ফেসবুক পোস্টে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে যে, দিল্লিতে ২৩ বছর বয়সী নিক্কি যাদবকে (Nikki Yadav) তাঁর মুসলমান বন্ধু মহম্মদ সাহিল (Mohammad Sahil) খুন (Delhi murder case) করে এবং দেহ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে। বাস্তবে, এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন হিন্দু।
বুম দেখে, অভিযুক্তের বয়স ২৪ ও তার নাম সাহিল গেহলত (Sahil Gehlot)। তার বাবার নাম বীরেন্দ্র সিংহ।
খবরে প্রকাশ, অভিযুক্ত গেহলত, নিক্কি যাদবকে শ্বাসরোধ করেহত্যা করে। এবং তাঁর দেহ নিজের খাবারের দোকানের ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে। তারপর সে অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করে। বলা হচ্ছে, গেহলত ও যাদবের মধ্যে চার বছরের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু গেহলতের বাবা মা সে কথা জানতেন না। এবং অন্য এক মহিলার সঙ্গে তার বিয়ের সম্বন্ধ করেন। ওই হত্যা ৪ ফেব্রুয়ারির কোনও এক সময় করা হয়। কিন্তু তা জানা যায় ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩-এ।
এই ঘটনার সঙ্গে শ্রদ্ধা ওয়াকার-এর হত্যাকাণ্ডের মিল আছে। ওয়াকারকে তাঁর সহবাসকারী আফতাব পুনাওয়ালা খুন করে। দেহটিকে সে টুকরো টুকরো করে কেটে ফ্রিজের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে এবং দেহাংশগুলি বিভিন্ন জায়গায় ফেলতে থাকে।
ভাইরাল পোস্টগুলিতে দাবি করা হয়েছে যে, নিক্কির খুনি হল মহম্মদ সাহিল নামের এক ব্যক্তি। এবং ওই হত্যাকাণ্ড হল ‘লাভ জেহাদ’-এর একটি ঘটনা। 'লাভ জেহাদ' হল এক তথাকথিত ষড়যন্ত্র, যা ভালবাসা বা বিয়ের নাম করে অমুসলিম মহিলাদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তকরণের ষড়যন্ত্র।
দক্ষিণপন্থী ওয়েবসাইট অপইন্ডিয়া হিন্দি তাদের রিপোর্টে কেবল অভিযুক্তের প্রথম নামটিই উল্লেখ করে। তার পুরো নামটা জানায় না। লেখাটির শিরোনাম ও স্ট্র্যাপলাইনে অভিযুক্তকে ‘সহিল’ বলেই উল্লেখ করা হয়। এবং মূল লেখাতেও কোথাও বলা হয়নি যে, তার নাম সহিল গেহলত।
রিপোর্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
অপইন্ডিয়া কিন্তু তাদের ইংরেজি সংস্করণে অভিযুক্তের পুরো নামটাই দিয়েছে।
একাধিক ফেসবুক পোস্টে আলাদা আলাদা করে দাবি করা হয়েছে যে, অভিযুক্ত একজন মুসলমান।
হিন্দিতে লেখা ক্যাপশনে বলা হয়, “মাশাল্লাহ! তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখা...নিক্কি যাদব আর মহম্মদ সহিল-এর ধর্মনিরপেক্ষ প্রেম কাহিনির স্বর্গীয় সমাপ্তি।”
(হিন্দিতে লেখা ক্যাপশন: माशाल्लाह...! टुकड़े टुकड़े कर के फ्रिज़ में दफ़नाया...निक्की यादव और मोहम्मद साहिल की सेकुलर प्रेम-कहानी का आसमानी अंत)
তথ্য যাচাই
বুম দেখে, দাবিগুলি মিথ্যে। অভিযুক্তের নাম সাহিল গেহলত; সে একজন হিন্দু। সে বীরেন্দ্র সিংহের ছেলে। এবং ওই ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনও যোগ নেই।
ওই ঘটনা সংক্রান্ত সংবাদ প্রতিবেদনগুলি আমরা পড়ে দেখি। বেশ কিছু রিপোর্টে, ২৪ বছর বয়সী অভিযুক্তকে সহিল গেহলত বলে শনাক্ত করা হয়। হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে, অভিযুক্তের পুরো নামটা সহিল গেহলত বলেই লেখা হয়। একে অপরের সঙ্গে কবে ওই দম্পতির দেখা হয়েছিল, দিল্লির স্পেশাল পুলিশ কমিশনার (অপরাধ দমন শাখা) রবীন্দ্র যাদবকে উদ্ধৃত করে লেখা হয় সে কথাও। রবীন্দ্র যাদব বলেন, “জানুয়ারি ২০১৮’য়, স্টাফ সিলেক্সন কমিশন-এর পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য, গেহলত উত্তম নগরে একটি কোচিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। একই সময় হরিয়ানার ঝাজ্জার জেলার বাসিন্দা যাদব মেডিক্যাল এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন উত্তম নগরের অন্য একটি ইনস্টিটিউটে। একই বাসে যাতায়াত করতে করতে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।”
সংবাদ সংস্থা এএনআই-ও দিল্লি পুলিশের অপরাধ দমন শাখার ডেপুটি কমিশনারের বক্তব্য প্রকাশ করে। তিনি বলেন, “অন্য কোনও মহিলাকে সে বিয়ে করতে চলেছে কি? এই প্রশ্নের সম্মুখীন হলে, সাহিল নামের এক ব্যক্তি তার বান্ধবী নিক্কি যাদবের গলায় মোবাইল ফোনের তার জড়িয়ে তাকে দমবন্ধ করে মেরে ফেলে। সহিল ওই মহিলার দেহটিকে নিজের ধাবায় নিয়ে গিয়ে ফ্রিজের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।”
দিল্লি পুলিশের অপরাধ দমন শাখার একটি প্রেস বিবৃতিও আমরা দেখতে পাই। তাতে ওই হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয় এবং সাহিল গেহলত নামেই চিহ্নিত করা হয় অভিযুক্তকে। আরও বলা হয় যে, তার বয়স ২৪ এবং সে দিল্লির মিত্রোঁতে, পদার্থ রানার বাসিন্দা বীরেন্দ্র সিংহের ছেলে।
ওই প্রেস বিবৃতির একাধিক জায়গায় অভিযুক্তর নাম সাহিল গেহলত বলেই লেখা হয়। এবং ওই ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনও যোগাযোগের উল্লেখ নেই তাতে।
আমরা হিন্দুস্থান টাইমস-এর একটি রিপোর্টে দেখি যে, ধৃত অভিযুক্তের দুই আত্মীয়ের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাঁরা নিজেদের সম্প্রদায় থেকে গেহলতকে বহিষ্কার করার কথা বলেন। জয়বীর সিংহ গাঁধী ও হাওয়া সিংহ বলেন, “ওই অপরাধ ও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার কথা জানতে পারার পর, আমাদের পরিবার বা গ্রামের কেউ তার (গেহলত) সঙ্গে দেখা করেনি বা তাকে কোনও রকম সমর্থন জানায়নি। একজন মহিলাকে হত্যা করার মতো অপরাধ আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমরা তাকে বয়কট করেছি।”