অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের মুসলমান ও শরিয়া আইন সংক্রান্ত বক্তব্যটি ভুয়ো
বুম যাচাই করে দেখেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড এই ধরণের কোনও বক্তব্য রাখেননি।
সোশাল মিডিয়ায় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের বক্তব্য হিসেবে একটি ভুয়ো ফেসবুক বার্তা ভাইরাল হয়েছে। ফেসবুক বর্তাটি মুসলিম, শরিয়া আইন ও শরনার্থীদের প্রসঙ্গে মনগড়া বক্তব্য। এর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের কোনও সম্পর্ক নেই।
বুমের হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন (৭৭০০৯০৬১১১)-এ ওই বার্তাটি পাঠিয়ে তার সত্যতা জানতে চাওয়া হয়েছে। আমরা ফেসবুকে ক্যাপশন সার্চ করেও একই বয়ানে ভাইরাল ফেসবুক পোস্ট পেয়েছি।
পোস্টিতে লেখা হয়েছে জুলিয়া গিলার্ড বলেছেন: ''মুসলমানরা, যারাই ইসলামিক শরিয়া আইন চায়, তাদের বুধবারের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে যেতে হবে। কারণ অস্ট্রেলিয়া দেশটির কট্টর মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী মনে করে। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি মসজিদ তদন্ত করা হবে এবং মুসলমানরা এই তদন্তে আমাদের সহায়তা করবে। যারা বাইরে থেকে তাদের দেশে এসেছেন তাদের অস্ট্রেলিয়ায় থাকার জন্য নিজেকে বদলাতে হবে অস্ট্রেলিয়ান জনগণ নয়। তবে আমি অস্ট্রেলিয়ান জনগণকে আশ্বস্ত করি যে আমরা যা করছি তা কেবল অস্ট্রেলিয়ার জনগণের স্বার্থেই করছে।
আমরা এখানে আরবি না ইংরেজী কথা বলি। সুতরাং আপনার যদি এই দেশে থাকতে হয় তবে অবশ্যই আপনাকে ইংরেজি শিখতে হবে। অস্ট্রেলিয়ায় আমরা যীশুকে Godশ্বর হিসাবে বিশ্বাস করি, আমরা কেবল আমাদের খ্রিস্টান ধর্মকে বিশ্বাস করি এবং কোনও ধর্মই নয়, এর অর্থ এই নয় যে আমরা সাম্প্রদায়িক! এজন্য আমাদের কাছে সর্বত্র Godশ্বরের ছবি এবং ধর্মীয় গ্রন্থ রয়েছে! আপনার যদি এ নিয়ে কোনও আপত্তি থাকে তবে আপনি অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে বিশ্বের যে কোনও জায়গায় যেতে পারেন। অস্ট্রেলিয়া আমাদের দেশ, আমাদের পৃথিবী এবং আমাদের সভ্যতা। আমরা আপনার ধর্মকে বিশ্বাস করি না, তবে আপনার অনুভূতিতে বিশ্বাসী! সুতরাং যদি আপনাকে নামাজ দিতে হয় তবে শব্দদূষণ করবেন না... আমাদের অফিস, স্কুল বা পাবলিক প্লেসে নামাজ পড়বেন না! আপনার বাড়িতে বা মসজিদে শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ পড়ুন। যাতে আমাদের কোনও সমস্যা না হয়। যদি আমাদের পতাকা, আমাদের জাতীয় সংগীত, আমাদের ধর্ম বা আমাদের জীবনযাপন সম্পর্কে কোনও অভিযোগ থাকে তবে আপনি এখনই অস্ট্রেলিয়া ত্যাগ করুন"। জুলিয়া গিলার্ড - প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়া। ভারতের সিকুলার নেতারা এঁদের কাছ থেকে শিখুন কি করে দেশের সভ্যতা, কালচার এবং স্বার্থকে সবার উপরে রাখতে হয়।''
ফেসবুক পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
ফেসবুকে ভাইরাল
আমরা ক্যাপশন সার্চ করে বার্তাটির ইংরেজি বয়ানে ফেসবুক পোস্ট খুঁজে পেয়েছি।
তথ্য যাচাই
বুম যাচাই করে দেখেছে উপরে বলা বার্তাটির বক্তব্যের সঙ্গে অস্ট্রেরিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের কোনও সম্পর্ক নেই। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জুলিয়া গিলার্ড। বস্তুত, ভাইরাল বর্তাটির কোনও বক্তব্যই জুলিয়া গিলার্ডের নয়।
ফেসবুক পোস্টগুলির বয়ান তৈরি করা হয়েছে—১) ২০১৬ সালে মুসলিম জঙ্গীদের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান, ২) ২০০৫ সালে লন্ডনের পাতাল রেলে নাশকতার প্রেক্ষিতে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিবিদদের মুসলিমদের সম্পর্কে বলা বক্তব্য এবং ৩) ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে আমরিকায় জঙ্গী হানার প্রেক্ষিতে প্রক্তন বায়ুসেনার আধিকারিকের শরনার্থীদের সম্পর্কে মতামত ভিত্তিক লেখার বিভিন্ন খাপছাড়া অংশ মিশিয়ে। এই বর্তাটির বাকী অংশ মনগড়া।
মুসলমান ও শরিয়া আইন
প্রথম অনুচ্ছেদে যেখানে বার্তাটিতে লেখা হয়েছে, ''মুসলমানরা, যারাই ইসলামিক শরিয়া আইন চায়, তাদের বুধবারের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে যেতে হবে।'' ২০১৬ সালে মাল্টা ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এ উপরে বলা বক্তব্য প্রকাশ হয়েছিল মুসলিম জঙ্গীদের প্রসঙ্গে। এই বিতর্ক হয়েছিল জন হওয়ার্ড প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন, জুলিয়া গিলার্ডের প্রধনমন্ত্রীত্বকালীন নয়।
দেশ থেকে তাড়ানো ও মসজিদে তল্লাশি
এই বিষয়টি তদানীন্তন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জন হোয়ার্ড ও শিক্ষামন্ত্রী ব্রেনডন নেলসনের বক্তব্য নিয়ে তৈরি হয়েছে। রয়টার্স-কে উদ্ধৃত করে ২০০৫ সালের ২৪ অগস্টের
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বিষয়টি পাওয়া যাবে।
মতামত ভিত্তিক প্রতিবেদনের অংশ
২০০১ সালে ব্যারি লাউডারমিল্ক নামে এক ব্যক্তি ৯/১১ হামলার পরে একটি মতামত ভিত্তিক প্রবন্ধ লেখেন। যা জর্জিয়ার একটি স্থানীয় সংবাদপত্র বার্তো ট্রেডারে প্রকাশিত হয়েছিল। ভিয়েট নাও ন্যাশানাল ম্যাগাজিনে (যারা ব্যারি লাউডারমিল্কের লেখাটি প্রকাশ করেছিল) ক্রিশ্চিয়ান নেলশন লেখাটির উৎস হিসেবে জানান, ''এই লেখাটা প্রথমে বন্ধুদের দেখানোর পর ব্যারি লাউডারমিল্ক স্থানীয় সংবাদপত্র বার্তো ট্রেডারে পাঠান। যারা আগে লাউডারমিল্কের অনেক লেখা ছেপেছিল।''
লেখাটি বেরনোর কয়েকদিন পর লেখাটি নিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ফোন ও ইমেল এলে সম্বিত ফেরে লাউডারমিল্কের। স্থানীয় প্রসঙ্গে লেখাটি শেষ মেষ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। এই একই বয়ানে ইংরেজিতে ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল। তা থেকেই মনগড়া বাংলা অনুবাদে লিখে বার্তাটি ছড়ানো হচ্ছে। বাস্তবে, অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড-এর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই বার্তাটির। বিষয়টি ২০০১ সালের ২৫ অক্টোবর স্ন্যুপস ও ২০১৯ সালের জুন মাসে অল্টনিউজ তথ্য যাচাই করেছে।