ডেরেক ও'ব্রায়েন-এর আমপান ত্রাণ বিতরণের ছবি শেয়ার নিয়ে বিতর্ক
বুম দেখে উত্তর ২৪ পরগণার হাসনাবাদে ত্রাণের কাজের দুটি ছবি ২৫ মে ২০২০ ফেসবুকে প্রথম পোস্ট করেন বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা।
সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ তথা মুখপাত্র ডেরেক ও'ব্রায়েনের ঘূর্ণিঝড় আমপান পরবর্তী রাজ্য সরকারের ত্রাণ ও পুনর্গঠনের কাজ নিয়ে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা নিয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। নেটিজেনদের অভিযোগ, ডেরেক ও'ব্রায়েন রাজ্যসরকারের আমপান ত্রাণের কর্মকাণ্ডের প্রচার করতে গিয়ে স্বতন্ত্র সংস্থা বিজ্ঞান মঞ্চের ত্রাণের কাজে অংশ নেওয়া কর্মীদের ছবি পোস্ট করেছেন।
বুম দেখে ছবিগুলি প্রথমে বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্য সুকান্ত মন্ডল ও প্রদীপ্ত সরকার ফেসবুকে পোস্ট করেন। তারপর পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকেও ছবি শেয়ার করা হয়।
ডেরেক ও'ব্রায়েন ৩১ মে ২০২০ ফেসবুকে চারটি ছবি পোস্ট করেন। ওই পোস্টে দেখা যায় জলমগ্ন আমপান দূর্গত এলাকার দুটি ছবি। অন্যদুটি ছবির একটিতে গোলাপি জামা পরিহিত এক ব্যক্তিকে দেখা যায়। আরেকটি ছবিতে দেখা যায় নৌকাতে জলের জার বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন ব্যক্তি।
ডেরেক ও'ব্রায়েন ওই ফেসবুক পোস্টে ক্যাপশন লেখেন, ''এক সপ্তাহ আগের তোলা কিছু ছবি শেয়ার করছি। সুন্দরবন একটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। আমপানে ধ্বংস ও নষ্ট হওয়া ২০,০০০ টাকা ঘর পিছু ১০ লক্ষ ঘর পুনর্নিমান সহ ৬,২৫০ কোটি টাকা ত্রাণ রাজ্যের জন্য বাংলার সরকারের পক্ষে। ইনস্টাগ্রামে ফলো করুন আরও ছবি, ভিডিও ও গ্রাফিকের জন্য।''
ফেসবুক পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
২৬ মে ২০২০ নৌকাতে জলের জার বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া ছবিটি টুইট করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সিপিএম দাবি করে, হাসনাবাদে কমরেডদের আমপান ত্রাণের কাজ। টুইটে লেখা হয়, "আমপান পশ্চিমবঙ্গে ধ্বংসাত্মক ক্ষতি করেছে ভয়ানক কোভিড মোকাবিলার সময়। আমাদের কমরেডরা ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেছে। এই ছবিগুলি হাসনাবাদের। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সত্ত্বর জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। #রেডভলেন্টিয়ার্স"
#Amphan has caused devastating damage in WB midst of a grim struggle combating the #COVID. Our Comrades have started relief & rehabilitation work. These photos are from Hasnabad. We demand immediate declaration of national calamity by Central Govt. #RedVolunteers pic.twitter.com/mQF9tKhZHz
— CPI(M) WEST BENGAL (@CPIM_WESTBENGAL) May 26, 2020
বিজ্ঞান মঞ্চের অভিযোগ
১৩ জুন ২০২০ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী ফেসবুকে অভিযোগ তোলেন, "আপনি ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করে পোস্ট করেছেন তার দুটোতে দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের টাকি, হাসনাবাদের ইছামতী বিজ্ঞান কেন্দ্রের সম্পাদক প্রদীপ্ত সরকার, সংগঠনের তরুণ কর্মী একাধারে নেতৃত্ব সুকান্ত আর শুভকে।'' ওই পোস্টে লেখা হয়, ''ওরা কেউ সরকারী লোক নয়।" ফেসবুক পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
নেটিজেনরা বিষয়টি নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় সরব হয়। টুইটে লেখা হয়, ''ডেরেক ও' ব্রায়েন, আপনারা ত্রাণের জিনিস চুরি করছেন, আর এখন ত্রাণ সংক্রান্ত ফটো। না, এগুলি বাংলার সরকারের ত্রাণের কাজের ছবি নয়। এগুলি পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের বিজ্ঞান সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের...আর কত চুরি করবে #টিএমসিচোর?"
Hey @derekobrienmp Your guys are stealing relief materials, now u r stealing relief related photos.
— Amartya... (@Amartya_13) June 13, 2020
No, these pictures not of Bengal government relief work. These are of CPIM WB science organisation wing Paschim Banga Bigyan Mancha...
আর কত চুরি করবে? 😂#TMCchor pic.twitter.com/5TtRRIBqcN
রাজ্য বাম নেতা মহম্মদ সেলিম সৌরভ চক্রবর্তীর আনা অভিযোগের ফেসবুক পোস্টের লিঙ্ক সহ টুইট করে "ত্রাণের ছবিও চুরি" বলে অভিযোগ তোলেন।
চোর গুলো ত্রাণের ছবিও চুরি করছে। https://t.co/VHdrZFGMHf যে বিজ্ঞানমঞ্চ এর অফিস @AITCofficialর লুটেরাদের দখলে 'পরিবর্তন' এর ২০১১ থেকে;
— Md Salim (@salimdotcomrade) June 13, 2020
তাদেরই নিরলস ত্রাণকার্যকে স্বীকৃতি না দিয়ে, বেমালুম @derekobrienmp 'নাম কা ওয়াস্তে' চালিয়ে দিলেন। 'য্যায়সা গুরু ওয়ায়সা চ্যালা'। #Amphan
আরও পড়ুন: ২০১৭ সালে চিনে পুলিশি বর্বরতার একটি ভিডিওকে সাম্প্রতিক বলা হল
তথ্য যাচাই
বুম যাচাই করে দেখে ছবিদুটি প্রথমে ফেসবুকে পোস্ট করেন ইছামতি বিজ্ঞান কেন্দ্রের সম্পাদক প্রদীপ্ত সরকার। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হাসনাবাদে ত্রাণের কাজের সময় বিজ্ঞান মঞ্চের কর্মীরা ছবিগুলি তোলেন। জলের জার নিয়ে নৌকায় যাওয়া ব্যক্তি ইছামতী বিজ্ঞান কেন্দ্রের সদস্য সুকান্ত মন্ডল। সুকান্ত মন্ডল কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ওই দিন ত্রাণ নিয়ে যান বলে জানিয়েছেন বুমকে।
ছবি দুটির উৎস
২৫ মে ২০২০ ইছামতী বিজ্ঞান কেন্দ্রের সম্পাদক প্রদীপ্ত সরকার বিকেল ৫ টা ১৪ মিনিটে বেশ কিছু জলমগ্ন এলাকার ছবি পোস্ট করেন। সেখানে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রদীপ্ত সরকারকে দেখা যায়।
বুম যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রদীপ্ত সরকারের একই পোশাকে থাকা অন্য ছবির তারিখ ও এক্সিফ তথ্য ও লোকেশন ট্যাগ যাচাই করতে সমর্থ হয়েছে।
সুকান্ত মন্ডল তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ২৫ মে ১ টা ৫৩ মিনিটে নৌকা বোঝাই জলের জারের ছবিটি পোস্ট করেন। ছবির সামনের ব্যক্তিই হলেন ইছামতী বিজ্ঞান কেন্দ্রের সদস্য সুকান্ত মন্ডল। প্রদীপ্ত সরকারও একই দিনে বিকেল ৫ টা ১৪ মিনিটে নৌকা বোঝাই জলের জারের ছবিটি সহ মোট ৫ টি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন।
সিএভির বিবৃতি
সৌরভ চক্রবর্তীর পোস্টের অভিযোগ নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছে সিটিজেন এগেইনস্ট ভায়োলেন্স ফাউন্ডেশন(সেএভি)। ওই বিবৃতিতে সই রয়েছে সংস্থাটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডঃ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদারের। উল্লেখ্য ডঃ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদার তৃণমূল নেত্রী ও সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের ছেলে। বিবৃতিটি আর্কাইভ করা আছে এখানে। ফেসবুকের বিবৃতিটি দেখা যাবে এখানে।
— Citizens Against Violence Foundation (@CitizensAgainsV) June 14, 2020
সিটিজেন এগেইনস্ট ভায়োলেন্স ফাউন্ডেশন-এর দাবি তাদের সংস্থার তরফে ত্রাণের কাজ তদারকিতে গিয়েছিলেন বোর্ড সদস্য রবিন মজুমদার। তিনি আমপান বিধ্বস্ত সুন্দবনে ত্রাণের কাজ পরিদর্শনে যান। সেই দলে নাকি বিজ্ঞান মঞ্চের কর্মীরাও ছিলেন। সেখানেই রবিন মজুমদার ছবিগুলি পান ও পরে সিটিজেন এগেইনস্ট ভায়োলেন্স ফাউন্ডেশনকে ছবিগুলি দেয়। সেই ছবিই পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গে এবং সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েনকে শেয়ার করা হয়েছিল।
রবিন মজুমদারের পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে। ওই একই ছবি ডঃ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদার ২৭ মে ২০২০ তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন।
ইছামতী বিজ্ঞান কেন্দ্রের সম্পাদক প্রদীপ্ত সরকার বুমকে বলেন, ''রবিন মজুমদার কোনও ভাবে বিজ্ঞান মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত নয়। তিনি কিভাবে ছবি পেয়েছেন তাঁর জানা নেই। ছবি নিয়ে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। ছবিগুলি কোথায় তোলা হয়েছে আমি পোস্টেই উল্লেখ করেছি। মাননীয় সাংসদ কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিজ্ঞান মঞ্চের নাম উল্লেখ করলে পারতেন।''
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী ফেসবুকে পাল্টা পোস্ট দিয়ে ত্রাণের কাজে সিএভি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে বিজ্ঞান মঞ্চের যোগ অস্বীকার করেছেন। পেস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েন-এর ফেসবুক পোস্টের বাকী দুটি ছবি সুন্দরবনের কিনা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। বুমের তরফে সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েন-এর সঙ্গে যোগোযোগ করা হয়েছে। তাঁর বিবৃতি পেলে প্রতিবেদনটি সংস্করণ করা হবে।
২০১৬ সালে ডেরেক ও'ব্রায়েন সিপিআইএম নেতা প্রকাশ কারাতকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের মিষ্টি খাওয়ানোর সম্পাদিত ছবি ব্যবহার করলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। পরে ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট করে ভুল স্বীকার করে নেন ডেরেক।
আরও পড়ুন: গাছ আঁকড়ে বাচ্চা মেয়ের বাঁচতে চাওয়ার ছবিটি আমপানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়