ভারতের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত নীতি কি আফগান শরণার্থীদের সহায়ক হবে?
আফগান শরণার্থীদের প্রথম ঢেউ ভারতের উপর আছড়ে পড়েছিল ১৯৭৯ সালে সে দেশে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর।
রবিবার তালিবান (Taliban) কাবুলে (Kabul) সরকারের দখল নেওয়ার পর আফগান (Afghans) ও বিদেশিদের সে দেশ ছেড়ে পালানোর অস্বস্তিকর দৃশ্য শরণার্থী (Refugee) সমস্যা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
আফগান সংবাদ-চ্যানেল টোলো নিউজ প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃত করে কাবুল বিমানবন্দরে সামরিক বিমানে চড়তে উদ্যতদের উপর গুলি চালনার খবর দিয়েছে। কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দরে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার প্রেক্ষিতে ভারত সরকার সে দেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
এই সব ঘটনা থেকেই প্রশ্ন উঠছে—আফগানরা যদি সে দেশের সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হয়, তাহলে কী ঘটবে? ভারত কি তাদের আশ্রয় দেবে? ভারতের শরণার্থী নীতি কী?
রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র শাবিয়া মান্টু গত ১৩ অগস্ট জানানঃ "সংঘাতদীর্ণ এই পরিস্থিতির মানবিক বিপর্যয় বিপুল l হিংসা প্রশমিত না হলে আফগানিস্তান এক বছরের মধ্যে এ যাবত্ ঘটা যাবতীয় মৃত্যুর রেকর্ড ছাপিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে l"
"২০২০ সাল পর্যন্ত দেশজুড়ে ইতিপূর্বেই বাস্তুচ্যুত ২৯ লক্ষ আফগান নাগরিকের সঙ্গে চলতি বছরের শুরু থেকে ঘটা সংঘর্ষে আরও ৪ লক্ষ গৃহচ্যুত আফগান যুক্ত হয়েছে"—জানালেন মান্টু।
আফগান-মার্কিন ঔপন্যাসিক খালিদ হোসেইনি টুইট করেছিলেন: "আমেরিকা তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এবং আফগানরা যে দুঃস্বপ্নের ভয় পাচ্ছিল, তা তাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। বিগত ৪০ বছর ধরে যে জাতি শান্তির অন্বেষণ করে চলেছে, আমরা আজ তাদের পরিত্যাগ করতে পারি না। আফগান মহিলাদের আবার তালাবন্ধ দরজা আর পর্দার ঘেরাটোপের পিছনে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। আফগানিস্তানের জন্য প্রার্থনা করুন।"
১৯৫১ সালের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত সম্মেলন এবং ১৯৬৭ সালে বিশ্বের ১৪৮টি দেশের সমর্থনপুষ্ট সেই সম্মেলনের প্রোটোকল উদ্বাস্তুদের স্বার্থরক্ষায় দায়বদ্ধ। সে সময় উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল ১ লক্ষl আজ তা ২ কোটি ৭ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই, প্রায় ৬৮ শতাংশ, ৫টি দেশের—সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান ও মায়ানমার, যে-উদ্বাস্তুদের ৮৬ শতাংশই আবার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে আশ্রয় নিয়েছে।
আরও পড়ুন: লন্ডনের পথনাটিকার ভিডিওকে তালিবান অধিকৃত আফগানিস্তানের দৃশ্য বলা হল
ভারতের উদ্বাস্তু নীতি কী?
ভারত যেহেতু ১৯৫১ সালের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত আম্তর্জাতিক সম্মেলন কিংবা ১৯৬৭ সালের প্রোটোকলে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র নয়, তাই উদ্বাস্তুদের সুরক্ষার জন্য তার কোনও নীতিও নেই। এই শরণার্থীদের ভারত কেবল 'বিদেশি নাগরিক' বলে উল্লেখ করে।
এবার সব ধরনের বিদেশি, উদ্বাস্তু, আশ্রয়প্রার্থী এবং রাষ্ট্রপরিচয়হীন লোককেই ১৯২৬ সালের বিদেশি সংক্রান্ত আইন, ১৯৩৯ সালের বিদেশি নথিকরণ আইন, ১৯২০ সালের পাশপোর্ট আইন এবং ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের অধীনে বিচার করা হয়।
লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই জানিয়েছেন, 'যে সব বিদেশি বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশ করে কিংবা যাদের এ দেশে ঘোরার কাগজপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাদের সকলকেই বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসাবে শনাক্ত করা হয় এবং তদনুয়াযী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়'l
যে সব বিদেশি নাগরিককে সরকার দীর্ঘ কাল এ দেশে থাকার ভিসা কিংবা রেসিডেন্ট পারমিট দেয়, তাদের বিষয়টাও কিছু কাল ছাড়া ছাড়া খতিয়ে দেখা হয়l ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সেই সব বিদেশি নাগরিকদের জন্য একটি নীতিনির্দেশ ঘোষণা করে, যারা নিজেদের উদ্বাস্তু বলে উল্লেখ করেছে। অ্যাডভোকেট ফজল আবদালি জানাচ্ছেন, সেই নীতিনির্দেশগুলি ঠিক কী, তা এখনও পর্যন্ত জনসাধারণকে জানানো হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি ভিসা রয়েছে যেসব বিদেশি নাগরিকের, সরকার তাদের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র হিসাবে পড়াশোনা করার অনুমতি দেয়—জানালেন উদ্বাস্তু অধিকার সংক্রান্ত সংস্থার আধিকারিক আবদালি।
উদ্বাস্তু সংক্রান্ত আইন বিশেষজ্ঞ বি এস চিমনি জানালেন—ভারতে উদ্বাস্তুদের মর্যাদা খুব ধোঁয়াশাচ্ছন্ন l দক্ষিণ এশীয় মানবাধিকার নথিকরণ কেন্দ্রের অধিকর্তা রবি নায়ারের মতে, উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে ভারতের নীতি তখনকার ভূ-রাজনৈতিক অগ্রাধিকার অনুসারে নির্ণীত হয়ে থাকে।
যেমন শ্রীলঙ্কার তামিল শরণার্থী কিংবা তিব্বতি শরণার্থীদের সম্পর্কে ভারত যতটা সহানুভূতিশীল থেকেছে, মায়ানমারে নির্যাতিত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বেলায় ততটাই বিরূপ থেকেছে।
আর পড়ুন: আফগান মহিলাকে তালিবানের মারধরের পুরনো ছবি সাম্প্রতিক বলে ছড়াল
ভারতে কি কোনও শরণার্থীরা আছে?
ভারত উদ্বাস্তুদের কোনও রেকর্ড সংরক্ষণ করে না। রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্বাস্ত বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর -এর হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতে ২ লক্ষ ৪৪ হাজার উদ্বাস্তু ও আশ্রয়প্রার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে ২ লক্ষ ৩ হাজার ২৩৫ জন হচ্ছে শ্রীলঙ্কা ও তিব্বত থেকে আগত, আর ৪০,৮৫৯ জন অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে।
ভারতীয় শ্রম সংস্থার(আইএলও)হিসাব, এ দেশে অন্তত ৫ লক্ষ নেপালি অভিবাসী রয়েছেl আর ২০১৭-র তথ্য বলছে, এ দেশে অন্তত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম রয়েছে, যাদের মধ্যে ১৬,৫০০ জন রাষ্ট্রপুঞ্জের নথিভুক্ত।
ভারতে কি আফগান শরণার্থীরা আছে?
হ্যাঁ, অনেক আফগান শরণার্থীই ভারতে স্থায়ী আস্তানা গেড়েছেl ২০০০ সালে প্রথম বার যখন তালিবান আফগানিস্তান দখল করে,তখনই ভারত বহু আফগানকে আশ্রয় দেয়l রবি নায়ার বুম-কে জানালেন—এঁদের অধিকাংশই হাজারা, তাজিক বা পশতুন সম্প্রদায়ভুক্ত, যারা তালিবান-বিরোধীl
নায়ার বললেন—'আফগান উদ্বাস্তুদের প্রথম ঢেউ আসে ১৯৭৯ সালে কাবুলে সোভিয়েত আগ্রাসনের পরl এদের অধিকাংশই ছিল মধ্যবিত্ত, যাদের বিভিন্ন পেশাগত যোগ্যতা রয়েছেl কিছু কাল পরে তারা পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে চলে যায়'l নায়ার বলেন—'ভারত তালিবান-বিরোধী আফগানদের নানাভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্র-সাহায্যও করেছেl অসামরিক ক্ষেত্রেও আমরা আফগানিস্তানে বেশ কিছু কাজ করেছি—রাস্তা, বাঁধ তৈরি করেছি, চিকিত্সা-পরিকাঠামো বানিয়েছি l এই যোগাযোগের ফলে হয়তো ভারতের গত দু দশকের আফগান নীতি বহাল থাকবে এবং কিছু আফগান শরণার্থীকে আশ্রয়ও দেওয়া হবে'l
নাগরিকত্ব সংশোধন আইন কী এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী?
বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের সপক্ষে বলতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, এর ফলে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে নির্যাতিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপকার হবেl ওই সব দেশের হিন্দু, শিখ জৈন ও বৌদ্ধ সংখ্যালঘুদের স্বতঃসিদ্ধভাবে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার বন্দোবস্তের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে বলে বিতর্ক ও বিরোধিতাও প্রবল হয়l
তবে যদিও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ওই আইন পাশ হয়েছে, তবু কেন্দ্র এ সংক্রান্ত বিধি এখনও তৈরি করেনি, সে জন্য ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় চেয়েছেl
আরও পড়ুন: না, এটি কাবুলে আটকে পড়া ভারতীয়দের ভারতের বায়ুসেনার উদ্ধারের ছবি নয়