কোভিড টিকার পর ডেক্লোফেনাক ইঞ্জেকশন নিয়ে তামিলনাড়ুর চিকিৎসকের মৃত্যু?
ওই চিকিৎসককে ব্যথা উপশমকারী ডেক্লোফেনাক দেওয়া হয় কোভিড-১৯ টিকার নেওয়ার একমাস পরে, যার সঙ্গে টিকাকরণের কোনও সম্পর্ক নেই।
সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি বার্তায় বিভ্রান্তিকর দাবি করা হয়েছে যে, কোভিড-১৯ টিকাকরণের (COVID-19) পরই ডেক্লোফেনাক (Diclofenac) ব্যাথা উপশমকারী (Painkiller) দেওয়ার ফলে তামিলনাড়ুর ২৬ বছরের চিকিৎসক হরি হরিনির (Dr Hari Harini)মৃত্যু হয়।
বুম দেখে যে, যদিও চিকিৎসকরা কোভিড-১৯ টিকার দেওয়ার পরই ব্যথা কমানোর জন্য ডেক্লোফেনাক নিতে নিষেধ করছেন, কিন্তু ডাক্তার হরিনিকে ওই ওষুধ দেওয়া হয় কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার একমাস পর—টিকা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নয়।
ডঃ হরিনি ভ্যাকসিন নেন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আর ৫ মার্চ তাঁর স্বামী তাঁকে ডেক্লোফেনাক দেন ব্যথা কমানোর জন্য। তামিলনাড়ুর স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে যে, ওই চিকিৎসকের মৃত্যু হয় ডেক্লোফেনাক ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য এবং তার সঙ্গে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের কোনও সম্পর্ক নেই।
ওই চিকিৎসক মাদুরাই মেডিকেল কলেজে অ্যানাস্থেশিয়ায় এমডি করছিলেন, এবং তাঁর স্বামী ডঃ পি অশোক ভিগ্নেশ একই কলেজে জেনারেল সার্জারিতে এমএস করছেন। ৫ মার্চ ডঃ ভিগ্নেশ তাঁর স্ত্রীকে ডেক্লোফেনাক ইঞ্জেকশন দেন।
ডঃ হরি হরিনির মৃত্যুর পর সোশাল মিডিয়ায় নানা রকম বিভ্রান্তিকর পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন, কোভিশিল্ড বা কোভ্যাক্সিন নেওয়ার পর ব্যথা কমানোর জন্য ডেক্লোফেনাক ব্যবহার না করে প্যারাসিটামল ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছেন। বুম এই মেসেজটি তার হোয়াটসঅ্যাপ টিপলাইনে পায়।
ডঃ হরি হরিনির মৃত্যুর সঙ্গে কি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের কোনও যোগ আছে?
বুম মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী মিশন হাসপাতালের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ডঃ কান্নানের সঙ্গে কথা যোগাযোগ করে। ডঃ হরি হরিনিকে মার্চ ১১ ওই হাসপাতালেই ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি বলেন, "আমাদের এখানে আনার আগে তাঁকে আরও দুটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। উনি অজ্ঞান ছিলেন এবং তাঁর জ্ঞান ফেরানো আমাদের পক্ষে খুব কঠিন ছিল। এক সপ্তাহ তাঁকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছিল।"
ওই চিকিৎসকের শারীরিক পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে ডঃ কান্নান জানান, ডঃ হরি হরিনি ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভ্যাকসিনের দুটি ডোজই নেন। তারপর একমাস পর মার্চ মাসে তাঁর একটি ব্যথা হতে আরম্ভ করে, এবং তাঁর স্বামী তাঁকে ডেক্লোফেনাক ইঞ্জেকশন দেন। ডঃ কান্নান বলেন, "আমরা তাঁর ব্যথার কারণ জানিনা,তবে ডেক্লোফেনাক ইঞ্জেকশন তাঁর শরীরে অ্যালার্জিক প্রতিক্রয়া তৈরি করে থাকতে পারে।"
ডঃ কান্নানকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের সঙ্গে ওই ব্যথা হওয়ার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, তিনি জানান যে, এখন পর্যন্ত যা পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে তাতে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানা গেছে। তিনি আরও বলেন, "ভ্যাকসিন নেওয়ার একমাস পর তাঁর ব্যথা শুরু হয়, সুতরাং ভ্যাকসিনের সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা নেই।"
ডেক্লফেনাক কি?
ডেক্লফেনাক একটি নন-স্টেরোয়ডাল অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ (এনএসএআইডি), যা ব্যথা উপশমের জন্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও এর অন্যান্য ব্যবহারও আছে।
বুম নভি মুম্বইয়ের অক্ষয়জ্যোত ক্লিনিকের চিকিৎসক এবং ইন্টেন্সিভিস্ট ডঃ অক্ষয় চালানির সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি জানান যে, চিকিৎসক পরামর্শ দিলে তবেই ডেক্লোফেনাক ব্যবহার করা উচিত। তিনি বলেন, "এই ব্যথা উপশমকারী ওষুধটি ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধ নয়, অর্থাৎ ইচ্ছে হলেই কেউ ওষুধের দোকান থেকে এই ওষুধটি কিনে খেতে পারেন না, কারণ এর বিভিন্ন জটিলতা এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে।" এটি সাধারণত ফোলা কমাতে ব্যবহার করা হয়, আবার আর্থারাইটিসে গাঁটের শক্তভাব কমাতেও দেওয়া হয়। ট্যাবলেট এবং ইঞ্জেকশন, দুই রকম ভাবেই এটি পাওয়া যায়।
কোভিড-১৯'র সঙ্গে ডেক্লোফেনাকের সম্পর্ক
তামিলনাড়ুর স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বক্তব্য অনুসারে ডেক্লোফেনাক ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর ডঃ হরি হরিনির শরীরে অ্যানাফাইলেকটিক শক তৈরি হয়। যেহেতু এই ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে, তাই এই ওষুধ দেওয়ার আগে ভাল ভাবে পরীক্ষা করে নেওয়ার উপর ডঃ চালানি বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন।
ডঃ চালানি বলেন, "কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার পর ব্যথা কমানোর জন্য ডেক্লফেনাক দেওয়া উচিত নয়। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর এই ওষুধ দেওয়ার কী ফল হতে পারে, তার উপর কিছু কিছু গবেষণা হয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। এনএসএআইডি গ্রুপের অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে এই ওষুধ কোভিড-১৯'র উপর কী কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়েও গবেষণা চলছে।"
ডঃ চালানি আরও ব্যাখ্যা করে জানান যে,এনএসএআইডি গ্রুপের ওষুধহৃৎপিণ্ডের উপর প্রভাব ফেলে। ডঃ চালানি যা বলেছেন, ডঃ কান্নানও সেই বিষয়ের উপরই জোর দিয়ে বলেন, "কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ডেক্লোফেনাক দেওয়া হয় না। আমি তার বদলে প্যারাসিটামল খাওয়ার পরামর্শ দিই।"
২০১৩ সালে পিএলওএস মেডিসিনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখানো হয় যে,যাঁদের ডায়বেটিস, হাই কোলেস্টরল বা অন্য কোনও হৃদরোগের সমস্যার মতো উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন অসুস্থতা রয়েছে,তাঁদের ক্ষেত্রে ডেক্লোফেনাক হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
হু কোভিড-১৯ নিয়ে ৭৩টি গবেষণার রিভিউ করে এবং সেগুলির মধ্যে একটি ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে,ভাইরাল সংক্রমণ হওয়ার পর এবং কোভিড-১৯'এর মৃদু উপসর্গ থাকলে ডেক্লোফেনাক নেওয়ার ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাকি স্টাডিগুলিতে কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে ডেক্লোফেনাকের খারাপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর এনএসএআইডি গ্রুপের ওষুধ নিলে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা কোনও স্টাডি থেকে পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। চিকিৎসকরা অন্য ব্যাথা উপশমকারী ওষুধের বদলে প্যারাসিটামল ব্যবহার করার পরামর্শ দেন, কারণ প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধে (painkiller) নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
আরও পড়ুন: কলকাতা টিভির ভুয়ো জনমত সমীক্ষা নন্দীগ্রাম আসনে এগিয়ে শুভেন্দু অধিকারী