ট্রাকে গরু পাচারকারীদের হাতেই কি খুন হল বেলগামের বাসিন্দা ১৯ বছরের শিবু উপ্পার? সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া পোস্টের দাবি, খুন হয়েছে শিবু। জেলা পুলিশ যদিও বুমকে জানিয়েছে, এই কিশোর আত্মহত্যা করেছে, এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যে পোস্টগুলি ঘুরছে, সেগুলো "ভুয়ো এবং ক্ষতিকর মিথ্যা।"
উপ্পারের মৃত্যু নিয়ে মিথ্যে মেসেজ ছড়ানোর অভিযোগে দু'জনকে গ্রেফতারও করেছে বেলগাম জেলা পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। বেলগাম শহরের পুলিশ কমিশনার বুম-কে জানিয়েছেন যে এই কিশোরের ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও খুনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং স্পষ্ট ভাবে জানানো হয়েছে যে এটি আত্মহত্যার ঘটনা।
ফেসবুক ও টুইটারে যে মেসেজটি শেয়ার করা হচ্ছে, তার মূল বক্তব্য, গরু পাচারকারীরা খুন করেছে শিবু উপ্পারকে, এবং এখন সেই ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানো হচ্ছে। পোস্টটির সঙ্গে তিনটি ছবিও শেয়ার করা হচ্ছে। তার মধ্যে দুটি ছবি ভয়াবহ, যাতে দেখা যাচ্ছে, শিবু উপ্পারের দেহটি শৌচাগারের ছাদ থেকে ঝুলছে।
বুম উপ্পারের ফেসবুক প্রোফাইলটি খুঁটিয়ে দেখেছে। দেখা গিয়েছে, সে নিয়মিত গোরক্ষার পক্ষে পোস্ট শেয়ার করত। তার প্রোফাইলের একটি কভার ফটোয় দেখা যাচ্ছে, শিবু একটি গরুর ছবি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার ফেসবুক বায়োতেও লেখা, "জয় গোমাতা"। ২১ মে তারিখে উপ্পার নিউজ১৮ কান্নাডার একটি ভিডিয়ো শেয়ার করে, যাতে দেখা যাচ্ছে, রিপোর্টাররা কিছু ট্রাককে ধাওয়া করছেন। বলা হচ্ছে, এই ট্রাকগুলিতে অবৈধ ভাবে গরু পাচার করা হচ্ছে।
বিভিন্ন ক্যাপশনের সঙ্গে ফেসবুকে ছবিগুলি শেয়ার করা হচ্ছে, যাতে দাবি করা হচ্ছে যে উপ্পার খুনই হয়েছে। ছবিগুলি যেহেতু বীভৎস, তাই এখানে সেগুলি দেওয়া হল না।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, 'জাতীয়তাবাদী হিন্দু' এই কিশোর গরু রক্ষা করতে গিয়ে খুন হয়েছে, এবং মিডিয়া সে বিষয়ে চুপ করে আছে। অপরাধীদের গ্রেফতার করার এবং সুবিচারের দাবি জানানো হয়েছে পোস্টগুলিতে।
এই কিশোরের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারতীয় জনতা পার্টির বেশ কিছু রাজনীতিক সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধে নেমেছেন। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমরাস্বামীকে ট্যাগ করে তাঁরা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। অনেকেই টুইটে #JusticeForShivuUppar হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছেন। এটি এখন ট্যুইটারে ট্রেন্ডিং।
উডুপি-চিকমাঙ্গালুরু থেকে সদ্য-নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ শোভা কারান্ডলাজেও এই ঘটনাটিকে নিয়ে ট্যুইট করেছেন। তিনি লিখেছেন, "১৯ বছরের কিশোর শিবু উপ্পারকে খুন করে বেলগামের বাগেওয়াড়ি বাসস্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। গরু পাচারকারীদের হাত থেকে গরুগুলিকে রক্ষা করার চেষ্টা করাতেই তাকে খুন হতে হল। এটাই তার একমাত্র ভুল ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার দাবি, কঠোর হাতে ঘটনাটির বিচার করুন, অপরাধীদের গ্রেফতার করুন।"
পোস্টটি দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন এবং পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
হিন্দি ক্যাপশনের সঙ্গেও পোস্টটি শেয়ার করা হয়েছে। তাতে যা লেখা হয়েছে, তা অনুবাদ করলে মোটামুটি এই রকম দাঁড়ায়: "কর্নাটকে বেলগাভির গোরক্ষক শিবু উপ্পার মাত্র ১৯ বছর বয়সে নিজের জীবন বলি দিল, গোরক্ষার কাজে।
তার কাছে যখন খবর এল যে কেরল থেকে ট্রাক বোঝাই করে গরু আসছে, এই সাহসী কিশোরটি একাই সেই ট্রাকের পিছনে ধাওয়া করেছিল। কিন্তু, গরু পাচারকারীরা তাকে বেলাগাভির বেগাওয়াড়ি বাসস্ট্যান্ডের কাছে খুন করে এবং দেহটিকে ঝুলিয়ে দেয়। শিবুর মতো সাহসী হিন্দুদের নিয়ে আমরা গর্বিত, যারা ধর্মের জন্য নিজেদের জীবন বলি দেয়। আন্তরিক সমবেদনা।"
তথ্য যাচাই
বুম বেলগামের পুলিশ কমিশনার বি এস লোকেশ কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান যে উপ্পার খুন হয়নি, আত্মহত্যা করেছে।
তিনি আরও বলেন যে উপ্পার কর্নাটকের গোকাক জেলার বাসিন্দা। তার দেহটি পাওয়া গিয়েছে বেলগামের এপিএমসি চত্বরে।
"এই কিশোর একটি আইটিআই কলেজে পড়ত। কিন্তু গত কয়েক মাস সে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। লেখাপড়া না করা এবং লক্ষ্যহীন ভাবে সময় নষ্ট করার জন্য তার বাবা স্বভাবতই তাকে বকাঝকা করতেন। এ রকমই এক দিন বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে সে বাড়ি ছেড়ে বেলগামে চলে আসে, এক বন্ধুর সঙ্গে থাকবে বলে। শনিবার রাত্রে বাবার সঙ্গে তার আরও এক দফা ঝামেলা হয় এবং সে এপিএমসি বাজার চত্বরে গিয়ে একটি শৌচাগারে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়," জানিয়েছেন কুমার। তিনি বলেন, এই আত্মহত্যা নিতান্তই ব্যক্তিগত কারণে, এবং আত্মঘাতী কিশোরের বাড়ির লোকও পুলিশকে সে কথা জানিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, এই কিশোরের দেহে কোনও ক্ষতচিহ্ন পাওয়া যায়নি, এবং বেলগাম পুলিশ যে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেয়েছে, তাতেও ঘটনাটিকে আত্মহত্যা হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে। "পোর্টমর্টেম রিপোর্টে যা বলা হয়েছে, আমি সেটাই বলছি— 'এটি স্পষ্টতই আত্মহত্যার ঘটনা। আক্রমণ বা খুনের ঘটনা হলে যেমন আঘাতের চিহ্ন থাকা স্বাভাবিক, দেহে কোথাও সে রকম কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই," কুমার বুমকে জানিয়েছেন।
ইতিমধ্যে বেলগাম জেলা পুলিশের আওতায় থাকা গোকাক পুলিশ উপ্পারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে মিথ্যে খবর রটানোর অভিযোগে দু'জনকে গ্রেফতার করেছে।
ডিস্ট্রিক্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ, প্রভু ডি টি, বুমকে জানান যে উপ্পার আত্মঘাতী হয়নি, বরং গরু পাচারকারীদের হাতে খুন হয়েছে, এই মর্মে কিছু পোস্ট পুলিশ ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপে খুঁজে পায়। তিনি জানান, "পোস্টটিতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বার্তা ছিল এবং দাবি করা হয়েছিল যে গরুর চোরাপাচার ঠেকাতে গিয়েই উপ্পার খুন হয়। আমরা তদন্ত করে দেখি। উপ্পারের পরিবারের সঙ্গেও কথা বলি। তাঁরা জানান, এই রকম দাবির কোনও সারবত্তা নেই।" তিনি আরও বলেন, "আমরা তথন অনুসন্ধান করে দেখতে পাই, এই বার্তাটি ছড়িয়ে পড়ার পিছনে আছে গোকাকের দুই বাসিন্দা অর্জুন বাসারাগি আর ফক্কিরাপ্পা তালাওয়ার— তারাই ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপে বার্তাটি শেয়ার করতে শুরু করে।"
বাসাগারি আর তালাওয়ারকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা রজু করা হয়েছে।
সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশে এক মহিলাসহ তিন জনকে গোমাংস বহন করার অভিযোগে হেনস্থা করায় পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিওনি পুলিশ প্রথমে হেনস্থা হওয়া তিন জনকেই গ্রেফতার করে। সন্দেহ করা হয়েছিল, তারা সত্যিই গোমাংস বহন করছে। কিন্তু পরে যখন ঘটনাটির ভিডিয়ো ভাইরাল হয়, তখন পুলিশ পাঁচ স্বঘোষিত গোরক্ষককে এই তিন জনকে আক্রমণ করার অভিযোগে গ্রেফতার করে।