বেশ কয়েকটি সম্পর্কহীন ভিডিও হোয়াটঅ্যাপ ও অন্যন্য সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে প্রচার করা হচ্ছে যে, বিহার (Bihar) থেকে আসা পরিযায়ী (Migrants) শ্রমিকরা তামিলনাড়ুতে (Tamil Nadu) আক্রান্ত (attacked) হচ্ছে।
বুম যাচাই করে দেখে ভাইরাল দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং ভিডিওগুলি তামিলনাড়ু ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সম্পর্কহীন (unrelated videos) অপরাধমূলক ঘটনার ভয়ঙ্কর দৃশ্য।
অন্তত ৫টি এই রকম ভিডিও ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে অন্তত ৪টি ভিডিওর বেলায় আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, এগুলি বিহারের পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর হামলার দৃশ্য নয়। পঞ্চম ভিডিওটি এখনও খতিয়ে দেখা বাকি।
ফেব্রুয়ারি মাসে একটি ঘটনায় এক ব্যক্তি ট্রেনে যাতায়াতকারী বিহারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল তামিলনাড়ুর শ্রমিকদের কাজ কেড়ে নেওয়ার l সেই অজুহাতে তাদের সে গালাগালও দেয় এবং তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করে। এই ঘটনাটির ভিডিও ভাইরালও হয় এবং রেল পুলিশ ওই ব্যক্তিকে পি মাগিমাইদাস হিসাবে শনাক্ত করে শত্রুতা ছড়ানোর দায়ে তাকে গ্রেফতারও করে।
কিন্তু তার পরেও এই ধরনের আরও কয়েকটি হামলার ভিডিও ভাইরাল হয়, যাতে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণের গুজবে ইন্ধন জোগায়।
ইতিমধ্যে তামিলনাড়ু পুলিশের ডিজি শৈলেন্দ্র বাবু নিজে একটি ভিডিও রেকর্ড করে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর হামলার কথা অস্বীকার করেন।
ভিডিওগুলি হোয়াটসঅ্যাপ সহ অন্য সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং সেগুলির ক্যাপশনে তামিলনাড়ুতে পরিযায়ীদের ওপর আক্রমণের কথা প্রচারিত হতে থাকে। কিছু অচেনা হিন্দি ওয়েবসাইটেও সেগুলি দেখানো হতে থাকে।
প্রথম ভিডিও: হায়দরাবাদের জিয়াগুড়ায় খুন! তামিলনাড়ুর ঘটনা বলে ছড়াল
এই ভিডিওয় হায়দরাবাদের জিয়াগুড়ায় একটি ব্যস্ত রাস্তার উপরে প্রকাশ্য দিবালোকে তিন ব্যক্তির তাদের বন্ধুকে কুপিয়ে খুন করার দৃশ্য রেকর্ড করে প্রচার হচ্ছে—এটা বিহারি পরিযায়ী শ্রমিককে হত্যার দৃশ্য।
ভিডিওটির একটি স্ক্রিনশট নিয়ে সেটির খোঁজ লাগিয়ে আমরা নিউজট্যাপ নামের এক ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদন দেখতে পাই। সেই প্রতিবেদনে নবীনা ঘানাটো নামের এক সাংবাদিকের টুইট করা একটি ভিডিও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যসূত্র অনুসরণ করে আমরা ডেকান ক্রনিকল গণমাধ্যমে ২২ জানুয়ারি সংখ্যায় ওই একই ঘটনার একটি রিপোর্টও দেখতে পাই। কুলসুমপুরা পুলিশকে উদ্ধৃত করে সেই রিপোর্টে লেখা হয়, ৩০ বছর বয়স্ক তরুণ জঙ্গম সাইনাথকে তার ৩ জন বন্ধু আকাশ, তিল্লু এবং সনু মিলে প্রকাশ্য রাস্তায় খুন করে। ডেকান ক্রনিকল-কে পুলিশ নাকি জানায়, খুনের কারণ সাইনাথের একটি অবৈধ প্রেমের ঘটনা। বুম অবশ্য সে ব্যাপারটা যাচাই করে উঠতে পারেনি। এ ব্যাপারে আরও জানতে পড়ুন এখানে।
দ্বিতীয় ভিডিও: কর্নাটকের সাভানুরে দাগি আসামী হত্যা তামিলনাড়ুর বলে ছড়াল
২০২১ সালের অগস্ট মাসে কর্নাটকের হাভেরি জেলার সাভানুরে ৪ জন লোক এক ব্যক্তিকে কুড়ুল ও তরোয়াল দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে মারার ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে। নিহত ব্যক্তির হাতে একটি বন্দুকও দেখানো হয়েছে।
খোঁজখবর করে আমরা কুইন্ট-এর তথ্য-যাচাইকারী ওয়েবসাইট ওয়েবকুফ-এ একটি প্রতিবেদন দেখতে পাই, তাতে একই ভিডিও অন্য একটি গল্পের প্রমাণ হিসাবে জুড়ে ভাইরাল করা হয়েছিল।
ভিডিওটি আনোয়ার শাইখার ওরফে টাইগার আনোয়ার নামে গোয়ার মারগাঁও-এর এক কুখ্যাত অপরাধীর, যাকে ৪ ভাই মিলে ২০২১ সালের অগস্ট খুন করেছিল।
সাভানুর-এর পুলিশ অফিসারকে উদ্ধৃত করে গোয়ার দৈনিক পত্রিকা হেরাল্ড তাদের প্রতিবেদনে লেখে, ঘাতক ৪ ভাই ইমরান চৌধুরী (২৮), তনভির চৌধুরী (২৪), আবির চৌধুরী (২২) ও রেহান চৌধুরী (২০) সাভানুর শহরেরই বাসিন্দা। নিহত ব্যক্তির সঙ্গে শত্রুতাই তার খুন হওয়ার কারণ বলে সন্দেহ করা হয়। এ ব্যাপারে আরও জানতে পড়ুন এখানে এবং এখানে।
তৃতীয় ভিডিও: রাজস্থানের এক আইনজীবীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তামিলনাড়ুর বলে ছড়াল
রাজস্থানের যোধপুরে এক ব্যস্ত সড়কে এক ব্যক্তিকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হচ্ছে, তার পর মাথায় আঘাত করে খুন করা হচ্ছে —এমন একটি ভিডিওকেও ভাইরাল করে ভুয়ো দাবি তোলা হচ্ছে, এটি তামিলনাড়ুতে বিহারের পরিযায়ী শ্রমিকের উপর হামলার দৃশ্য।
এই ভিডিওটাকেই এর আগেও যখন অন্য গল্প জুড়ে ভাইরাল করা হয়েছিল যে, এটি মুসলিম আক্রমণকারীদের হাতে হিন্দু মন্দিরের পুরোহিতের নিহত হওয়ার দৃশ্য, তখন বুম হিন্দি সেই ভুয়ো গুজবের পর্দাফাঁস করেছিল। বুম হিন্দির সেই তথ্য যাচাই দেখতে পারেন এখানে।
তবে ভিডিওটি রাজস্থানের যোধপুরের আইনজীবী যোগরাজ চৌহানের, যাঁকে তাঁরই তুতো ভাই অনিল এবং মুকেশ চৌহান একটি জমি নিয়ে বিরোধের জেরে কুপিয়ে খুন করে। এবং ঘটনাটি এ বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসের।
বুম হিন্দি যোধপুরের ‘মাতা কা থান’ থানার সঙ্গেও এই বিষয়ে যোগাযোগ করে এবং থানার তরফে ঘটনাটি নিশ্চিত করা হয়।
হিন্দি সংবাদমাধ্যম দৈনিক ভাস্কর এবং রাজস্থান পত্রিকাতে এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। যুগরাজ চৌহানের হত্যার প্রতিবাদে যোধপুরের আইনজীবীরা ধর্মঘটও পালন করেন।
আমাদের তথ্য-যাচাই থেকেও স্পষ্ট যে ঘটনাটির সঙ্গে তামিলনাড়ুর কোনও সম্পর্ক নেই এবং বিহারের পরিযায়ী শ্রমিকরাও কোনও ভাবেই এর শিকার নন।
চতুর্থ ভিডিও: কোয়েম্বাটুরের স্থানীয় গুন্ডা সর্দারের হত্যাকে পরিযায়ী শ্রমিকের উপর হামলা বলা হল
২৪ বছরের এক যুবকের নির্মমভাবে খুন হওয়ার ভিডিও শেয়ার করেও ভুয়ো গুজব ছড়ানো হচ্ছে যে, এটি তামিলদের হাতে বিহারি পরিযায়ী শ্রমিকদের আক্রান্ত হওয়ার দৃশ্য।
আমরা খোঁজখবর করে দেখলাম ভিডিওটি জি গোকুল নামে এক গুন্ডাসর্দারকে খুন করার দৃশ্য, যাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমাজবিরোধীরা ১৩ ফেব্রুয়ারি কোয়েম্বাটুর আদালত চত্বরেই কুপিয়ে খুন করে। টাইমস অফ ইন্ডিয়া এবং দ্য হিন্দু, উভয় গণমাধ্যমেই প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, গোকুল একটি খুনের মামলার শুনানির জন্যই আদালত চত্বরে হাজির হয়েছিল এবং সে যখন সেখানে বসে চা খাচ্ছিল, তখনই জনা পাঁচেক লোক তাকে ধাওয়া করে কুপিয়ে হত্যা করে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অন্য একটি দলের এক গুন্ডাকে খুন করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা চলছিল। তামিলনাড়ু পুলিশ গোকুলকে খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৭ জনকে গ্রেফতারও করে।
পঞ্চম ভিডিও: এক আহত ব্যক্তিকে আক্রান্ত পরিযায়ী শ্রমিক বলা হচ্ছে
পঞ্চম ভিডিওটিতে এক দল লোক এক গুরুতর জখম ব্যক্তিকে ঘিরে নিজেদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। এই ভিডিওটিও শেয়ার করা হচ্ছে উত্তর ভারতীয়ের উপর তামিলদের আক্রমণের দৃশ্য হিসাবে। রাতে তোলা এই ভিডিওতে দুই জন পুলিশকেও হাজির দেখানো হয়েছে, যারা মারের চোটে সংজ্ঞাহীন ব্যক্তিটিকে ঘিরে রেখেছে।
বুম এই ভিডিওটির ক্ষেত্রে কোনও সংবাদ-প্রতিবেদন পায়নি। ভবিষ্যতে আরও বিশদ তথ্য সংগৃহীত হলে সেই মতো প্রতিবেদনটি সংস্করণ করা হবে।