আইন
ভারতে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন: যা জানা প্রয়োজন
২০১৮ সালে থমসন রয়টর্স ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় ভারত মেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ বলে বিবেচিত হয়।
২০১৮ সালে, থমসন রয়টর্স ফাউন্ডেশন (টিআরএফ) পরিচালিত এক সমীক্ষায় ভারতকে মেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ বলে চিহ্নিত করেন মতদাতারা। মেয়েদের বিরুদ্ধে যৌন হিংসার সম্ভাবনা এবং তাদের দাস শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করার প্রথা, এই দুই কারণ ভারতকে প্রথম স্থানে তুলে দেয়।
টিআরএফ-এর ২০১৮ সালের সমীক্ষায়, তাদেরই করা ২০১১ সালের সমীক্ষার ফলাফল আবারও ফুটে ওঠে। ২০১১ সালেও ভারত তালিকার প্রথম ১০টি দেশেরে মধ্যে ছিল। "ভারত মেয়েদের প্রতি চরম উপেক্ষা ও অবমাননা দেখিয়ে চলেছে...ধর্ষণ, দাম্পত্য ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ ও উৎপীড়ন এবং কন্যা ভ্রুণ হত্যা হয়েই চলেছে।" মঞ্জুনাথ গঙ্গাধর নামে কর্নাটকের এক সরকারি অধিকর্তার এই উক্তি উদ্ধৃত করা হয় রিপোর্টে।
গঙ্গাধরের মন্তব্যকে সমর্থন করে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনআরসিবি)প রিসংখ্যান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে ওই সংস্থা অপরাধের তথ্য সংগ্রহ করে ও সেগুলিকে বর্তমান আইনের আলোয় বিশ্লেষণ করে। সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে প্রতি ১৬ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিত হন ও প্রতিদিন ৮৮টি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। ২০১৯ সালে, ৩২,০৩৩ ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল। তার মধ্যে ১১% ঘটনায় অপরাধের শিকার হন পিছিয়ে-থাকা দলিত সম্প্রদায়ের মহিলারা।
উত্তরপ্রদেশের হাথরসে একটি ১৯ বছরের দলিত মেয়েকে গণধর্ষণ করার অভিযোগ দেশের বিবেককে নাড়া দিয়েছে (ময়না তদন্তে বলা হয়েছে মেয়েটির বয়স ২২)। ২০১২ সালে দিল্লি গণধর্ষণের ঘটনা, ২০১৫-য় মুম্বইয়ের গণধর্ষণ, উন্নাওয়ের ধর্ষণ, কাঠুয়া ধর্ষণ কাণ্ড এবং আরও পিছিয়ে গেলে, মথুরা ও ভাঁওরি দেবীর ধর্ষণ হল কয়েকটি মর্মান্তিক উদাহরণ।
ধর্ষণ কি?
আভিধানিক সংজ্ঞায় অবৈধ যৌন মিলন বা সম্মতি ছাড়া, বলপূর্বক বা বলোপ্রয়োগ ছাড়াই, আক্রান্তের যোনি, মলদ্বার বা মুখে যৌনাঙ্গ, শরীরের অন্য কোনও অঙ্গ বা বিজাতীয় বস্তুর প্রবেশকে ধর্ষণ বলা হয়েছে। কিন্তু আইনের ভাষায়, একই বেআইনি কাজের বিভিন্ন মানে আছে।
ধর্ষণ ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (আইপিসি) ১৮৬০ বা ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫–৩৭৭ ধারার আওতায় পড়ে। ওই ধারা অনুযায়ী, ধর্ষণ হয় তখনই যখন কোনও পুরুষ তার লিঙ্গ, মুখ, শরীরের অন্য কোনও অঙ্গ বা অন্য কোনও বস্তু কোনও মহিলার যোনি, মুখ, মলদ্বার বা মূত্রনালীতে প্রবেশ করায় অথবা কোনও মহিলাকে দিয়ে এগুলির মধ্যে যে কোনও একটি কাজ তার বা অন্য কারোর ওপর প্রয়োগ করায়। আর এ সব হতে হয় মহিলার ইচ্ছে ও সম্মতির বিরুদ্ধে; যখন কোনও মহিলা বা তাঁর প্রিয়জন শারীরিক আঘাত বা মৃত্যুর হুমকি অনুভব করেন; যখন কোনও পুরুষ মহিলাটির স্বামী সেজে তাঁর সম্মতি আদায় করে; মহিলা যদি মানসিক ভারসাম্যহীন হন বা যদি তিনি কোনও মাদক দ্রব্যের প্রভাবে থাকেন; যদি তাঁর বয়স ১৬ বছরের কম হয় (১৪ বছরের কম মণিপুরে); এবং স্ত্রীর বয়স ১৫ বছরের কম হয় (১৩ বছর মণিপুরে)।
আইপিসি অনুযায়ী, সম্মতি মানে হল মহিলাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ও স্বেচ্ছায়, কথায়, ইঙ্গিতে, ভাষায় বা ভাষাহীন কোনও ভাবপ্রকাশের মাধ্যমে জানাতে হবে যে তিনি যৌন ক্রিয়ায় অংশ নিতে ইচ্ছুক।
ধর্ষণের শাস্তি
আইপিসির ৩৭৬ নং ধারা অনুযায়ী, ধর্ষণের শাস্তি দু' ভাবে ভাগ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিভাগে অন্তর্ভুক্ত নন এমন কোনও ব্যক্তি যদি ধর্ষণ করে থাকে, তাহলে তার জেলে থাকার মেয়াদ ১০ বছরের কম হবে না। এবং সেই শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে। সেই সঙ্গে হতে পারে জরিমানাও।
দ্বিতীয় বিভাগে যারা পড়বে, তাদের ন্যুনতম সাজা হবে ১০ বছর জেল, এবং তা সারা জীবনের জন্যও (যত দিন সেই অপরাধী বেঁচে থাকবে) হতে পারে তাদের। একই সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে তাদের। এই বিভাগে পড়বে যারা:
• একজন পুলিশ অফিসার যদি তাঁর পুলিশ স্টেশনের এলাকার মধ্যে ধর্ষণ করেন, বা থানার মধ্যে, বা ধর্ষিত মহিলা যদি পুলিশ হাজতে থেকে থাকেন
• একজন সরকারি চাকুরে
• কেন্দ্রীয়/রাজ্য সরকার দ্বারা মোতায়েন করা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য
• যে সব হোম বা কোনও জায়গা যেখানে মহিলা ও শিশুদের সুরক্ষিত রাখার জন্য পাঠানো হয়, সেই সব প্রতিষ্ঠানের ম্যানজমেন্টের সদস্য বা কোনও কর্মী
• কোনও হাসপাতাল কর্মী যদি সে কোনও রোগীকে ধর্ষণ করে
• কোনও আত্মীয়, অবিভাবক, শিক্ষক ও আস্থাভাজন বা কর্তৃত্বের জায়াগায় থাকা কোনও ব্যক্তি যদি তাদের তত্বাবধানে থাকা কাউকে ধর্ষণ করে
• সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠী হিংসার সময় যদি কেউ ধর্ষণ করে
• একজন গর্ভবতী মহিলাকে যে ধর্ষণ করবে
• কেউ যদি একই মহিলাকে বার বার ধর্ষণ করে
• সম্মতি জানাতে অক্ষম এমন কোনও মহিলাকে যদি ধর্ষণ করে কোনও ব্যক্তি
• ক্ষমতাবান কোনও ব্যক্তি যদি ধর্ষণ করে
• মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন এমন কোনও মহিলার ধর্ষণকারী
• ধর্ষণের সময় যদি ধর্ষণকারী মহিলার শারীরিক ক্ষতি করে বা তাঁকে পঙ্গু বা বিকৃত করে দেয় বা তাঁর জীবন সংশয় ঘটায়
অন্যান্য ধারায় ধর্ষণের শাস্তি
অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণের ব্যবহার
যুদ্ধের সময় ধর্ষণকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২০০৮ সলে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ লক্ষ্য করে যে, "মহিলা ও শিশুরা বিশেষ করে যৌন হিংসার শিকার হচ্ছে। এমনকি "যুদ্ধের কৌশল হিসেবেও তা করা হচ্ছে।" এর পরিপ্রেক্ষিতে, পরিষদে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়, যাতে বলা হয় "যুদ্ধরত সব দলকেই অসামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সব রকম যৌন হিংসা বন্ধ করতে হবে।"
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে, জম্মু ও কাশ্মীরে জঙ্গি আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন সেখানকার অসামরিক নাগরিকরা ভারতীয় সেনা বাহিনীর জওয়ানদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগ আনেন। তাঁরা বলেন, কাশ্মীরের প্রত্যন্ত কুপওয়ারা জেলার কুনান ও পোশপোরা গ্রামে সেনারা ৩০ জন মহিলাকে ধর্ষণ করে। ভিত্তিহীন বলে ভারত সরকার অভিযোগটি উড়িয়ে দেয়। কিন্তু ২০১৮ সালে, সেনা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা যৌন নিগ্রহের ঘটনার স্বাধীন তদন্ত না করার অভিযোগ তুলে, রাষ্ট্রসংঘের হাইকমিশন ফর হিউম্যান রাইটস কেন্দ্রীয় সরকারের তীব্র নিন্দা করে।
কুনান-পোশপোরা সহ ১৩টি ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে জম্মু ও কাশ্মীরে যৌন অপরাধের প্রতি "রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা"র বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তাতে আরও বলা হয় যে, "ন্যায়-বিচার পাওয়ার সব চেষ্টা ও পথকে বিভিন্ন স্তরে আটকে দেওয়া হয়েছে।"
২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার একটি তদন্তে, সিটিজেনস ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস দেখে যে, "পরিকল্পিত ভাবে অল্প বয়সী মেয়ে ও মহিলাদের ওপর যৌন হিংসা চালানো হয়"। ওই তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়, "একটি সম্প্রদায়কে অপমান করতে ও বশে রাখতে ধর্ষণকে একটি অস্ত্র হিসেব ব্যবহার করা হয়।" তাতে আরও বলা হয়, "কয়েকটি বাদে, বেশিরভাগ ঘটনাতেই মহিলাদের উলঙ্গ করে হাঁটানো হয়। তারপর গণধর্ষণ করা হয় তাদের। এবং অবশেষে তাদের দেহ চার টুকরো করে এমন ভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয় যে কাউকে আর চেনা যায় না।"
ধর্ষণ আইনের সংস্কার
১৬০ বছর আগেকার আইপিসি ঔপনিবেশিক আইনের ধারা অব্যাহত রেখেছে। আইপিসি-র কিছু খুচর রদবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোনও সংস্কার হয়নি। ২০০০ সালে জাস্টিস মালিমাথ কমিটি অপরাধ বিচারের ধারা সংস্কার করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এর সুপারিশগুলি বাতিল করে দেওয়া হয়।
এখন আরও একটি প্রচেষ্টা চলছে। পাঁচ সদস্যের 'কমিটি ফর ক্রিমিনাল রিফর্মস' গঠন করা হয়েছে যাতে কেবল পুরুষরাই রয়েছেন। কিন্তু মে মাসে গঠিত এই কমিটি ইতিমধ্যেই বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছে। কারণ, বলা হচ্ছে, সেটির গঠনে কোনও বৈচিত্র নেই; নির্দেশের শর্তগুলি জনসাধারণকে জানান হয়নি; কম সময় দেওয়া হয়েছে (ছ' মাসের মেয়াদ ধার্য করা হয়েছে, যা এ মাসেই শেষ হয়ে যা্বে); এবং পদ্ধতিগত ত্রুটি, যেমন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রশ্ন ঠিক করার বদলে কিছু পূর্বনির্ধারিত প্রশ্ন ছ'টি কিস্তিতে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
১৯৭২ সালে মথুরা ধর্ষণ কাণ্ডের পর ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেওয়ার ফলে, ধর্ষণ আইন প্রথম সংশোধন করা হয়। ২৬ মার্চ ১৯৭২ তারিখে, মহারাষ্ট্রের এক আদিবাসী মহিলা কয়েকজন পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁকে গণধর্ষণ করার অভিযোগ করেন। ট্রায়াল কোর্ট পুলিশদের নির্দোষ ঘোষণা করে এবং সেই রায় সুপ্রিম কোর্টও বহাল রাখে। কেবল মাত্র হাইকোর্টেই অভিযুক্ত পুলিশরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। পুলিশরা নিজেদের পক্ষে সওয়াল করার সময় বলে, ওই মহিলা 'লুজ' চরিত্রের। তাছাড়া তার সঙ্গে তার পুরুষ বন্ধু ছিল। তাই তাকে ধর্ষণ করা সম্ভব ছিল না। ১৯৭৮ সালে, উচ্চতম আদালত তার রায়ে বলে, "কোনও ক্ষত চিহ্ন না থাকাটা এটাই ইঙ্গিত করছে যে, অভিযোগে যে যৌন মিলনের কথা বলা হয়েছে, তা শান্তিতেই হয়েছিল।"
১৯৭৮-এর ওই রায়ের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিলে, আইনসভা 'ক্রিমিনাল ল (সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৮৩' প্রণয়ন করে। তাতে বেশ কিছু নতুন ধারা সংযোজন করা হয়। তার মধ্যে একটিতে ধর্ষিতার নাম প্রকাশ করাটা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হয়।
২০১২ সালে, দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ড, মহিলাদের অধিকার ও নিরাপত্তার আন্দোলনে একটি জলবিভাজিকার কাজ করে। তার ফলে 'ক্রিমিনাল ল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০১৩, প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা যেমন আরও বিস্তৃত করা হয়, তেমনই শাস্তিও আরও কড়া করা হয়।
অপরাধ বিচার প্রণালীর সমালোচনা ও ফাঁক
ভারতীয় ধর্ষণ আইনের বৈশিষ্ট্য হল তার লিঙ্গ নিরপেক্ষতার অভাব। আইপিসি অনুযায়ী একজন পুরুষ ধর্ষণের শিকার হতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলাকে কেন্দ্র করে ভারতের আইন কমিশন যৌন মিলনের সংজ্ঞাকে আরও বিস্তৃত করার পরামর্শ দিয়েছে, যাতে তা আরও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ হয়।
২০১৮ সালে, সম্মতির ভিত্তিতে সমকামীদের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে অপরাধ নয় বলে ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। এখন, ধর্ষণকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ করে তোলাটাও জরুরি হয়ে পড়েছে।
Next Story