একটি মুদ্রাকে দাবি করা হচ্ছে সেটি ১৮৩৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির টাঁকশালে তৈরি দুস্প্রাপ্য মুদ্রা। যার একপিঠে খোদাই ভারতীয় দেবদেবী রাম, সীতা ও লক্ষণ এবং অন্যপিঠে হনুমান যাকে কিনা মুদ্রা বিশেষজ্ঞরা বলেন ‘‘কল্প’’ মুদ্রা।
উপরের ছবিটি হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার এবং ফেসবুকে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হচ্ছে। অনেক ব্যক্তি এটাকে জানা বিষয় বলে জানাচ্ছেন যে- পূর্বেই ব্রিটিশরা এই সব দেবদেবীদের মুদ্রায় খোদাই করে ব্যবহার করার মাধ্যমে স্বীকৃতি জানিয়েছে। যদিও, বুম অনুসন্ধান করে জেনেছে মুদ্রাটি ভুয়ো।
উপরন্তু, অন্যান্য আরও মুদ্রা যেগুলির একপিঠে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্মারক দেওয়া ও অন্যপিঠে বুদ্ধ, সরস্বতী, গণেশ, শিব এবং হনুমানের ধর্মীয় অনুসঙ্গ রয়েছে সেগুলিও ভুয়ো।
বুম জানাতে চায় যে ধর্মীয় অনুসঙ্গের মুদ্রাগুলির অস্তিত্ব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আগে রাজরাজরাদের যুগে ছিল কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হিন্দু দেবদেবীদের মুদ্রাগুলি তৈরি করেছে এই দাবিটি অসত্য।
প্রথম ছবি, যেটিতে রাম, সীতা, লক্ষণ এবং হনুমান রয়েছে সেটি ২০০৯ সালের একটি ব্যক্তিগত ব্লগ পোস্ট থেকে নেওয়া এবং সেটিকে ভুয়ো বলে চিহ্নিত করা যায়।
প্রাচীন মুদ্রা বিশেষজ্ঞদের একটি সূত্র জানাচ্ছে এই ‘কল্প’ মুদ্রাগুলি রামটঙ্কা(গুলি) অথবা ‘মন্দির টোকেন’ এর সংমিশ্রণ। ওই সূত্রটি তার পরিচয় গোপনীয় রাখতে অনুরোধ করেছেন আমাদের।
হিন্দু দেব-দেবী খোদিত বা ধর্মীয় অনুসঙ্গের মন্দিরের টোকেনগুলি স্মারক এবং বাণিজ্যের জন্য নয় বা তার বাণিজ্যিক ব্যবহার আইনত নয়।
মন্দিরের টোকেনগুলির কোনও অর্থমূল্য নেই যা ওইগুলিতে খোদায় করা আছে; না আছে তার ধাতুমূল্য যা দিয়ে ওইগুলি তৈরি।
মুদ্রা বিশেষজ্ঞদের মতে, যদিও দুস্প্রাপ্য ও গুরুত্বপূর্ণ রামটঙ্কা(গুলির) সঠিক মূল্য যাচাই করা কঠিন। কারণ অনেক আধুনিক টঙ্কাগুলি ভুয়ো তারিখে তৈরি করা হয় মূল্যবান সংগ্রহ বলে।
কল্প মন্দির টঙ্কাগুলি যেখানে সেখানে ২০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি হয় যেমনটা অনলাইন সাইট ইবে-তে বিক্রি হয়।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া(আরবিআই)-র মূল্য মিউজিয়াম ভারতের মুদ্রার এক বর্ণময় ইতিহাস তুলে ধরে। সারা বিশ্বে অতীতে মুদ্রা প্রচলনকারী দেশ গুলির মধ্যে ভারত অন্যতম। হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি দেশই লেখা, খোদাই, আকার, ধাতু, টাঁকাশালীয় পদ্ধতি এমনকি মুদ্রা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিচিত্রতার নিরিখে ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।
আরবিআই-এর ওয়েবসাইটটির নীচের স্ক্রিনশটটিতে দেখা যায় প্রথমে জাঁকিয়ে বসা ইংরেজদের আগের মুদ্রাগুলিও আদেও উপরের মুদ্রাগুলির সঙ্গে মেলে না।
নীচের ছবিটিও আরবিআই-এর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। যেটি দেখায় ইংরেজদের তৈরি মুদ্রাগুলি ছিল ইংরেজদের বিশেষ ধরনের।
আমরা আরবিআই-এর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য থেকে নীচের তালিকাগুলি তৈরি করলাম যা প্রমাণ করে, যে মুদ্রাগুলিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিহ্ন ও দেব-দেবী খোদাই করা আছে সেগুলি ভুয়ো।
১. ইংরেজরা প্রথমদিকে যে মুদ্রাগুলি প্রচলন করেছিল সেগুলি ছিল মুঘলীয় ধরনের। জাঁকিয়ে বসা ইংরেজরা প্রথমে ছিল তিনটি বড় গোষ্ঠীতে: পশ্চিম ভারত (বোম্বে ও সুরাট), দক্ষিণ ভারত (মাদ্রাজ) এবং যারা ছিল পূর্ব প্রদেশ বাংলাতে (ক্যালকাটা)
‘‘বাংলার মুদ্রাগুলি তৈরি করা হয়েছিল মুঘল ধাঁচে, মাদ্রাজের গুলো মুঘল ধাঁচের পাশাপাশি দক্ষিনীয় কায়দার নক্সা ও পরিমাপণে (প্যাগোডা) সীমাবদ্ধ ছিল। পশ্চিম ভারতের ইংরেজি মুদ্রাগুলি মুঘল ও ইংরেজি ধাঁচে।’’
২. ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ফারুখশিয়ার শুধুমাত্র বম্বে টাঁকশালে ইংরেজদের মুঘল মুদ্রার তৈরির অনুমতি দিয়েছিলেন। ইরেজদের ধরনে মুদ্রাগুলি তৈরি হয়েছিল বোম্বে টাঁকশালে। স্বর্ণমুদ্রাগুলি ‘কেরোলিনা’, রৌপ্যমুদ্রাগুলি ‘আংলিনা’, তাম্রমুদ্রাগুলি ‘কুপারুন’ ও টিনের মুদ্রাগুলি ‘টিনি’ নামকরণ করা হয়েছিল।
৩. ১৮৩৫ সালে নতুন নক্সার মুদ্রাতে চতুর্থ উইলিয়ামের (উপরের ছবি) অবয়ব খোদাই করা হয়েছিল একপিঠে। অন্য পিঠে ইংরেজি ও পার্সীতে মুদ্রার মুল্য। ১৮৪০ সালের পর চালু করা মুদ্রায় ছিল মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ছবি। ১৮৬২ সালে প্রথম মুকুটের মুদ্রা এবং ধারণা করা হয় ১৮৭৭ সালে চালু করা হয় রাণী ভিক্টোরিয়াকে ভারত সম্রাজ্ঞী অভিধায়।
সূত্র:
কুলরাজ সিংয়ের মুদ্রা সম্পর্কে ব্লগ পোস্ট- https://kulraj-the-numismatist.blogspot.in/2009/02/east-india-company-coins.html
কল্প মন্দির টোকেন বিক্রির ইবে লিঙ্ক https://www.ebay.in/dsc/sis.html?_kw=1839+AD+Copper+Coin+Temple+Token+EAST+INDIA+COMPANY
আরবিআই-এর মুদ্রা মিউজিয়ামের ওয়াবসাইটের পেজগুলি
ব্রিটিশ ইন্ডিয়া মুদ্রা https://www.rbi.org.in/currency/museum/c-brit.html
প্রথমদিকে চালু ব্রিটিশ ইন্ডিয়া মুদ্রা https://www.rbi.org.in/currency/museum/cc-EIC.html
চতুর্থ উইলিয়ামের মুদ্রাগুলি https://www.rbi.org.in/currency/museum/cc-William.html