই ঝেঁপেছে।
আমরা এও লক্ষ্য করেছি যে ইউটিউবের ভিডিওতে ওয়েলসের যে প্রাকৃতিক পটভূমি দেখা যাচ্ছে, টাইমস নাউ সেটাকেই আফগানিস্তানের পঞ্জশির উপত্যকা বলে চালিয়ে দিয়েছে। সীমানা-পাঁচিলের মতো দেখতে দুটি লাইন ব্রিটেনের ওয়েল্স-এর ভিডিওতে যেমন দেখা গেছে, টাইমস নাউ সম্প্রচারিত ভিডিওতেও হুবহু সেই লাইনই দৃশ্যমাণ। লাল রঙ দিয়ে আমরা ওই লাইন চিহ্নিত করে দিয়েছি।
আফগানিস্তানে তালিবানের দখল কায়েম হওয়ার পর থেকে তা নিয়ে ভুল তথ্য ও ভুয়ো খবরের যে প্লাবন শুরু হয়েছে, বুম একনিষ্ঠভাবে সে সবের পর্দাফাঁস করে চলেছে। এই সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলি দেখতে নিচের থ্রেডটি দেখুন।
অতিরিক্ত রিপোর্টিং সুজিত এ।
আরও পড়ুন: ২০১৮ সালে মজদুর কিশান সংঘর্ষ র্যালির ছবিকে বলা হল দিল্লিতে কৃষকদের ঢল