পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া শহরে জোম্যাটোর পরিষেবা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে তার এক্সিকিউটিভদের ধর্মঘটে, যারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গ্রাহকদের গোমাংস বা শূকর-মাংসের খাবার সরবরাহ করতে বাধ্য হওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছে ।
১১ অগস্ট জাতীয় গণমাধ্যমগুলিতে এই প্রতিবাদী ধর্মঘটের খবর ছাপা হয় । তবে বুম দেখেছে, এই প্রতিবাদীদের সঙ্গে বিজেপির সংযোগ রয়েছে । সংবাদ প্রতিবেদনগুলিতে কেবল এক্সিকিউটিভদের গোমাংস বা শূকর-মাংস ডেলিভারিতে আপত্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে । কিন্তু এ ছাড়াও বাড়ি-বাড়ি সরবরাহকারীদের কমিশন ছাঁটাইয়ের মতো ধর্মঘটের একাধিক কারণ রয়েছে, যেগুলির উপর তারা আলোকপাত করা হয়নি ।
প্রতিবাদের বিজেপি সংযোগ
বুম হাওড়ায় জোম্যাটো প্রতিবাদ এই শব্দগুলি বসিয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছে, প্রতিবাদের বেশ কিছু জ্যান্ত ভিডিও তোলা হয়েছে, যেগুলির মধ্যে কোনও-কোনওটি জনৈক সঞ্জীবকুমার শুক্লা শনিবারই সম্প্রচার করেছেন ।
শুক্লার প্রোফাইল ঘেঁটে আমরা দেখলাম, তিনি ওই প্রতিবাদগুলিতে অংশগ্রহণও করেছেন এবং প্রতিবাদের খবর সংগ্রহে আসা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলছেন । শুক্লার ফেসবুক বায়ো জানাচ্ছে, তিনি বিজেপির সদস্য-সংগ্রহ কর্মসূচির ভারপ্রাপ্ত এবং উত্তর হাওড়া ২ নম্বর মণ্ডলের সচিব ।
বুম সঞ্জীবকুমার শুক্লার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দাবি করেন, এই প্রতিবাদ ধর্মঘটীদের ধর্মীয় আবেগ ও স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে । যখন তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি জোম্যাটোর ডেলিভারি এক্সিকিউটিভ কিংবা কর্মচারী কিনা, তিনি জানান যে তা তিনি নন ।
শুক্লার মতে, “ধর্মঘট চলার কারণ হল ডেলিভারি এক্সিকিউটিভদের ধর্মীয় আবেগ নিয়ে জোম্যাটো কর্তৃপক্ষের ছেলেখেলা । কর্তৃপক্ষ মনে করে খাদ্যের কোনও ধর্ম হয় না । কিন্তু আমাদের অনেকেই ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এবং আমাদের শাস্ত্রে যা নিষিদ্ধ, তা খাওয়া বা এমনকী স্পর্শ করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়” ।
একটি বিবৃতিতে জোম্যাটো জানিয়েছে, “ভারতের মতো একটি বহুবিচিত্র দেশে নিরামিষ ও আমিষ খাবারকে পরিষেবার কাঠামোয় আলাদা করে বিভাজিত করা অসম্ভব । যাঁরা খাবার সরবরাহের দায়িত্বে যোগ দেন, তাঁদের প্রথম থেকেই সেটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া হয় । সব জেনে-বুঝেই তাঁরা ডেলিভারির কাজে যোগ দেন” ।
সংশোধিত কমিশনের হার নিয়ে ডেলিভারি এক্সিকিউটিভদের অসন্তোষ
কর্মচারীদের কাছে এক ই-মেল বার্তায় জোম্যাটোর প্রতিষ্ঠাতা দীপিন্দর গোয়েল তাঁদের ধর্মীয় আবেগ এবং ব্যক্তিগত খাদ্যাভ্যাস নিয়ে অপপ্রচার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন । তাঁর মতে, “এই প্রতিবাদ মুষ্টিমেয় কয়েকজন ডেলিভারি অংশীদারের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং তাও কেবলমাত্র হাওড়া শহরের একাংশে, মোটেই গোটা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জুড়ে নয়, যেমনটা নাকি রঙ চড়িয়ে প্রচার করা হচ্ছে । আসল বিষয়টা হল, কমিশনের হারে সংশোধন নিয়ে অসন্তোষ, যা আমরা প্রায়শই করে থাকি” । এ ব্যাপারে আরও পড়ুন এখানে ।
গোয়েল তাঁর ই-মেল বার্তায় যা বলেছেন, শুক্লাও বুম-এর সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে তা স্বীকার করেছেনঃ “আগে আমাদের খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য রেট ছিল মোটরসাইকেলে গেলে ২৫ টাকা আর সাইকেলে গেলে ২০ টাকা । এখন সাইকেলে খাবার দিয়ে এলে সেটা কমিয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছে । জ্বালানির যা দাম, সবাই তো মোটরবাইক কিনতে পারে না, অধিকাংশ সরবরাহকারী সাইকেলই ব্যবহার করে । তাতে পড়তায় পোষায় না”
শুক্লার আরও অভিযোগ, গোমাংসের বিভিন্ন পদ রান্নার জন্য বিখ্যাত হাওড়ার বেলিলিয়াস রোডের নিউ রিয়্যাল হোটেলের সঙ্গে জোম্যাটো সম্প্রতি এক চুক্তি করেছে । “আমাদের বেশ কিছু হিন্দু ডেলিভারি এক্সিকিউটিভকে ওই হোটেল থেকে গোমাংসের পদ সংগ্রহ করে সরবরাহ করতে বলা হয় । তাঁরা তাতে আপত্তি জানান” ।
একই ভাবে, শুক্লার মতে, মুসলিম ডেলিভারি এক্সিকিউটিভদের একটি পিত্জা হাট আউটলেট থেকে শুয়োরের মাংসের খাবার ডেলিভারি করতে বলা হয়, যেটা তাঁদের ধর্মীয় সংস্কারকে আঘাত করে ।
বিজেপি কার্যকর্তার অংশগ্রহণ একটি সমাপতন মাত্র
শুক্লাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, “জোম্যাটোর অধিকাংশ ডেলিভারি এক্সিকিউটিভই বিজেপির সমর্থক । অফিসের কাজের শেষে তাঁদের অনেকেই দলের হয়ে কাজ করেন” ।
এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন—“জোম্যাটোয় যারা প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তাদর বিজেপি সমর্থক হওয়াটা একটা সমাপতন মাত্র । তাদের যদি গোমাংস সরবরাহ করতে বলা হয়, তবে তার প্রতিবাদ করার অধিকার তাদের অবশ্যই আছে । ডেলিভারি এক্সিকিউটিভদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করা জোম্যাটোর পক্ষে অন্যায় । তাদের অবিলম্বে বিষয়টির নিষ্পত্তি করা উচিত এবং হিন্দু বাহকদের গোমাংস বহন বন্ধ করা উচিত” ।
আরও পড়ুনঃ হরিয়ানার ভুয়ো জোম্যাটো সাইবার জালিয়াতি মামলা ভুয়ো দাবি নিয়ে ভাইরাল হয়েছে
ডেলিভারি বাহক বিতর্ক নিয়ে জোম্যাটো প্রতিষ্ঠাতার টুইট বিকৃত করে ভাইরাল হয়েছে
গোমাংস এবং শূকর মাংসঃ হিমশৈলের চূড়া মাত্র
“আমরা যদি খাবার পৌঁছে না দিই, তাহলে ওরা আমাদের কমিশন বন্ধ করে দেয় এবং আমাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেয় । আমাদের কাজটা ঝুঁকির, তাই দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা তার ক্ষতিপূরণ চাই । আমরা প্রভিডেন্ট ফান্ডেরও সুবিধে চাই । আমরা কেবল কমিশনে কাজ করি, কোনও স্থায়ী বেতন নেই, আমরা চাই জোম্যাটোর স্থায়ী কর্মচারী হতে” – বললেন শুক্লা ।
উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে জোম্যাটোর ডেলিভারি স্টাফদের একটি আন্দোলনের ভিডিওতেও একই দাবিদাওয়া শোনা গেছেঃ
প্রতিবাদের প্রেক্ষাপট
গত মাসে একজন গ্রাহক টুইটারে অভিযোগ জানান, জোম্যাটো তাঁর খাবার একজন মুসলিম ডেলিভারি এক্সিকিউটিভকে দিয়ে পাঠানোর প্রতিবাদে তিনি খাবারের বরাত খারিজ করে দেন । ওই গ্রাহক অমিত শুক্লা অভিযোগ করেন, যেহেতু এটা শ্রাবণ মাস এবং হিন্দুদের পক্ষে পবিত্র, তাই তিনি একজন হিন্দু ডেলিভারি বয়ের কাছ থেকে খাবার পেতে চেয়েছিলেন । বিষয়টা নিয়ে যখন জল ঘোলা হতে শুরু করে, তখন জোম্যাটো জানায়—খাবারের কোনও ধর্ম হয় না ।