আইন
হাথরস মামলা: মৃত্যুকালীন জবানবন্দীর আদালতে গুরুত্ব কতটা?
নির্যাতিতর মৃত্যুকালীন জবানবন্দী অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করতে যথেষ্ট, তবে অসত্য প্রমাণ হলে আদালত তা খারিজ করতে পারে।
উত্তরপ্রদেশের হাথরসের ১৮ বছরের নির্যাতিতা মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে পুলিশের কাছে দেওয়া মৃত্যুকালীন জবানবন্দীতে চার যুবকের নাম উল্লেখ করেন যাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও গণধর্ষণের অভিযোগ করা হয়।
হাথরসের তরুণীর যৌন নিগ্রহের অভিযোগের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন জমা পড়ে। এই সপ্তাহের গোড়ায় ওই আবেদনের উত্তর দিতে গিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকার আদালতে একটি হলফনামা পেশ করে জানায় যে, নির্যাতিতা তাঁর প্রথম অভিযোগে সন্দীপের নাম করেছেন। তিনি যখন ক্ষেতে কাজ করছিলেন, তখন সন্দীপ তাঁর গলায় ফাঁস লাগায় বলে অভিযোগ।
ওই হলফনামায় আরও বলা হয় যে, তার পর নির্যাতিতা দু'বার তাঁর বয়ান পরিবর্তন করেছেন। মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ আগে তাঁর শেষ বয়ানে তিনি তাঁর উপর গণধর্ষণের জন্য সন্দীপ এবং আর তিন জন— রামু সিং, রবি সিং এবং লবকুশ সিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। নিগৃহীতা তরুণী যত বার তাঁর বয়ান বদলেছেন, তত বার সেই নতুন অভিযোগ যোগ করতে পুলিশ এফআইআরে সংশোধন করেছে এবং নির্যাতিতার দেওয়া শেষ বয়ান অনুসারে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৮৬৭ ধারা অনুসারে এই চার জনের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগ নথিভুক্ত করে।
তবে বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে, কতৃপক্ষ তার পর থেকে ধর্ষণের অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মৃত্যুর আগের বয়ান কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আরও পড়ুন: মৃতের অধিকার ও শেষকৃত্য: যা জানা প্রয়োজন
মৃত্যুর আগে মানুষ মিথ্যে বলে না
ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২-এর ৩২ (১) ধারা অনুসারে কোনও ব্যক্তি যদি তার মৃত্যু আসন্ন জেনে অথবা না জেনে কোনও বয়ান দেন যা সরাসরি তাঁর মৃত্যুর কারণ নির্দেশ করে বা যে পরিস্থিতিতে তাঁর মৃত্যু হয়, তা জানান, বা তাঁর মৃত্যুর কারণ নিয়ে যদি কোনও প্রশ্ন তোলেন, তবে সেই বয়ানকে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর আগের বয়ান বলে বর্ণনা করা হয়।
আইনজীবী সারিম নাভেদ জানিয়েছেন, "মৃত্যুর আগের বয়ান অন্য যে কোনও বয়ানের মতোই, তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় থাকায় আদালতে এসে বয়ান দিতে পারেন না। আদালতে করা কোনও বয়ান বা প্রমানের তুলনায় মৃত্যুর আগের বয়ানের যে আলাদা কোনও গুরুত্ব আছে, তা নয়। তবে ধর্ষণের ক্ষেত্রে নির্যাতিতার বয়ান সাজা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট মনে করা হয়। একই রকম ভাবে অত্যাচারিতের মৃত্যুর আগে তার দেওয়া শেষ বয়ান সাজা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।"
হাথরসের ঘটনার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে নাভেদ বুঝিয়ে বলেছেন যে, সাধারণত কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওরের ১৬১ ধারা অনুসারে পুলিশের কাছে দেওয়া বয়ান আদালত গ্রাহ্য নয়। কিন্তু যদি পুলিশের কাছে বয়ান দেওয়ার পর আক্রান্তের মৃত্যু হয়, তখন ওই বয়ান আদালাত গ্রাহ্য হয়।
সিভিল এবং ক্রিমিনাল কেসের ক্ষেত্রে মৃত্যুর আগের বয়ান প্রমাণ হিসাবে ধরা হয়।
২০০৩ সালে পিভি রাধাকৃষ্ণণ বনাম কর্ণাটক সরকার কেসে সুপ্রিম কোর্ট তার আদেশে বলে, "যে নীতির উপর ভিত্তি করে মৃত্যুকালীন বয়ান প্রমাণ হিসাবে ধরা হয়, তা লাতিন ম্যাক্সিম নেমো মর্টুরাস প্রসুমিটুর মেন্ট্রি-তে রয়েছে, যার অর্থ কোনও মানুষ মুখে মিথ্যে কথা নিয়ে সৃষ্টিকর্তার সম্মুখীন হয় না।
মৃত্যুকালীন বয়ান যে সব সময় মুখে বলা হতেই হবে, তাও নয়। এটি লিখিতও হতে পারে বা ইশারার সাহায্যেও বোঝানো হতে পারে, এমনকি নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তরে আক্রান্ত মাথা নেড়েও উত্তর দিতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে যিনি উত্তরগুলি নথিভুক্ত করছেন, তাঁকে আক্রান্তের ইশারার অর্থ ঠিক ভাবে বুঝতে হবে।
নির্ভয়া কেসের ক্ষেত্রে আক্রান্ত মৃত্যুর আগে তিনটি বয়ান দিয়েছিলেন, যার মধ্যে শেষটি শুধু ইশারার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল। ২০১২ সালের সেই ভয়ঙ্কর দিল্লি গণধর্ষণের শিকার ২৩ বছরের ফিজিওথেরাপির ওই ছাত্রীকে নির্ভয়া নামটি দেওয়া হয়েছিল।
প্রবীণ আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং বুমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, প্রমাণ হিসাবে হাথরস ঘটনার আক্রান্তের মৃত্যুকালীন বয়ানের মূল্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, "আমাদের কাছে মৃত্যুকালীন বয়ানের ভিডিও রয়েছে, যাতে আক্রান্ত পরিষ্কার জানিয়েছেন যে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল।" জয়সিং আরও জানান যে কোনও ধর্ষণ, যৌতুকের দাবিতে মৃত্যু বা আত্মহত্যার ঘটনায় যখন কোনও মহিলা বয়ান দেওয়ার পর মারা যান, তখন আইনের চোখে তার বিরাট মূল্য রয়েছে, কারণ যিনি ওই বয়ান দিয়েছেন, বয়ান দেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
মৃত্যুকালীন বয়ান কে রেকর্ড করতে পারেন এবং তার জন্য কোনও তথ্য প্রমাণ লাগে কি?
যে কেউ মৃত্যুকালীন বয়ান রেকর্ড করতে পারে। সুপ্রীম কোর্ট ২০১৩ সালের একটি আদেশে বলে, "এই ব্যাপারে আইনের কোনও নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ নেই। মৃত্যুকালীন বয়ান যে কেউ রেকর্ড করতে পারে, এবং তার কোনও নির্দিষ্ট ফরম্যাট, পদ্ধতি বা কোনও ফর্ম নেই যা অনুসরন করতে হবে।"
নির্ভয়া মামলা মৃত্যুকালীন বয়ানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। নির্ভয়া তাঁর মৃত্যুর আগে তিনটি বয়ান দিয়েছিলেন, যাতে তিনি একই কথা বলেছিলেন। তাঁর দাবি সমস্ত মেডিক্যাল এবং বৈজ্ঞানিক প্রমাণের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল এবং তা অভিযুক্তদের অপরাধ নিশ্চিত করেছিল।
২০১৩ সালের আশাবাই বনাম মহারাষ্ট্র সরকারের মামলায় সুপ্রীম কোর্ট বলেছিল যে, আইন মৃত্যুকালীন বয়ান গ্রহণ করার জন্য প্রমাণের উপর জোর দেয় না। সুপ্রীম কোর্ট বলে, "মৃত্যুকালীন বয়ানের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নিয়মরক্ষার্থে প্রমাণের উপর জোর দেওয়া হয়।"
আদালত জানায়, "মৃত্যুর আগে যখন অনেকগুলো বয়ান দেওয়া হয়, তখন প্রতিটা বয়ান আলাদা ভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার এবং একটি অন্যটির চেয়ে আলাদা বলে কোনওটাই বাদ দেওয়া উচিত নয়।" শীর্ষ আদালত একটি নোটে সতর্ক করে এবং বলে, "মৃত্যুকালীন বয়ান নিজে থেকে করা হয়। সেখানে প্রশ্ন করার মতো বিশেষ কিছু থাকে না যদি না এই দাবি ওঠে যে ওই বয়ানে কোনও কাটাছেঁড়া করা হয়েছে বা ওই বয়ানের বক্তব্য শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল।"
২০১০ সালে আবরার বনাম উত্তরপ্রদেশ সরকার মামলার ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালত বলে যে, আক্রান্তের শারীরিক ব্যথা যন্ত্রণার কারণে মৃত্যুকালীন বয়ানে ছোটখাট অসুবিধা থাকতে পারে। এই কথা আরও বিশেষভাবে প্রযোজ্য যখন বারবার বয়ান নেওয়া হয়েছে।
সন্দেহ হলে আদালত মৃত্যুকালীন বয়ান খারিজ করে দিতে পারে
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে শীর্ষ আদালত জানায়, যে সব ক্ষেত্রে অনেক ধরনের বয়ান আছে, সে ক্ষেত্রে যে বয়ানটিকে অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণ হয়, আদালত সেটিকেই গ্রহণ করবে, এবং বাকি বয়ানগুলোকে বাতিল করে দেব, এমন যেন না হয়।
আদালত মামলার তথ্যাদি দেখে তার সিদ্ধান্ত নেবে এবং যদি আদালত দেখে যে, মৃত্যুকালীন বয়ানে সত্যি বেরিয়ে আসছে, তবে আদালত তা গ্রহণ করতে পারে। একই ভাবে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে মৃত্যুকালীন বয়ান গ্রহণ করার উপযুক্ত কি না। আসল কথা কোন বয়ানটি সত্যি, তা নির্ধারণ করা।
মৃত্যুকালীন বয়ানের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম
কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে মৃত্যুকালীন বয়ান বাতিল হতে পারে:
১। যদি মৃত্যুকালীন বয়ান আক্রান্তের মৃত্যুর কারণের চেয়ে বেশি অন্য কোনও বিষয়ের উপর জোর দেয়, তবে তা প্রমাণ হসাবে বাতিল হয়ে যেতে পারে।
২। যদি আক্রান্ত সাক্ষ্য দেওয়ার অবস্থায় না থাকে, বা মানসিক ভাবে স্থিতিশীল না থাকে, বা বয়ান যদি প্রভাবিত হয় (শিখিয়ে দেওয়া বা পাশ থেকে বলে দেওয়া চলবে না)।
৩। মৃত্যুকালীন বয়ান খারিজ হয়ে যেতে পারে যদি তা মিথ্যে হয়।
৪। অসম্পূর্ণ বয়ান বাতিল হতে পারে।
৫। যদি বয়ান আক্রান্তের নিজের মৃত্যু সংক্রান্ত না হয়ে অন্য কারও মৃত্যু সংক্রান্ত হয় তবে তা বাতিল হতে পারে।
৬। যদি আক্রান্ত অনেকগুলি পরস্পরবিরোধী বয়ান দেন তবে সবগুলির গুরুত্ব কমে যায়।
Next Story