১৫ মার্চ, ২০২৩ ভারতের বেশ কয়েকটি মূল ধারার সংবাদমাধ্যম নরওয়ের নোবেল কমিটির যুগ্ম নেতা অ্যাসলে টোজে-কে (Asle Toje) উদ্ধৃত করে খবর করে, তিনি নাকি বলেছেন, নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার (Nobel Peace Prize) পাওয়ার সবচেয়ে বড় দাবিদার।
বুম যাচাই করে দেখে এই খবরটি সম্পূর্ণ ভুয়ো এবং মোদী সম্পর্কে টোজের বক্তব্যের ভুল উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। এ কথা ঠিক যে টোজে মোদীর নেতৃত্বের এবং বিশ্বে শান্তি বজায় রাখায় তাঁর ভূমিকার প্রশংসা করেন, কিন্তু তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনা বিষয়ে প্রশ্ন করলে টোজে জানান, “আমি আশা করি প্রতিটি জাতির প্রত্যেক নেতাই নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত ক্রিয়াকর্ম করতে অনুপ্রাণিত হবেন।”
তা ছাড়া, নরওয়ের নোবেল কমিটির একজন সদস্য হয়ে টোজের পক্ষে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলা কিংবা তাঁদের পুরস্কার জয়ের সম্ভাবনা বিষয়ে মত প্রকাশ করা সম্ভবও নয়।
আসলে ১৪ মার্চ টোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন শান্তি এবং বিকল্প উন্নয়নের মডেল বিষয়ে এক আলোচনাচক্রে যোগ দিতে। নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে আয়োজিত ওই আলোচনাচক্রে টোজে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বশান্তির সম্ভাবনা বিষয়ে বক্তব্য পেশ করেন। বক্তৃতার পর টোজে বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে ভারতের সহযোগী ভূমিকা সম্পর্কে মিডিয়ার সঙ্গে দু-চার কথা বলেন।
আর সেই সব কথার ভিত্তিতে কয়েকটি অত্যুৎসাহী ভারতীয় সংবাদমাধ্যম উত্তেজিত হয়ে প্রচার করতে থাকে যে টোজে নাকি প্রধানমন্ত্রী মোদীকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের সম্ভাব্য প্রাপকের তালিকার শীর্ষে বসিয়েছেন!
টাইমস নাউ টোজের সাক্ষাৎকারের একটি ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশন দেয়, “প্রধানমন্ত্রী মোদী নোবেল শান্তি পুরস্কারের বৃহত্তম দাবিদার, বলছেন নোবেল পুরস্কার কমিটির উপ-নেতা অ্যাসলে টোজে!”
পরে অবশ্য টুইটটিকে ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে। আর্কাইভ টুইটটি দেখুন এখানে।
টাইমস নাউ-এর প্রধান সম্পাদক রাহুল শিবশংকরও তাঁর নিজস্ব টুইটে এই বক্তব্যই হুবহু উদ্ধৃত করেছেন, ওই টুইটটি দেখা যাবে এখানে।
একই উদ্ধৃতিটি ইকনমিক টাইমস, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ওড়িশা টিভি, লোকমত হিন্দি, এবিপি লাইভ, জাগরণ ইংলিশ, মিন্ট, সিএনবিসি টিভি-১৮, থেকে ইন্ডিয়া টুডে-র টেলিভিশনের উপস্থাপক গৌরব সাবন্ত, দক্ষিণপন্থী অপইন্ডিয়া এবং মেঘ আপডেটস সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
বুম রাহুল শিবশংকরকে তাঁর টুইটের ব্যাখ্যা চেয়ে এবং টাইমস নাউ-তে ভুয়ো দাবি ছড়ানোর কারণ জানতে চেয়ে মেইল করেছে। তাদের উত্তর পাওয়া গেলে এই প্রতিবেদন সংস্করণ করা হবে।
তথ্য যাচাই
বুম অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মঙ্গলবার আয়োজিত অনুষ্ঠানটির ভিডিও পরীক্ষা করে দেখেছে। সেখানের কোথাও অ্যাসলে টোজের বক্তৃতায় কিংবা প্রশ্নোত্তর পর্বে একটি শব্দও তিনি উচ্চারণ করেননি, যাতে নরেন্দ্র মোদীর নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে।
একই সঙ্গে আমরা টোজের সবকটি সাক্ষাৎকারও খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছি। তিনি ভারত সম্পর্কে ভালো-ভালো কথা বলেছেন, মোদী সম্পর্কেও। বিশ্বে শান্তি স্থাপনে ভারতের ভূমিকারও প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মোদীর নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বিষয়ে তাঁর যে উদ্ধৃতি ভাইরাল করা হয়েছে, সে রকম কিছু তাঁর মুখ থেকে বেরোয়নি।
আমরা এও দেখেছি যে, অনেক সাংবাদিকই তাঁকে মোদীর নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন l বিশেষত দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এবং এবিপি নিউজ তো তাঁর কাছে বার বার এ কথা জানতে চেয়েছে। উত্তরে অ্যাসলে শুধু বলেছেন—আমি আশা করি, সব নেতাই এই পুরস্কার পাওয়ার মতো প্রয়াস চালাতে অনুপ্রাণিত বোধ করবেন।
যে কমিটি এই আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছিল, তার কোর কমিটির সদস্য মনোজ কুমার শর্মার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি আগাগোড়াই অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁর জ্ঞানত কোনও সময়েই অ্যাসলে এ ধরনের কোনও মন্তব্য করেননিঃ “নরওয়ের নোবেল কমিটির উপ-নেতার সঙ্গে আমি সবসময় ছিলাম—বক্তৃতার সময় তো বটেই, এমনকী আইটিসি মৌর্য শেরাটন হোটেলেও, যেখানে তাঁর সাক্ষাত্কার নিতে আসেন টাইমস নাউ-এর সাংবাদিক l কী ১৪ মার্চ তাঁর বক্তৃতায়, কী গতকাল তাঁর সাক্ষাত্কারে অ্যাসলে টোজে কখনওই মোদীর নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে রা কাড়েননি।”
স্বয়ং টোজের কাছেও আমরা এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছি। তাঁর প্রতিক্রিয়া পেলে এই প্রতিবেদন সংস্করণ করা হবে।
মোদীর নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে টোজে-র পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়
নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যে সব নিয়ম-কানুন মানতে হয়, তাতে চোখ বোলালে স্পষ্ট যে নোবেল কমিটির সদস্য হিসাবে টোজের পক্ষে কোনও সম্ভাব্য প্রাপকের নাম নিয়ে জল্পনা করার কোনও অবকাশই নেই।
নোবেল পুরস্কারের মনোনয়নের নিজস্ব ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, মনোনয়নকারী এবং মনোনীতদের নাম অন্তত ৫০ বছর প্রকাশ করা হয় না।
২০২২ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার
২০২২ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ৩৪৩ জনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৫১ জন ব্যক্তি এবং ৯২টি সংগঠন রয়েছে।
মনোনীতদের এই সংখ্যাটা গত বছরের (৩২৯) থেকেও বেশি l বস্তুত এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যা l সর্বোচ্চ মনোনয়ন পেয়েছিল ২০১৬ সালে – ৩৭৬ জন।
৫০ বছর পার হওয়ার আগে এই মনোনীতদের এবং মনোনয়নকারীদের নাম প্রকাশ করা যাবে না।
বিজেতারা কী ভাবে নির্বাচিত হন?
মনোনয়ন জমা পড়ার পর নরওয়ের পার্লামেন্ট দ্বারা নিযুক্ত ৫ জনকে নিয়ে তৈরি নরওয়ে নোবেল কমিটি মনোনীতদের একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করে।
নোবেল পুরস্কারের ওয়েবসাইট অনুযায়ী ২০২৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ৩০৫ জন মনোনীত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ব্যক্তি ২১২ জন আর প্রতিষ্ঠান ৯৩টি।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন জমার প্রস্তুতি শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাস থেকে, ৩১ জানুয়ারি যার চূড়ান্ত সময়সীমা।
ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলে তা থেকে বেছে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরির কাজ। এপ্রিল থেকে অগস্ট চলে উপদেষ্টাদের পর্যালোচনা।
অক্টোবর মাসে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে জয়ীর নাম পুরস্কার প্রাপক হিসাবে ঘোষিত হয়। ডিসেম্বর মাসে পুরস্কার প্রাপকের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের চূড়ান্ত নির্বাচনে নরওয়ের নোবেল কমিটি যুক্ত থাকে।
পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীরবিদ্যা বা মেডিসিন, সাহিত্য এবং অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের অনুষ্ঠানটি হয় সুইডেনের স্টকহোমে, কিন্তু নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় অসলো-তে।
নোবেল পুরস্কারের সরকারি টুইটার অ্যাকাউন্টে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই পুরস্কারের মনোনয়ন এবং নির্বাচন পদ্ধতি। টোজে নিজেই সেখানে ব্যাখ্যা করেছেন, পুরস্কার প্রাপক তাঁর সাফল্যের কথা জানতে পারেন নোবেল কমিটির প্রকাশ্য ঘোষণার মাত্র এক ঘন্টা আগে।
গত বছর সমাজমাধ্যমের বেশ কয়েকটি হ্যান্ডেল থেকে রটানো হয়েছিল যে, অল্টনিউজ-এর (Altnews) সহ-প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ জুবের (Mohammed Zubair) এবং প্রতীক সিংহ (Pratik Sinha) নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন। সে সময় আমরা তথ্য-যাচাই করে জানিয়েছিলাম যে, যে-পছন্দের তালিকায় এই দুজনের নাম রয়েছে, সেটা নরওয়ের নোবেল কমিটির তৈরি নয় এবং অন্যান্য কিছু সংগঠন ও সংস্থা এই তালিকা বানিয়েছে।
নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন ও নির্বাচন বিষয়ে আমাদের প্রতিবেদন পড়তে ক্লিক করুন এখানে।