'জন্ম যায় জন্ম যাবে'
সোমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম শিয়ালদা স্টেশনের অদূরে মির্জাপুর স্ট্রিটে যার বর্তমান নাম সূর্য সেন স্ট্রীট। প্রথম দশ বছর অবশ্য কেটেছিল নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। সে সময় ওই শহরের জনসংখ্যা ছিল পঁয়ত্রিশ হাজার। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় খ্যাত শহরে শখের একটি নাট্যদলের সক্রিয় সভাপতি ছিলেন সৌমিত্রের দাদু। ছোটবেলায় বাবার খাতায় সুভাষ চন্দ্র বসুর অটোগ্রাফ দেখে তাঁর ভিতর কেঁপে উঠত। ২০১৭ সালে এমনই স্মৃতিচারণ করেছিলেন একটি বাংলা দৈনিকে।
'মধ্যরাতের সংকেত'
হাওড়া জিলা স্কুল ছেড়ে সিটি কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করেন তিনি। বাংলার থিয়েটারে হাতে খড়ি অহীন্দ্র চৌধুরির তত্ত্বাবধানে।
সৌমিত্র কর্মজীবনের সূচনায় ছিলেন আকাশবাণী কলকাতার উপস্থাপক। কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'নীলাচলে মহাপ্রভু'-র স্ক্রিন টেস্টে ডাঁহা ফেল করেন তিনি।
তার দু'বছর পর সত্যিজিৎ রায়ের সুনজরে আসেন সৌমিত্র। তারপর ফিরে তাকাতে হয়নি আর। অপু ট্রিলজি, হীরক রাজার দেশে, চারুলতা, অরণ্যের দিনরাত্রি, বড় ও ছোটদের সিনামায় অভিনয় করেছেন অপূর্ব দক্ষতায়। সব বাঙালির আশৈশব প্রিয় ফেলুদা কিংবা হীরক রাজ্যের উদয়ন পন্ডিত তিনি যেন সততা, ন্যায়, মূল্যবোধ ও রাজনীতির পাঠ দিয়ে গিয়েছেন সারা জীবনের কাজে।
'স্বেচ্ছাবন্দি আশা কুহকে'
''মানিকদার সঙ্গে'' বইয়ে উজাড় করে লিখেছেন তাঁর ফিল্ম গুরু সত্যজিৎ রায়ের কথা। পরে তা ইংরেজিতে অনূদিত হয় ''দ্য মাস্টার অ্যান্ড আই'' নামে। সত্যজিতের পুত্রপ্রতিম নায়ক ছিলেন তিনি। সত্যজিতের নির্দেশনাতেই অভিনয় করেছিলেন ১৪ টি চলচ্চিত্রে। তিনি ছিলেন চরিত্র অভিনেতার নায়ক।
সৌমিত্র-কে নির্মিয়মান তথ্যচিত্রেরই কাজ করছিলেন অভিনেতা। এর মধ্যেই করোনা আক্রান্ত হয়ে ৬ অক্টোবর বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি হন অশীতিপর অভিনেতা।
'হায় চিরজল'
২০১৮ সালে লিজিয়ন অফ দ্য অনার ও ফরাসি সরকারে সংস্কৃতি মন্ত্রকের বিশেষ পুরস্কার, ২০১২ সালে দাদা সাহেব ফালকে ও সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি। ১৯৯১ সালের অন্তর্ধানের জন্য জাতীয় পুরস্কার, ২০০০ সালে আবার জাতীয় পুরস্কার (দেখা), ২০০৬ সালে আবার পদক্ষেপের জন্য জাতীয় পুরস্কার। ফিল্ম ফেয়ার পেয়েছেন ১৯৮৩, ৯৪ এবং ২০১৩ ও ২০১৭ সালে।
'হে সায়ংকাল'
সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ১০ জন ছাড়াও ছ'জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছিলেন। স্নায়বিক ও কোমর্বিডিটির একাধিক বিষয়ে সুরাহার জন্য নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ। আগের বছর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে সাবধানী ছিলেন চিকিৎসকরা। তবুও শেষ রক্ষা হল না।
বৃহঃস্পতিবার ৮ অক্টোবর করোনা সংক্রমণ ধরা পরলে বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বর্ষিয়ান অভিনেতাকে। শুক্রবার ৯ অক্টোবর থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে দ্বিতীয় বার প্লাজমা থেরাপির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে সৌমিত্রর সামান্য অবস্থার উন্নতি লক্ষ করা যায়।
প্রথমে বাইপ্যাপ ভেন্টিলেশনে রাখা হলেও পরে সম্পূর্ণ যন্ত্র নির্ভর ইনভেসিভ ভেন্টিলেটরে রাখা হয়। ১২ অক্টোবর হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয় অভিনেতার প্রস্টেট ক্যানসারের অসুস্থতার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে। করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে পরে।
নতুন করে কিডনিজনিত সমস্যা শুরু হয়। একাধিক কোমর্বিডিটি জনিত সমস্যার পাশাপাশি শুরু হয় ইন্টার্নাল ব্লিডিং। অস্ত্রোপচার করা হয় শ্বাসনালীতে। গত ৩০ ঘণ্টায় নিথর হয়ে রয়েছেন তিনি, শনিবারের রাতের বুলেটিনে অশনি সংকেত জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রবিবার দুু'পুরে সওয়া ১২ টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সৌমিত্র। কন্যা পৌলমী বসু ফেসবুকে তাঁর 'বাপি'-কে চিরবিদায়ের কথা জানান।
'অন্তমিল'
সত্যজিৎ রায় প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার নরওয়ের হেনরিক জোহান ইবসেনের ''এ্যান এনিমি অফ দ্যা পিপল'' অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৯ সালে তৈরি করেছিলেন 'গণশত্রু'। ভুবনপল্লীর জল খেয়ে গণহারে জলবাহিত রোগ, জন্ডিস ইত্যাদির কারণে অসুস্থতা। তা প্রথমে ধরেন যুক্তিমনস্ক ডাক্তার অশোক গুপ্ত রূপী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। স্বর্গরাজ্য ভাবা চন্ডীপুরের জলের দূষণ বোঝাতে রাত দিন উদ্বিগ্ন সৌমিত্রের রিলে চরিত্র। এসব নিয়েই সমগ্র স্ক্রিনজুড়ে নৈতিকতা ও সামাজিক মুনাফার বিরুদ্ধে লড়তে চাওয়া ডাক্তার অশোক রূপী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন ইবসেনের বাঙালি চরিত্রভিনেতা।
১৯৮৯ সালে 'গণশত্রু'র প্রগতিশীল শিল্পসৃষ্টি যেন সচল বিজ্ঞান হয়ে ওঠে ২০২০ সালের এই করোনা-জরাগ্রস্ত এই পৃথিবীতে। অক্টোবর মাসেই হেপাটাইসিস সি আবিস্কারক হিসেবে নোবেল পেলেন হার্ভে জে অল্টার, চার্লস এম রাইস ও মাইকেল হাউটন।
সত্যজিতের গণশত্রু সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেন আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন একক সংগ্রামের কথা।
''না হাসপাতাল নিয়ে তো কোনও গোলমাল নেই। গোলমাল এই ব্যারামগুলোকে নিয়ে।'' গণশত্রুর চিরকালীন সংলাপে যেন ৮৬ বছরে থামলেন তিনি।
পুনঃশ্চ:
সৌমিত্রের হাতে নাটক সমগ্র রয়েছে দুটি। 'অগ্রপথিকেরা' তাঁর অগ্রজ ও পৃথিবীতে না থাকা বন্ধুদের নিয়ে স্মৃতিকথা। 'প্রতিদিন তব গাথা' সৌমিত্রের রবীন্দ্রভাবনা ও দর্শনের সংকলন। 'পরিচয়' তাঁর উপজীবনী গ্রন্থনা। 'চরিত্রের সন্ধানে' তার রিল ও বাস্তব জীবনের নিজেকে আবিষ্কারের প্রয়াস ফুটে উঠেছে।
লেখায় ব্যবহৃত উপশিরোনামগুলি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রকাশিত বিভিন্ন বাংলা কবিতার বইয়ের নামানুসারে। শুধু অভিনয় শিল্প নয় কাব্যেও ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। বন্ধু নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে মিলে 'এক্ষণ' নামে একটি অতি উচ্চমানের পত্রিকা সম্পাদনা করতেন সৌমিত্র।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দৃপ্তকন্ঠী আবৃত্তিকারও নন কি!