কলকাতায় মদের হোম ডেলিভারি: সংবাদমাধ্যমে যেভাবে ছড়ালো গুজব
নবান্ন ও কলকাতা পুলিশের তরফে মদের হোম ডেলিভারির ভাইরাল খবরকে আগেই অসত্য বলা হয়েছে।
গত বুধবার ৮ এপ্রিল ২০২০ থেকে সোশাল মিডিয়ায় এবং সংবাদ মাধ্যমের একাংশে ভুয়ো বার্তা রটে যায় যে, কলকাতা শহরে মদ্য-পানীয়ের হোম ডেলিভারি দেবে রাজ্য সরকার। কলকাতা পুলিশ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে যদিও শহরে মদ্য পানীয়ের হোম ডেলিভারি শুরু হওয়ার খবরকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলা হয়েছে।
ভাইরাল হওয়া সংবাদে দাবি করা হয়, একে একে মিষ্টির দোকান, ফুল বিক্রেতাদের ছাড় দেওয়ার পর, এবার লকডাউন চলাকালীন সুরা সেবনকারীদের কথা ভেবে ছাড়পত্র দিতে চলেছে রাজ্য সরকার।
সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত চলবে এই অর্ডার নেওয়া। এলাকার মদের দোকানে ফোন করে অর্ডার দিতে পারবেন ক্রেতারা। যেখান থেকে মদের দোকানের ডেলিভারি বয়ের মাধ্যমে মদ পৌঁছে যাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে। আরও বলা হয় যে, দুপুর ২টো থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ওই মদের হোম ডেলিভারি করা হবে। বাড়ির কাছের যেকোন মদের দোকানে অথবা পানশালায় ফোন করে ওই অর্ডার দেওয়া যাবে বলেও জানা গিয়েছিল। শুধু অফ শপ ছাড়াও অন শপ, হোটেল, বার, রেস্তরাঁ থেকেও মদের হোম ডেলিভারি করা হবে বলেও সংবাদে উল্লেখ করা হয়।
সংবাদের বিবরণে আরও বলা হয় যে, এই পরিষেবা দেওয়ার জন্যে বৈধ লাইসেন্সধারী দোকানদারকেই শুধু স্থানীয় থানা থেকে অনুমতি দেওয়া হবে। একজন দোকানদারকে সর্বোচ্চ তিনটি পাস দেওয়া হবে। ওই পাসে স্থানীয় থানার ওসি এবং অতিরিক্ত ওসির সই থাকবে। তবে, কেউ দোকানে গিয়ে মদ কিনতে পারবেন না। আবগারি লাইসেন্স রয়েছে এমন দোকান বা পানশালার কর্মীরা মদের হোম ডেলিভারি করতে পারবেন বলেও খবর ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: লকডাউন কার্যকরী করতে কেনিয়া কি মাসাই জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়েছে? একটি তথ্যযাচাই
সোশাল মিডিয়ায় ঘুরতে থাকে আবগারি বিভাগের শীলমোহর সহ ডেলিভারি পাসের একটি নমুনা।
সংবাদ চ্যানেল এবিপি আনন্দে কলকাতা পুলিশের সূত্রকে উল্লেখ করে প্রথমে মদের হোম ডেলিভারি শুরু হওয়া নিয়ে একটি রিপোর্ট দেখানো হয়, যদিও কিছুক্ষনের মধ্যে এবিপি আনন্দ রিপোর্টটি ওয়েবসাইট থেকে নামিয়ে নেয় কিন্তু ততক্ষণে রিপোর্টটিকে ডাউনলোড করে অনেকে ফেসবুকে শেয়ার করেন।
ফেসবুক পোস্ট
এরকমই ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি পোস্টের ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "সারা পৃথিবীতে করোনায় যখন মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে কি করে নির্মূল করা যায় তার কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পশ্চিমবাংলায় মদ হোম ডেলিভারি করার জন্য ব্যস্ত সরকার।"
ভিডিওটি নীচে দেখুন। পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
বিভিন্ন সংবাদ পোর্টালে এই ভুয়ো খবর প্রকাশের পাশাপাশি, নেটিজেনদের মধ্যে এই খবর নিয়ে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অনেকে খবরটির সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
তারকাদের টুইট
টুইটারেও অনেক ভেরিফাইড হ্যান্ডেল থেকে খবরটা পোস্ট করা হয় এবং ভিন রাজ্যের নেটিজেনরা তাদের রাজ্য প্রশাসনের কাছেও পশ্চিমবঙ্গের দৃষ্টান্ত তুলে ধরছিলেন।
বিহারের প্রাক্তন লোকসভা সাংসদ শত্রুঘ্ন সিনহাও নিজের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে পশ্চিমবঙ্গে মদের হোম ডেলিভারি শুরু করার এরকমই খবর নিয়ে পোস্ট করেন। টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
Several states had started home delivery of medicines,vegetables, fruits,grocery items & dairy products during this #CoronaPandemic bringing immense relief to people. Now, Govt of Bengal has gone a step further by showing the way of allowing home delivery of wine & liquor with
— Shatrughan Sinha (@ShatruganSinha) April 10, 2020
চিত্র পরিচালক রাম গোপাল ভার্মাকেও টুইট করতে দেখা গেল একই বিষয়ে। টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
Humble request to #KCR @KTRTRS and @ysjagan from me, those who are bored, pulling their hair,crying like babies,joining mental hospitals and wives getting beaten by husbands in frustration ..Have a large heart like Mamata Banerjee and give us CHEERS! https://t.co/EHxbngJcpg
— Ram Gopal Varma (@RGVzoomin) April 10, 2020
গণমাধ্যমে ভুয়ো খবর
ওয়েব নিউজ পোর্টাল বাংলা হান্টও শহরে মদের হোম ডেলিভারি নিয়ে একটি বিভ্রান্তিকর অস্বচ্ছ খবর প্রকাশিত হয়, যেখানে কোন তারিখ ছাড়া একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় এবং দাবি করা হয় রাজ্য সরকার মদের হোম ডেলিভারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিবেদনটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
৮ এপ্রিল বিকেল ৫টা ৪৯মিনিটে এশিয়ানেট নিউজের ওয়েবসাইটেও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় যার শিরোনাম ছিল, "লকডাউনে মদের হোম ডেলিভারি, নতুন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে রাজ্য সরকার"। প্রতিবেদনটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
সিএনএন নিউজ ১৮ চ্যানেল থেকেও ইংরেজিতে একই বিবরণ সহ একটি খবর পরিবেশন করা হয়। ইউটিউবে চ্যানেলে পোস্ট করা ভিডিওটির বিবরনে লেখা আছে, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার লকডাউন চলাকালীন রাজ্যে মদের হোম ডেলিভারির অনুমোদনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের আবগারি দপ্তরের সুত্র অনুযায়ী লকদাউন চলাকালীন রাজ্যে মদের হোম ডেলিভারিতে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই"
(মূল ইংরেজী বিবরণ "The Mamata Banerjee-led West Bengal government has decided to allow home delivery of liquor during the lockdown period in the state. According to sources in the Excise Directorate of West Bengal government, there is no prohibition on sale of liquor during the lockdown.")
রিপোর্টটি নীচে দেখুন।
জি নিউজের সংবাদিক পূজা মেহতাকেও একই বিভ্রান্তিকর দাবিসহ টুইট করতে দেখা গেছে। তিনি ওই টুইটকে কোট করে আরেকটি ছবি টুইট করেন। সেখানে দাবি করেন হাওড়া জেলাশাসকের তরফে প্রকাশ করা মদের ডেলিভাবি পাশের নমুনা।
All those who called my report 'fake' this is to let you all know that the govt or Kolkata Police did not issue any statement through the official channels or on social media terming it 'fake' in the last 24 hrs. A sample format was issued by DM Howrah for home delivery of liquor https://t.co/e0aB0T4s0T pic.twitter.com/D5pJwLhd7D
— Pooja Mehta (@pooja_news) April 9, 2020
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
খবর সংশোধন
বুধবার দুপুরে ভাইরাল হওয়া এই নির্দেশিকাকে ঘিরে শহরজুড়ে হইচই পড়ে যায়। যদিও পরে কলকাতা পুলিশ জানায়, গোটা খবরটি ভুয়ো। আবগারি বিভাগের জারি করা যে ডেলিভারি পাসের ছবিকে ভাইরাল করা হয়েছে সেটাও ভুয়ো, কেননা সেখানে কোন আধিকারিকের স্বাক্ষর নেই। আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া একটি বার্তায় কলকাতা পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা জানান যে খবরটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, "এটা অসত্য খবর।"
মহাকরনের পক্ষ থেকে রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা ইন্ডিয়া টুডেকে জানান আবগারি দপ্তর থেকে এরকম কোন নির্দেশিকা জারি করা হয়নি, ভাইরাল হওয়া খবরকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন শ্রী সিনহা। তিনি বলেন, "সরকার কোন নির্দেশিকা জারি করেনি।"
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাসের সতর্কতায় রাজ্যে বন্ধ থাকবে ইন্টারনেট খবরটি ভুয়ো
এপিবি আনন্দ পরে "কলকাতায় এখান মদের হোম ডেলিভারি হচ্ছে না" বলে নবান্নকে উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রকাশ করে।
বৃহস্পতিবার রাতে ও শুক্রবার সকালে মালদা-মুর্শিদাবাদ জেলা সীমান্ত থেকে রাজ্য পুলিশ অ্যাম্বুলেন্স করে বিদেশি মদ নিয়ে যাওয়ার সময় বাজেয়াপ্ত করেছে রাজ্য পুলিশ।
শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছেন। রাজ্যে এপর্যন্ত ৯৬ জনকে ভুয়ো এবং উসকানিমূলক পোস্টের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে।
আর পড়ুন: লকডাউনের মেয়াদবৃদ্ধি হু-এর প্রোটোকল দাবি করা ভাইরাল বার্তাটি ভুয়ো