গত সপ্তাহে, বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করা একটি সমীক্ষার কথা লেখা হয়। বলা হয়, উত্তরপ্রদেশ সরকার যেভাবে পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত সঙ্কটের মোকাবিলা করে, তার প্রশংসা করা হয়েছে ওই সমীক্ষায়।
বিষয়টি নিয়ে, বুম এবং ফ্যাক্টচেকার যৌথ অনুসন্ধান করে। তাতে দেখা যায় যে, সংবাদ মাধ্যমগুলি সম্পূর্ণ ভুল রিপোর্ট লিখেছে। ওই সমীক্ষাটি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় করেনি; করেছিল গুরুগ্রামের 'ইনস্টিটিউট ফর কমপেটিটিভনেস' (আইএফসি)। আইএফসি হাভার্ড বিজনেস স্কুল'র 'মাইক্রোইকোনমিকস অফ কমপেটিটিভনেস' (এমওসি) নেটওয়ার্কের সদস্য। কিন্তু ওই সমীক্ষার সঙ্গে হাভার্ড কোনও ভাবেই যুক্ত ছিল না। তাছাড়া, উত্তরপ্রদেশ সরকার পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যা যেভাবে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছিল, তার প্রশংসা করা হয়নি ওই সমীক্ষায়। বরং, উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ পরিচালিত সরকারের পদক্ষেপগুলি বিশ্লেষণ করা হয়েছে, মন্তব্য করা হয়েছে, আর কিভাবে পরিস্থিতির উন্নতি করা যায়, সে সম্পর্কে পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
আইএফসির সাম্মানিক সভাপতি অমিত কপূরের সঙ্গে কথা বলে বুম ও ফ্যাক্টচেকার। সমীক্ষাটি হাভার্ড করেছে ও তাতে উত্তরপ্রদেশ সরকারের পদক্ষেপগুলির প্রশংসা করা হয়েছে, সেই দাবি তিনি সরাসরি খারিজ করে দেন। "হাভার্ড বিজনেস স্কুলের (এইচবিএস)ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড কমপেটিটিভনেস-এর অনুমোদিত সংস্থা আমরা। ওই রিপোর্টে বা অন্য কোথাও আমরা বলিনি যে, সমীক্ষাটি হাভার্ড করেছে। তাই এমওসি'র একটি অনুমোদিত শাখার করা সমীক্ষাকে হাভার্ড করা বলে দাবি করা বেঠিক হবে," বলেন কপূর।
তিনি আরও বলেন, "একটি বিশ্লেষণ পদ্ধতির সাহায্যে উত্তরপ্রদেশের চেষ্টাগুলিকে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এটি কোনও তুলনামূলক কাজ নয়। তাই এতে কারও প্রশংসা করা হয়েছে, তা বলা যাবে না। ভবিষ্যতে অতিমারি মোকাবিলা করার ব্যাপরে উত্তরপ্রদেশে সরকারকে কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়েছে ওই সমীক্ষায়।"
পরিযায়ী শ্রমিক সঙ্কট
২০২০ সালের ২৫ মার্চ ভারত সরকার ২১ দিনের জন্য দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করে। কিন্তু সেই লকডাউন ৩১ মে পর্যন্ত বহাল থাকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লকডাউন ঘোষণা করার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তা চালু হয়ে যায়। তার ফলে, দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়ায় এবং বহু ব্যবসা ও কারখানা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে, সারা দেশে দিনমজুররা রাতারাতি তাঁদের কাজ হারান। ওই দিনমজুরদের বেশিরভাগই ছিলেন উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের বাসিন্দা।
ওই পরিস্থিতিতে, পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেন। তাঁদের অনেকের বাড়ি ছিল ১০০০ কিলোমিটার দূরে। পায়ে হেঁটেই তাঁরা তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছনর চেষ্টা চালান। আর তা করতে গিয়ে, অনেকে অনাহারে, ক্লান্তিতে, পুলিশের অত্যাচারে এবং অত্মহত্যা করে মারা যান। ওই ঘটনাকে 'পরিযায়ী শ্রমিক সঙ্কট' বা সহজ করে 'পরিযায়ী সঙ্কট' আখ্যা দেওয়া হয়।
মিডিয়া যা রিপোর্ট করে
পরিযায়ী সঙ্কট মোকাবিলা করতে উত্তরপ্রদেশ সরকার যে পদক্ষেপগুলি নেয়, সরকারি হ্যান্ডেল ও একাধিক সংবাদ মাধ্যমে দাবি করা হয় যে, 'হারভার্ড'-এর সমীক্ষা সেগুলির প্রশংসা করেছে।
'হিন্দুস্থান টাইমস', 'মেনসএক্সপি', 'ফ্রি প্রেস জার্নাল', 'সংবাদ প্রতিদিন' ও 'জাগরণ' নিজেদের নামে খবরটি ছাপে। উত্তরপ্রদেশ সরকারের এক মুখপাত্রের কথা উদ্ধৃত করে তাঁরা ওই দাবি করেন ও সমস্যা মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের ভূমিকাকে "পটু" ও "দক্ষ" বলে বর্ণনা করেন।
'টাইমস নাও' ও 'স্বরাজ্য', বৈদ্যুতিন সংবাদ সরবরাহকারী সংস্থা আইএএনএস'র নামে খবরটি প্রকাশ করে। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে ট্যাগ করে, আইএএনএস আগেই খবরটি টুইট করেছিল। বিজেপি নেতা বিনীত গোয়েঙ্কাও খবরটি শেয়ার করেন। সেই সঙ্গে, যে সব পরিযায়ী শ্রমিক ইউপি'র দিকে যাত্রা করেছিলেন, তাঁদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ করে উনি আম আদমি পার্টির সমালোচনাও করেন।
আইএএনএস'র টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
না, এটি হাভার্ডের সমীক্ষা নয়
বুম ও ফ্যাক্টচেক সমীক্ষাটি দেখার সুযোগ পায়। দেখা যায়, সমীক্ষাটি করে ইনস্টিটিউট অফ কমপেটিটিভনেস। হাভার্ড বিজনেস স্কুলের 'মাইক্রোইকনমিকস অফ কমপেটিটিভনেস' (এমওসি) নেটওয়ার্কের অঙ্গ ওই প্রতিষ্ঠান। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় নিজে ওই সমীক্ষাটি করেনি।
এইচবিএস'র ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড কমপেটিটিভনেস-এর মাইকেল পোর্টারের তৈরি করা একটি কোর্স হল এমওসি। এমওসি নেটওয়ার্কের অনুমোদিত সংস্থা শিক্ষার সরঞ্জাম, কোর্সের বিষয়বস্তু, নোট, টেপ-করা লেকচার ও লেকচার নোট পেয়ে থাকে।
২০১৯-এ, ১২১ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওই নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার মধ্যে ভারতের চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইনস্টিটিউট ফর কমপেটিটিভনেস হল একটি।
কপূর আরও বলেন যে, রিপোর্টটিতে কোথাও হারভার্ড বিজনেস স্কুলের উল্লেখ নেই। বা তার লোগোও নেই কোথাও। "রিপোর্টটিতে আমরা এইচবিএস-এর লোগো ব্যবহার করিনি। লোগোটা হল মাইক্রোইকনমিক্স অফ কমপেটিটিভনেস নেটওয়ার্কের, যার সদস্য আমরা। তবে সঠিক বার্তা দিতে লোগোটা তুলে দেওয়া হবে। তাছাড়া, আমরা তো সমীক্ষাটি সর্বসাধারণের জন্য উপস্থাপন করিনি," বলেন কাপুর।
সমীক্ষায় কি বলা হয়েছে?
সমীক্ষাটির মেথডলজি বা পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে, কাপুর বলেন, "সমীক্ষাটিতে, আমরা উত্তরপ্রদেশের কোভিড সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলি তিন দিক থেকে বিচার করি: পরিযায়ীদের সাহায্য, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও জীবিকার সুযোগ। অতিমারির শুরু থেকে উত্তরপ্রদেশের পদক্ষেপগুলি নথিভুক্ত করা হয়েছে। এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা নেওয়ার একটি প্রয়াস হল এটি।"
রিপোর্টটি পড়তে গিয়ে দেখা যায়, তাতে সঙ্কটের মোকাবিলায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের পদক্ষেপগুলি সম্পর্কে নানান মন্তব্য রয়েছে।
পরিবহন
রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, ২৪ মার্চ ২০২০'র পর থেকে, সব মিলিয়ে ৩৫,২৮,২২৭ পরিযায়ী শ্রমিক উত্তরপ্রদেশে ফিরে যান। তার মধ্যে ৯৯.৫৪ শতাংশ ফেরেন ভারতের অন্য রাজ্য থেকে আর বাকি ০.৫৪ ফেরেন বিদেশ থেকে।
উত্তরপ্রদেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের বেশিরভাগ ছিলেন মহারাষ্ট্রে (৩৫.৯১%) আর গুজরাতে (২০.৪৭%)। তারপরের স্থান প্রতিবেশী রাজ্য দিল্লি (৯.২৩%), হরিয়ানা (৭.৬৮%) ও পাঞ্জাব (৮.৫২%)। ২৪ মার্চ ২০২০ আর ৩ জুলাই ২০২০-র মধ্যে, ৩৫,২৮,২২৭ পরিযায়ী শ্রমিকদের ১৬,১২৯ জন অন্যান্য দেশ থেকে ফেরেন। তার মধ্যে ১৪,৫১৭ জন (৯০%) ফেরেন নেপাল থেকে। বাকিরা ফিরেছিলেন দুবাই, কুয়েত, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি থেকে।
যদিও শ্রমিক ট্রেনের সাহায্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা হয়, লকডাউন চলাকালে একেবারে মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদন থেকে গৃহমুখী পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম দুর্দশার কথা জানা যায়।
পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি উত্তরপ্রদেশের প্রশাসন ও আধিকারিকদের ঔদাসীন্যের কয়েকটি প্রকাশিত নমুনা নীচে দেওয়া হল।
• শনিবার সকালে, পরিযায়ী শ্রমিক বোঝাই একটি লরিকে একটি ট্রাক ধাক্কা মারলে অন্তত ২৫ জন শ্রমিক মারা যান। সকাল ৮.৩০ নাগাদ, উত্তরপ্রদেশের অরাইয়ার কাছে ঘটনাটি ঘটে। রিপোর্টটি দেখুন এখানে।
• বেরিলিতে, এক দল পরিযায়ী শ্রমিককে রাস্তায় বসিয়ে তাঁদের ওপর ক্লোরিন মেশান জল স্প্রে করা হয়। রিপোর্টটি দেখুন এখানে।
• পায়ে হেঁটে বহু দূর পথ অতিক্রম করে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার চেষ্টা শুরু করলে, তবেই তাঁদের জন্য বাসের ব্যবস্থা করা হয়। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বাসের ব্যবস্থা করলে, বিজেপি পরিচালিত উত্তরপ্রদেশ সরকার ও কংগ্রেসের মধ্যে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে যায়। রিপোর্টটি এখানে দেখুন।
উত্তরপ্রদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, উত্তরপ্রদেশে প্রতি এক লক্ষ মানুষের জন্য ১০টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে, যা হল ভারতে তলার দিক থেকে সাত নম্বর স্থান। একইভাবে, এক লক্ষ মানুষের জন্য ডাক্তার আর হাসপাতালের শয্যা সংখ্যার ক্ষেত্রেও দেশের পাঁচটি পিছিয়ে থাকা রাজ্যের মধ্যে পড়ে উত্তরপ্রদেশ।
রিপোর্টটির ৭০ পৃষ্ঠার উপসংহারে বলা হয়েছে, "বর্তমান প্রকল্পগুলির ভিত্তিতে এবং নতুন মউ সই করে, উত্তরপ্রদেশ সরকার তাদের জন্য বাড়ির কাছে অর্থনৈতিক সুযোগের ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টির আরও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। রাজ্যের বর্তমান ক্ষমতা আর শ্রমিকদের দক্ষতার কথা মাথায় রেখে সেই পরিকল্পনা করতে হবে।"
উত্তরপ্রদেশ সরকার কিভাবে সঙ্কটের মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে তা পর্যালোচনা করা হয়েছে রিপোর্টটিতে, কিন্তু তার প্রশংসা করা হয়নি।
উত্তরপ্রদেশ সরকারের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব নবনীত সেহগলের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুম ও ফ্যাক্টচেকার। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি আলোচনা করতে রাজি হননি। তিনি অবশ্য তাঁর দফতরের একজনকে রিপোর্টের একটি কপি আমাদের দিতে বলেন।