কর্নাটকের (Karnataka) বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস (Congress) বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে যাওয়ার পর তোলা ভিডিওতে ইসলামি নিশান ওড়ার দৃশ্যের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে দাবি করা হচ্ছে, উল্লসিত সমর্থকরা পাকিস্তানের পতাকা ওড়াচ্ছে। বেশ কিছু দক্ষিণপন্থী টুইটার হ্যান্ডেল থেকে দাবি করা হয়েছে যে, কংগ্রেসের কাছে বিজেপির পরাজয়ের ফলে উল্লসিতরা ইসলামি পতাকা উড়িয়েছে। ভিডিওতে যে আরও দুধরনের পতাকাও উড়তে দেখা গেছে, সেটা তারা উপেক্ষা করেছে।
বুম অবশ্য লক্ষ করেছে যে, ভিডিওতে দেখানো উক্ত নিশানটি পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নয়, নিছকই ইসলামের ধর্মীয় নিশান। অন্য যে দুটি পতাকাকে ভিডিওটিতে উড়তে দেখা গেছে, তার একটি “ওম” লেখা গেরুয়া পতাকা, অন্যটি দলিত আন্দোলনের পতাকা, যা ভাটকাল-এ জয়ী দলিত কংগ্রেস প্রার্থী মনকল বৈদ্যর সাফল্য উদযাপন করছে।
১৩ মে-র কর্নাটক বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে ১৩৫টি আসনে জয় হাসিল করে। পরাজিত বিজেপি মাত্র ৬৬টি আসন পেয়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হয়েছে। এই নির্বাচনী জনাদেশ প্রকাশিত হওয়ার পরেই সমাজ-মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর বেশ কিছু পোস্ট ভুয়ো দাবি সহ ঘুরছে। এক টুইটার ব্যবহারকারী এই ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশন দিয়েছে, “কংগ্রেস এখনও সরকার গঠন পর্যন্ত করেনি, তার আগেই পাকিস্তানের পতাকা ওড়াতে শুরু করেছে।”
এই পোস্টটির আর্কাইভ দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
একই ভুয়ো দাবি সহ ফেসবুক-এও ভিডিওটি ছড়িয়েছে।
এই ধরনের আরও পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে।
বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি সেল-এর ভারপ্রাপ্ত অমিত মালব্য পর্যন্ত ভিডিওটি শেয়ার করে ক্যাপশন দিয়েছেন, ‘ভাটকল! কংগ্রেসের জয়ের অল্প সময় পরেই!’
দক্ষিণপন্থী সংবাদ-মাধ্যম পাঞ্চজন্য ভিডিওটির একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করে হিন্দিতে ক্যাপশন দিয়েছে—“কর্নাটকের ভাটকলে ইসলামি পতাকা উড়ছে। ভাটকলে মুসলিমরা জনসংখ্যার ৬৪.৫৯ শতাংশ, আর হিন্দুরা ৩৩.১৭ শতাংশ”।
টুইটার হ্যান্ডেল Woke Patroller ওই ভিডিওটি টুইট করে ক্যাপশন দিয়েছে—“কংগ্রেস এখনো কর্নাটকে সরকার গঠন করেনি, কিন্তু তার প্রবণতাগুলো সামনে আসতে শুরু করেছে।”
জনৈক শ্রীযুক্ত সিনহা-ও ভিডিওটি টুইট করে লিখেছেন—"কংগ্রেস এখনও সরকার গড়েনি, তাতেও বোঝা যাচ্ছে, আমরা কী হারিয়েছি!"
তথ্য যাচাই
ইসলামের পতাকাকে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা বলে ভুল করার ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও বুম এই ধরনের ভুলভাল খবরের তথ্য-যাচাই করেছে, যা এখানে দেখে নিতে পারেন।
ভিডিওতে দেখানো সবুজ নিশানটির মাঝখানে চন্দ্রকলা ও একটি তারা রয়েছে, যা মহরমের সময় কিংবা ইদ-মিলাদ-উন-নবির শোভাযাত্রার সময় দেখতে পাওয়া যায়। অন্য দিকে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার এক-চতুর্থাংশ শাদা এবং বাকি সবুজ অংশের মাঝখানে চাঁদের কলা ও তারা রয়েছে। নীচের ছবি দেখুন।
এই সূত্র অনুসরণ করে আমরা ‘ভাটকলিস’ নামের একটি স্থানীয় ওয়েবসাইটের সাংবাদিক শুভান-এর সঙ্গে যোগাযোগ করি। শুভান বুমকে জানান—‘‘সামসুদ্দিন সার্কেলে ওড়ানো ওই সবুজ নিশানটি ‘বাজমে ফইজুর রসুল’ নামের একটি ধর্মীয় সংগঠনের পতাকা। ইদ-মিলান-উন-নবির শোভাযাত্রার সময়েও ওই নিশান ওড়ানো হয়।’’
এর পর আমরা ‘বাজমে ফইজুর রসুল’ সংগঠনের শোভাযাত্রা সংক্রান্ত সংবাদ প্রতিবেদন খোঁজ করে ‘সাহিল অনলাইন’ নামের এক স্থানীয় ওয়েবসাইটে এবং ইউ-টিউবে একটি ভিডিও পাই, যাতে ওই ধর্মীয় নিশান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
কংগ্রেসের জয়লাভের পর কি ইসলামি পতাকা তোলা হয়?
বুম খুব ভালো করে নজর করে দেখেছে, ইসলামি ধর্মীয় নিশান ছাড়া আরও ৩টি পতাকা সে সময় ওড়ানো হচ্ছিল, যার একটিতে হিন্দু ধর্মের প্রতীকী মন্ত্র ‘ওম’ লেখা গেরুয়া নিশান ছিল, আর বাবাসাহেব আম্বেদকরের দলিত প্রতিরোধের নীল পতাকা ছিল, তা ছাড়াও ভাটকলের জয়ী কংগ্রেস প্রার্থী মনকল বৈদ্যর সমর্থকদের পতাকাও ছিল।
আরও খোঁজখবর করে আমরা 'সাহিল অনলাইন টিভি নিউজ' নামের একটি যাচাই-করা ইউ-টিউব চ্যানেলে ওই ভিডিওটি খুঁজে পাই। তাতে ভিডিওটির শিরোনামে লেখা—“ভাটকল তার নতুন এমএলএ মনকল বৈদ্যকে সামসুদ্দিন সার্কেলে সাড়ম্বর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।”
এই ভিডিওতে জনসাধারণকে দেখা যাচ্ছে মনকল বৈদ্যকে স্বাগত জানাতে। তাঁরা একই সঙ্গে ‘ওম’ লেখা গেরুয়া পতাকা, দলিত আন্দোলনের নীল পতাকা এবং ইসলামি সবুজ নিশান ওড়াচ্ছেন।
জয়ী কংগ্রেস বিধায়ক বৈদ্যর সমর্থকরা একই সঙ্গে এই সব পতাকাই ওড়াচ্ছিলেন। সামসুদ্দিন সার্কেল-এও তাঁরা একই ভাবে উৎসব করছিলেন, ভাইরাল ভিডিওতে ঠিক সেটাই দেখা গিয়েছে।
শুভান বুমকে আরও জানান—‘সামসুদ্দিন সার্কেল ঐক্য ও সংহতির স্তম্ভ হিসাবেও পরিচিত। যত সংগঠন কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে, এ বার তারা সকলেই ওখানে পতাকা উড়িয়েছে’। এছাড়া আমরা ‘বার্তা ভারতী’ ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদনও দেখেছি, যাতে ভিডিওটি বিষয়ে উত্তর কন্নড়ের পুলিশ সুপার বিষ্ণুবর্ধনের বক্তব্যও রয়েছে। বার্তা ভারতীকে সুপার জানিয়েছেন— “ওটা ছিল একটা ধর্মীয় সংগঠনের পতাকা, মোটেই পাকিস্তানের পতাকা নয়। আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি। এবং সোশাল মিডিয়ার কাছেও আমাদের অনুরোধ, তারা যেন মিছিমিছি এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা না করে।”